একশো বছর কথা কয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় -ফকির আলমগীর

21 Mar 2021, 02:55 PM ক্যাম্পাস শেয়ার:
একশো বছর কথা কয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় -ফকির আলমগীর

স্বপ্নের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এক স্বপ্নের ক্যাম্পাস। এখানকার শিক্ষার্থী হওয়ার সম্মানই আলাদা। কে না চায় এই স্বপ্নের ক্যাম্পাসে ভর্তি হতে। তবে এখানে ভর্তিযুদ্ধের হিসাবটা যে ভিন্নরকম। অনেক ত্যাগ আর তিতিক্ষার পর এখানকার গর্বিত শিক্ষার্থী হওয়া যায়। জীবনের এতটা পথ পাড়ি দিয়ে এসেও আজও ভুলতে পারি না প্রিয় ক্যাম্পাসকে। নিজেকে ধন্য মনে হয় এই ভেবে যে, আমি এই স্বপ্নের বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন ছাত্র ছিলাম। শুধু তাই নয়, সেই ’৫২-র ভাষা আন্দোলনের রক্তাক্ত দলিল বুকে নিয়ে ৬০ দশকের আন্দোলনের সিঁড়ি বেয়ে ৬৯-এর গণঅভ্যুত্থানের অগ্নিগর্ভ থেকে গণসংগীতকে কণ্ঠে নিয়ে যেমন আন্দোলন সংগ্রামে যুক্ত থেকেছি, তেমনি তারই ধারাবাহিকতায় মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছি।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় জ্ঞানচর্চার ক্ষেত্রে সমগ্র দক্ষিণ এশিয়ার শ্রেষ্ঠ উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান। বলাই বাহুল্য এদেশের মহান ভাষা আন্দোলন, স্বাধিকার আন্দোলন, স্বায়ত্তশাসন প্রতিষ্ঠা, স্বৈরশাসন বিরোধী আন্দোলন, উনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান, মহান মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতা সংগ্রামে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূমিকা বিশ্ববাসী শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করে। এমনকি স্বাধীনতাত্তোর বাংলাদেশে সমগ্র গণতান্ত্রিক আন্দোলনের উদ্বেলিত মিছিলে বিশেষ করে স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে অবিস্মরণীয় ভূমিকা পালন করে। শুধু শিক্ষা, গবেষণা, ক্রীড়া, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রেই নয়, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির উৎকর্ষ সাধনে এই বিশ্ববিদ্যালয় সাফল্যের স্বাক্ষর রেখেছে। আমার অস্তিত্বের সঙ্গে মিশে আছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। তাই তো ক্যাম্পাসের সোনালি স্মৃতি আজও ভাবায়। আজও কাঁদায়।

পেছন ফিরে চাইলে যেন একশ’ বছর কথা কয়। এই বিশ্ববিদ্যালয় যেমন ভাষা আন্দোলন, গণঅভ্যুত্থান, মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতা সংগ্রামে সম্পৃক্ত থেকেছে তেমনি এখানকার ঐতিহাসিক স্থাপনা, ঐতিহাসিক স্থানসমূহ ও সংগ্রামের স্মৃতি বহন করে চলেছে। ঐতিহাসিক বটতলা, আমতলা, মধুর ক্যান্টিন, শরীফের ক্যান্টিন, ডাকসুভবন, শহিদ মিনার, কার্জন হল, কলাভবন, বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন ভাস্কর্য, বিভিন্ন ছাত্রাবাস, গবেষণা প্রতিষ্ঠান, বিভিন্ন দপ্তরের কর্মকাণ্ড সহশিক্ষা কার্যক্রম বিষয়ক : সংগীত, নাটক, নৃত্য, আবৃত্তি, বিতর্ক, খেলাধুলার বিভিন্ন স্মৃতি আজও পিছু ডাকে। টিএসসি চত্বরে প্র্রাণের স্পন্দন, বইমেলা, চারুকলার তত্ত¡নন্দন সেই স্মৃতিকে আরো বর্ণিল করে। এখানকার ধূলিকণা, ঝরাপাতা, দেয়াল লিখনে যেন সেই একশ’ বছরের গৌরবকেই স্মরণ করিয়ে দেয়। তাই তো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গৌরবের কথা, সংগ্রামী ইতিহাস ও ঐতিহ্য, সৃজনশীল গবেষণাকর্ম ও পান্ডুলিপি, শহিদ বুদ্ধিজীবীদের নিদর্শনসহ প্রামাণ্য দলিল আমাদের স্বপ্নের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দুর্লভ সম্পদ। বাঙালি জাতির সুদীর্ঘকালের ইতিহাস অনেকটা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাসের সঙ্গে নানাভাবে জড়িয়ে আছে। সেই দীর্ঘ ইতিহাস এই ছোট্ট ষাট দশককে অত্যন্ত গুরুত্বর্পূ ও তাৎপর্যপূর্ণ অধ্যায় বলে বিবেচনায় রেখেছে। সেই কারণেই আমি মুক্তিযুদ্ধপূর্ব অর্থাৎ মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতিকালীন অসংখ্য ঘটনাবহুল ষাট দশকের রাজনীতি সংস্কৃতির গতিপ্রবাহের একটি তথ্যচিত্র তুলে ধরার ক্ষুদ্র প্রচেষ্টা করেছি মাত্র। সে সময়ে রাজনীতিতে সংস্কৃতি ছিল, আর সংস্কৃতিতে রাজনীতি ছিল। রাজনীতি আর সংস্কৃতি পরস্পর হাত ধরাধরি করে চলেছে, সে এক অপূর্ব যুগলবন্দি।

