একশো বছর কথা কয়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় -ফকির আলমগীর

25 Aug 2021, 03:19 PM ক্যাম্পাস শেয়ার:
একশো বছর কথা কয়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়  -ফকির আলমগীর

বাংলাদেশের গণসংগীতের উজ্জ্বল নক্ষত্র ফকির আলমগীর আনন্দভুবনের নিয়মিত লেখক ছিলেন। ‘ছিলেন’ শব্দটি লিখতে গিয়ে হাত থেমে গেল। তবু লিখতে হলো। শিল্পসাহিত্য ও সংগীতজগতের বিশিষ্টজনদের নিয়ে স্মৃতিকথামূলক নিবন্ধ ‘স্মৃতিকাব্যে প্রিয়মুখ’ সিরিজ ছাড়াও তিনি বেশ কিছু বিষয়ে নিয়মিত লিখেছেন। করোনার সঙ্গে লড়াই করে হেরে গেলেন ৭১ বছর বয়সী তরুণপ্রাণ সংগীতশিল্পী। ২৩ জুলাই ২০২১ ঢাকার একটি বেসরকারি হাসপাতালে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শতবর্ষ উপলক্ষে বিশ্ববিদ্যলয়ের প্রাক্তন এই ছাত্র ও গণমানুষের প্রিয় শিল্পী আনন্দভুবনের পাঠকদের জন্য ধারাবাহিকভাবে লিখছিলেন ‘একশো বছর কথা কয়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়’ শীর্ষক নিবন্ধ। এতে গত একশো বছরের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ, লেখাপড়া এবং জাতীয় ও ছাত্রদের নানা ইস্যুতে সংগঠিত ছাত্র আন্দোলনের কথা তুলে ধরছিলেন তিনি। অসুস্থ হওয়ার আগে লিখছিলেন নিবন্ধের একটি পর্ব। পর্বটি অসমাপ্ত রেখেই হাসপাতালে শয্যা গ্রহণ করতে হলো তাঁকে। অসমাপ্ত সেই পর্বটি এখানে পত্রস্থ করা হলো। -সম্পাদক 

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বাঙালি জাতীয়তাবাদ বিকাশের সুতিকাগার। সে মুক্তচিন্তার ক্ষেত্র হিসেবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সৃষ্টি তাতেই বিকশিত হয়েছে বাঙালির আত্মপরিচয়ের উপলব্ধি এবং তাকে ঘিরে একটি স্বতন্ত্র রাষ্ট্রচিন্তা। যেখানে একই সুতোয় বাঁধা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, বঙ্গবন্ধু ও ভাষা আন্দোলন। এক্ষেত্রে বিস্তারিত আলোচনা না করে বলা যায় বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার আন্দোলন এই বিশ্ববিদ্যালয়েই প্রথম দানা বাঁধে। আর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এ আন্দোলনের একজন প্রথম সারির নেতা ছিলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসে তাই জাতির পিতার নাম বারেবারেই উচ্চারিত হয়েছে গুরুত্বের সঙ্গে। ১৯২১ সালে প্রাচ্যের অক্সফোর্ড খ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আনুষ্ঠানিকভাবে যাত্রা শুরু করে। সূচনালগ্ন থেকেই রাজনৈতিক সহঅবস্থান ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যতম গৌরব-ঐতিহ্য। তাই এই অঞ্চলের মানুষের জন্য আলাদা আত্মপরিচয়ের পক্ষে আন্দোলন সংগ্রামের সূচনা হয়। 

শুরু থেকেই পশ্চিমা শাসক ও শোষক গোষ্ঠী তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তনের বাঙালি জনগোষ্ঠীকে দাবিয়ে রাখার চেষ্টা করে। তাই পাকিস্তানের সংকীর্ণমনা শাসকগোষ্ঠী বাংলা ভাষাকে দাপ্তরিক ও জ্ঞানচর্চার কার্যক্রম থেকে বাদ দেওয়ার ষড়যন্ত্র করে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সংগ্রামী ছাত্র সমাজ প্রথম থেকেই এই ষড়যন্ত্রের প্রতিবাদ করে। ড. আতিউর রহমানের লেখা থেকে জানা যায় এই আলোচনার পুরোধা ছিলেন, ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, শিক্ষক ও সাহিত্যিক কাজী মোতাহার হোসেন, ড. পৃথ্বীশ চক্রবর্তী, মুজাফফর আহমদ চৌধুরী, মুনীর চৌধুরী, আবুল কাশেম, নূরুল হক ভূঁইয়া, অজিত গুহ এবং অন্যান্য। একপর্যায়ে এই আন্দোলন রাজপথে নেমে আসে। আর এর নেতৃত্বে থাকেন এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র নেতৃবৃন্দ। ভাষা আন্দোলনের শুরু থেকেই আইন বিভাগের ছাত্র শেখ মুজিবুর রহমান এর সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। তাছাড়া তমদ্দুন মজলিশের সঙ্গে রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের বিভিন্ন কর্মসূচিতে তিনি যোগদান করেন। ১৯৪৮ সালের ২ মার্চ ‘রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ’ পুনর্গঠিত হয় এবং ছাত্রনেতা শামসুল আলমকে আহ্বায়ক করা হয়। এই সংগ্রাম পরিষদ গঠনে শেখ মুজিবুর রহমানের বলিষ্ঠ ভূমিকা ছিল।’ তারপর রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের সভা ধর্মঘট অব্যাহত থাকে তারই ধারাবাহিকতায় ১১ মার্চ ধর্মঘট চলাকালে জনাব তোয়াহা, শেখ মুজিব, শামসুল হক, গোলাম মাহবুব, অলি আহাদ, শওকত আলীসহ ৬৯জনকে আটক করা হয়। প্রতিবাদে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে প্রতিবাদ সভা হয়।

এখানে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য ১৬ মার্চ আমতলায় যে ছাত্রসভা অনুষ্ঠিত হয় তাতে সভাপতিত্ব করেন সদ্য কারামুক্ত ছাত্রনেতা শেখ মুজিব। সভা শেষে ছাত্ররা মিছিল বের করে। তারই ধারাবাহিকতায় ১৭ মার্চ সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ধর্মঘটের ডাক দেওয়া হয়। ২১ মার্চ ঢাকায় নাগরিকদের সংবর্ধনার জবাবে জিন্নাহ জানালেন উর্দুকে পাকিস্তানিদের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করা হবে। ছাত্ররা এতে ক্ষুব্ধ হন। তাই তারা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জন হলে অনুষ্ঠিতব্য বিশেষ সমাবর্তন অনুষ্ঠান প্রথমে বয়কটের সিদ্ধান্ত নিয়ে ও দেশের মর্যাদার কথা ভেবে পিছিয়ে আসেন। 

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। স্বাধীনতা, সংস্কৃতি, মুক্তচিন্তার প্রিয় প্রাঙ্গণ। ক্যাম্পাস আন্দোলন, সংগ্রাম প্রতিবাদ প্রকৃতির ভালোবাসা বিমোহিত করে যে কাউকে। তাই তো ক্যাম্পাসে বারবার ফিরে আসে সেই পুরনো স্মৃতি। শতবর্ষীয় আলোর ভুবন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, সে আলোর ভুবন কেবল আলোকসজ্জায় সজ্জিত কোনো জন্মদিনের আয়োজন নয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আলোচিত সত্তা আমি উপলব্ধি করি সারাক্ষণ। তার কথা যখনই ভাবি আমি দেখতে পাই তার সর্বাঙ্গে আলোর বিচ্ছুরণ। অন্ধকারের উৎস হতে উৎসারিত আলো।