বিশ্বের প্রাচীন কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়

21 Jun 2023, 02:43 PM ক্যাম্পাস শেয়ার:
বিশ্বের প্রাচীন কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়

যেকোনো জাতির সার্বিক উন্নয়নে শিক্ষার কোনো বিকল্প নেই। হাজার হাজার বছর আগেও এই বিষয়টিকে বেশ গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করতেন জ্ঞানীজনেরা। অনেককে একসাথে পাঠ দানের উদ্দেশ্যেই মূলত স্কুল কলেজের উদ্ভব। আর শিক্ষা বিস্তারে ও সভ্যতা উন্নয়নে বিশ্ববিদ্যালয়ের অবদান অপরিসীম। প্রাচীন অনেক বিশ্ববিদ্যালয় আছে যেগুলো মানবজাতির উন্নয়নে ইতিহাসে বিশেষ অবদান রেখেছে। আজ থাকছে প্রাচীন কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ের কথা। কয়েকটি এখনো তাদের কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। আবার কয়েকটি শুধু স্মৃতি হিসেবে রয়ে গেছে


নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়

পৃথিবীর সবচেয়ে প্রাচীন ও পুর্ণাঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে গণ্য করা হয় ভারতের নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়কে। ৬০০ খ্রিষ্টপূর্বের দিকে তৎকালীন রাজা সকরাদিত্য এই বিশ্ববিদ্যালয়প্রতিষ্ঠা করেন। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস তৎকালীন ভারতীয় উপমহাদেশের সংস্কৃতি ও শিক্ষার উজ্জ্বল উদাহরণ। বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চল যেমন ব্যাবিলন, গ্রিস, সিরিয়া এবং চীন থেকে ছাত্ররা পড়াশোনা করতে আসতো এখানে। অর্থনীতিবিদ্যা, ব্যবসা, ভাষাশিক্ষা, দর্শনশাস্ত্র, ব্যাকরণ, চিকিৎসা, সার্জারি, সমরবিদ্যাসহ আরো বিভিন্ন বিষয়ে পড়ানো হতো এই বিশ্ববিদ্যালয়ে। এই বিশ^বিদ্যালয়ে ভর্তির নূন্য বয়স ছিল ১৬ বছর।

২০০৬ খ্রিষ্টাব্দে ভারতের তৎকালীন রাষ্ট্রপতি এ. পি. জে. আবদুল কালাম নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়কে আবার প্রতিষ্ঠা করার ধারণা দেন। বিভিন্ন উদ্যোগের মাধ্যমে উত্তর ভারতের বিহার রাজ্যে নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের পুনঃনির্মাণ কাজ শুরু হয় এবং ২০১৪ খ্রিষ্টাব্দের পয়লা সেপ্টেম্বর বিশ্ববিদ্যালয়টির একাডেমিক কার্যক্রম শুরু হয়।

তক্ষশীলা বিশ্ববিদ্যালয়

১৮৬৩ খ্রিষ্টাব্দে অবিভক্ত ভারতে বর্তমান পাকিস্তানের ইসলামবাদ থেকে ৩৫ কিলোমিটার উত্তর-পশ্চিমে সারাইখেলা নামক জায়গায় তক্ষশীলা বিশ^বিদ্যালয়ের অস্তিত্ব আবিষ্কৃত হয়। রামায়ণের রামের মেজো ভাই ভরতের পুত্র ‘তক্ষ’র নামানুসারে তৎকালীন ওই নগরীর নাম হয় তক্ষশিলা। খ্রিষ্টপূর্ব সপ্তম শতাব্দী থেকেই তক্ষশিলা গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষাকেন্দ্রে পরিণত হয়। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে যুক্ত ছিলেন শ্রেষ্ঠ আচার্যগণÑ চাণক্য [অর্থনীতিবিদ], পাণিনি [ব্যাকরণবিদ, অষ্টাধ্যায়ী নামক ব্যাকরণের রচয়িতা], চরক [চিকিৎসক, চরক সংহিতা নামক আয়ুর্বেদ-গ্রন্থের রচয়িতা], জীবক [শৈল্য চিকিৎসক, গৌতমবুদ্ধের চিকিৎসক]।

এই বিশ্ববিদ্যালয়ে সাধারণত ছাত্র ভর্তি হতো ১৬ বছর বয়সে। এই সময় এরা বেদ অধ্যয়ন করতো। ১৮ বছর বয়স থেকে ছাত্রদের শেখানো হতো শিল্পকলা, তীর নিক্ষেপ, শিকার, আইন, চিকিৎসা এবং সমরবিদ্যা। ১০ হাজারের ওপর ছাত্র-শিক্ষকদের পদচারণায় মুখরিত ছিল এই বিশ্ববিদ্যালয়। ব্যাবিলন, গ্রিস, সিরিয়া ও চীনের অনেক শিক্ষার্থী ছিল তক্ষশীলা বিশ্ববিদ্যালয়ে। ইতিহাসবিদ ও পুরাতাত্ত্বিকদের গবেষণা থেকে ধারণা করা হয় খ্রিষ্টপূর্ব ৬০০-৭০০ অব্দের দিকে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের গোড়াপত্তন হয়। ইউনেস্কো ১৯৮০ খ্রিষ্টাব্দে এই তক্ষশীলাকে ‘বিশ্ব ঐতিহ্য স্থান’ হিসেবে ঘোষণা করে।