তৎকালীন ক্যাম্পাস ছিল সত্যিকার অর্থে বাঙালি জাতির রাজনৈতিক সাংস্কৃতিক আন্দোলনের পাদপীঠ। বাঙালি জাতিসত্তার পূর্ণ উত্থানের উৎস মূলে ক্যাম্পাসকেন্দ্রিক জীবনপ্রবাহ ছিল নানা অর্থেই অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। এর গভীরতা যেমন ছিল তেমনি ছিল বিশালতা। মুক্তিযুদ্ধপূর্ব যারা ছাত্র ছিলেন তারা আজ বিভিন্ন ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত এবং খ্যাতিমান। তাই তারা তৎকালীন ক্যাম্পাসকেন্দ্রিক আন্দোলন সংগ্রামের জীবন্ত সাক্ষী। তাদের অভিজ্ঞতা ইতিহাসের মূল্যবান দলিল। এ প্রসঙ্গে আমি সাবেক ছাত্রনেতা স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম ডাকসু নির্বাচনের নির্বাচিত ভিপি, বর্তমান বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিমের স্মৃতিচারণ সংক্ষিপ্তভাবে তুলে ধরছি। মুক্তিযুদ্ধ ছিল বাঙালি জাতির ইতিহাসে তার শ্রেষ্ঠ অর্জন। সেই মহান মুক্তিযুদ্ধের আগে ও পরে আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ছিলাম। একাত্তরে আমি ছাত্র ইউনিয়নের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক ছিলাম। তাই যেহেতু ছাত্র আন্দোলন ছিল মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম প্রধান কেন্দ্র, আমি সে-কারণে আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধকে কেন্দ্রীয়ভাবে পরিচালনার কাজেও অনেকটা যুক্ত থাকতে পেরেছিলাম। একইসঙ্গে যুক্তিযুদ্ধ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে এভাবে সম্পৃক্ত থাকতে পারাকে আমি আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ অর্জন বলে এখনো মনে করি। ’৫২-র ভাষা আন্দোলনে রক্তাক্ত দলিল বুকে নিয়ে ৬০ দশকের আন্দোলনের সিঁড়ি বেয়ে ৬৯-এর গণঅভ্যুত্থানের উষ্ণতা নিয়ে সারা জাতি ক্রমেই এগিয়ে যাচ্ছিল মহান মুক্তিযুদ্ধ অভিমুখে। সেই ঐতিহ্যমণ্ডিত উত্তরাধিকারকে ধারণ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে কেন্দ্র করে মহান মুক্তিযুদ্ধে আমার অংশগ্রহণ ঘটেছিল।

৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান ছিল একনাগাড়ে চলা এক বিপ্লবী কর্মযজ্ঞ। পুলিশের সঙ্গে লড়াই, গুলির মুখে মিছিল নিয়ে এগিয়ে যাওয়া উত্তাল জনস্রোতকে আন্দোলনের সংগঠিত ধারায় সম্পৃক্ত করা, কারফিউ মোকাবিলা করে লড়াই অব্যাহত রাখা ইত্যাদি ঘটনা ছিল ছোটোখাটো বিপ্লবী কর্মকাণ্ডের মতো। অন্য অনেকের সঙ্গে আমি এসবের কেন্দ্রে ছিলাম। সফল হয়েছিল গণঅভ্যুত্থান, পতন হয়েছিল আইয়ুব শাহীর। আইয়ুব শাহীর পতনের পর ইয়াহিয়া খানের সামরিক সরকার সাধারণ নির্বাচন দিতে বাধ্য হয়েছিল। সত্তরের সেই নির্বিাচনে আওয়ামী লীগ একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করলেও পাকিস্তানের স্বৈরাচারি সরকার তার হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে অস্বীকার করেছিল। এমন একটি ষড়যন্ত্র ও বিশ্বাসঘাতকতার ঘটনা ঘটানো হতে পারে বলে অনেকেই তা আঁচ করতে পেরেছিলেন। যাহোক স্বাধীনতাপরবর্তী ডাকসু নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় ১৯৭২ সালে। এ নির্বাচনে ভিপি নির্বাচিত হলেন মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম ও জিএস নির্বাচিত হলেন মাহবুব জামান। তবে ষাটের দশকের আলোচনা অনেকটা অসম্পূর্ণ থাকবে আরো কয়েকজন ভিপি জিএস-এর কথা এখানে উল্লেখ না করলে বিশেষ করে ’৬৯-এর গণঅভ্যুত্থানের অবিস্মরণীয় ছাত্রনেতা ডাকসু ভিপি তোফায়েল আহমেদের কথা। বাংলাদেশের স্বাধীনতার আন্দোলন, গণঅভ্যুত্থান এবং আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধে ডাকসুর যেসব ভিপি, জিএস বিশেষ অবদান রেখেছিলেন তাদের মধ্যে ভিপি হিসেবে রাশেদ খান মেনন, ফেরদৌস আহমেদ কোরেশী, মাহফুজা খানম, তোফায়েল আহমেদ, আসম আবদুর রব, মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম। জিএস হিসেবে যাদের অবদান স্মরণীয় তাদের মধ্যে এনায়েতুর রহমান, কে এম ওবায়দুর রহমান, মতিয়া চৌধুরী, শফি আহমেদ, মোরশেদ আলী, নাজিম কামরান চৌধুরী, আবদুল কুদ্দুস মাখন, মাহবুব জামান আর স্বাধীনতা পরবর্তী জিএস আখরারুজ্জামান, জিয়াউদ্দিন বাবলু, মুশতাক হোসেন, খায়রুল করিব খোকনসহ প্রমুখ দেশের সকল গণতান্ত্রিক আন্দোলন তথা স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে বিশেষ অবাদন রাখেন। এছাড়া স্বাধীনতা পরবর্তী ভিপি মাহমুদুর রহমান মান্না, আখতারুজ্জামান, সুলতানা মোহাম্মদ মনসুর আহমেদ এবং আমানউল্লাহ আমান প্রমুখ গণতান্ত্রিক আন্দোলন ও স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে বিশেষ ভূমিকা পালন করেন। ডাকসু-র ভিপি তোফায়েল আহমেদের সময়কালে ’৬৯-এর গণঅভ্যুত্থানে পতন হয় আইয়ুব শাহির আর ডাকসু ভিপি আমান উল্লাহ আমানের সময়কালে ’৯০-এর গণঅভ্যুত্থানে পতন হয় স্বৈরাচার এরশাদ সরকারের। এখানে বিস্তারিত আলোচনায় না গিয়ে ষাটের দশকের শিক্ষা আন্দোলন বিশেষ করে কুখ্যাত হামিদুর রহমান শিক্ষা কমিশন রিপোর্ট বাতিলের দাবিতে দুর্বার আন্দোলন গড়ে ওঠে। ’৬২-র শিক্ষা আন্দোলনের সূতিকাগার ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। পাকিস্তান সরকার এদেশের শিক্ষা ব্যবস্থাকে ধ্বংস করার জন্য সুপরিকল্পিতভাবে শিক্ষা ব্যবস্থার উপর আঘাত হানলে ছাত্রজনতা দুর্বার প্রতিরোধ গড়ে তোলে। মোস্তফা, বাবুল, ওয়াজিউল্লাহ জীবন দিয়ে সবার জন্য শিক্ষার দ্বার উন্মোচন করেন। সেই থেকে এদেশের সাধারণ জনগণ বিশেষ করে ছাত্রসমাজ পরম শ্রদ্ধার সঙ্গে ১৭ সেপ্টেম্বর শিক্ষাদিবস পালন করে আসছে। আর ’৬৯-এর গণআন্দোলন ছিল জাতীয় আন্দোলনের অগ্নিগর্ভ। ১৯৬৬ সালে ৬ দফা আন্দোলনসহ ১৯৬৯-এর গণঅভ্যুত্থানের মধ্যদিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র আন্দোলন পরিণত হয় জাতীয় আন্দোলনে। [চলবে]

লেখক : গণসংগীতশিল্পী