আল-কারাওইন বিশ্ববিদ্যালয়

পৃথিবীর প্রাচীনতম এখনো কসক্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম আল-কারাওইন বিশ্ববিদ্যালয়। ফাতিমা আল-ফিহরি নামের একজন মহিলা ৮৫৯ খ্রিষ্টাব্দে প্রতিষ্ঠা করেন এই বিশ্ববিদ্যালয়টি। এটি মরক্কোতে অবস্থিত।

প্রাথমিক অবস্থায় এই বিশ^বিদ্যালয়ে শুধু ন্যাচারাল সায়েন্স পড়ানো হতো। ১৯৫৭ খ্রিষ্টাব্দের পরে বিজ্ঞানের অন্যান্য শাখা চালু করা হয়। বর্তমানে আইন বিজ্ঞান, ইসলামিক শিক্ষা, আরবি ভাষা ও ব্যাকরণ, ইংরেজি ভাষা ও ফরাসি ভাষা ইত্যাদি বিভিন্ন বিষয় পড়ানো হয়।

আল-আজহার বিশ্ববিদ্যালয়

মিসরের আল-আজহার বিশ্ববিদ্যালয় ইসলামিক বিশ্বের সুপরিচিত একটি বিশ্ববিদ্যালয়। এর নির্মাণকাল ৯৭০-৯৭২ খ্রিষ্টাব্দ। এখনো এই বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্যক্রম অব্যহত আছে। এ বিশ্ববিদ্যালয় ছিল আরবি সাহিত্য, সুন্নি ইসলামি শিক্ষা এবং ধর্মীয় শিক্ষার প্রাণকেন্দ্র। বর্তমান সময়ে এ বিশ্ববিদ্যালয়ে একদিকে কুরআনভিত্তিক বিজ্ঞান এবং মহানবী হজরত মুহাম্মাদ [সা.]-এর শিক্ষা, অপরদিকে বিজ্ঞানের অন্যান্য শাখা নিয়ে পড়ানো হয়। আল-আজহার বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠাগারকে ইসলামী সম্পদ হিসেবে বিবেচনা করা হয় যা বর্তমানে অনলাইনে সংরক্ষণের উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে।


আল-নিজামিয়া বিশ্ববিদ্যালয়

খাজা নিজাম-উল-মুলুক এগারো শতকের শুরুর দিকে বাগদাদে এ বিশ্ববিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠা করেন। এর প্রতিষ্ঠাকাল ১০৬৫ খ্রিষ্টাব্দ। এটি খুবই জনপ্রিয়তা লাভ করে এবং সফলও হয়। তৎকালীন কবি, সাহিত্যিক ও জ্ঞানী ব্যক্তিরা এখানে শিক্ষা দেওয়া এবং জ্ঞান চর্চার জন্য আসতেন। ১০৯১ খ্রিষ্টাব্দে নিজাম-উল-মুলুক বিখ্যাত দার্শনিক ও ধর্মতাত্ত্বিক ইমাম আল-গাজ্জালিকে এর অধ্যাপক হিসেবে নিয়োগ দেন। এখানে বিনামূল্যে শিক্ষা দেওয়া হতো। মধ্যযুগের গুরুত্বপূর্ণ ফারসি কবিদের অন্যতম এবং ইরানের জনপ্রিয় কবি শেখ সাদি [রা.] আল-নিজামিয়ার ছাত্র ছিলেন।

বলোগনা বিশ্ববিদ্যালয়

ইতিহাসের অন্যতম পুরনো ও বড়ো বিশ্ববিদ্যালয়টি ইতালিতে ১০৮৮ খ্রিষ্টাব্দে প্রতিষ্ঠিত হয় এবং এখনো সুনামের সাথে চালু রয়েছে। শুরুর দিকেই ইউরোপের সব স্থান থেকে ছাত্ররা পড়তে আসত এ বিশ্ববিদ্যালয়ে। বর্তমানে ২৩টি স্কুলের অধীনে প্রায় ৮৫ হাজার শিক্ষার্থী পড়াশোনা করে বলোগনা বিশ্ববিদ্যালয়ে, যার মধ্যে প্রায় ৩০,০০০ শিক্ষার্থী স্নাতকোত্তর পর্যায়ের। ইতালিতে অবস্থিত বেশ কয়েকটি শহরে এবং আর্জেন্টিনার রাজধানী বুয়েন্স আয়ার্সে বলোগনা বিশ্ববিদ্যালয়ের শাখা রয়েছে। 

লেখা : ফাতেমা ইয়াসমিন