অবরুদ্ধ সময়ের গল্প : সৈয়দা তাসলিমা আক্তার

25 May 2025, 02:14 PM ভ্রমন শেয়ার:
অবরুদ্ধ সময়ের গল্প : সৈয়দা তাসলিমা আক্তার

সময়টা ২০২০, পুরো বিশ্বের মতো বাংলাদেশও তখন এক ভয়ানক বন্দিশালা। মার্চ মাস থেকেই আমরা রীতিমতো ঘরবন্দি, না কোনো যুদ্ধ-বিগ্রহ বা রাজনৈতিক মুভমেন্ট নয় বরং প্রকৃতির এক চরম পরিস্থিতি। এক ভয়াবহ ভাইরাস, যার সঙ্গে বিশ্ববাসী এর আগে কখনোই পরিচিত ছিল না। করোনা ভাইরাস, বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়া মহমারি, যা এই বিশ্বের পূর্ব-পশ্চিম বা উত্তর-দক্ষিণ কোনো প্রান্তকেই ছেড়ে দেয়নি। প্রতিটি ঘর তখন এক একটি কারাগার, জীবনের সব আনন্দ কোলাহল যেন থমকে গেছে। জীবন-জীবিকা চলছে ধঁকে ধুঁকে। মানুষের সাথে বহির্বিশ্বের যোগাযোগের একমাত্র মাধ্যম সোশাল নেটওয়ার্ক। বাংলাদেশে মার্চের শেষ ভাগ থেকে কিছুটা বিরতি দিয়ে লকডাউন চলছে। 

করোনা আমার কাছে যতটা না আতঙ্কের ছিল লকডাইন তার চেয়ে বেশি অতঙ্কের হয়ে উঠেছিল। মনে হতো আমি যেন পৃথিবী থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছি। আর বুঝি পৃথিবী এবং তার অধিবাসীরা তার ফেলে আসা সময়কে ফিরে পাবে না। আমাদের প্রজন্ম পৃথিবীর স্বাভাবিক রূপ-সুধা থেকে বঞ্চিতই থেকে যাবে। মার্চ থেকে সেপ্টেম্বর লকডাউন চলেছে, কখনো পুরোদমে কখনো শিথিলভাবে। এরপর পৃথিবী একটু একটু করে সুস্থ হচ্ছে মানুষ খুঁেজ ফিরছে তার জীবনের স্বাভাবিকতা। চলাচলের বিধি-নিষেধও আস্তে আস্তে উঠে যাচ্ছে, যদিও একইসঙ্গে র্দীঘ ভ্রমণ ও জনসমাবেশ এড়িয়ে যাওয়ার বিষয়ে সতর্কতা জারি রয়েছে। কিন্তু প্রাণীমাত্রই স্বধীনচেতা আর মানুষের কথা তো বলাই বাহুল্য, স্বেচ্ছায় সে ঘরবন্দি থাকতে পারে কিন্তু বাধ্য-বাধকতায় তার ঘোরতর আপত্তি। ব্যক্তিগতভাবে আমি ভ্রমণপ্রিয়াসী মানুষ, নিয়মের বেড়াজালকে সচারাচর অতিক্রম না করলেও অতিমাত্রার বাধ্য-বাধকতা আমাকেও অসহিঞ্চু করে তুলেছিল। একে তো করোনার আতঙ্ক আবার বাধ্যতামূলক লকডাউন, জীবন তার গতিশীলতা হারিয়ে ফেলেছে, অন্য অনেকের মতো আমার মনোজগতেও এর প্রভাব উপেক্ষা করার মতো ছিল না। তাই আক্টোবরে যখন সুযোগ এলো সিলেটে যাওয়ার, তখন আর দুবার ভাবিনি।

সিলেটে এর আগে পরে বহুবার গিয়েছি, বেঁেচ থাকলে হয়ত আবারও যাব কিন্তু ২০২০-এর অক্টোবরের শেষার্ধে সিলেট-ভ্রমণের সেই সময়টা জীবনকে স্বাভাবিক ধারায় ফিরিয়ে আনার ক্ষেত্রে সঞ্জিবনী হিসেবে কাজ করেছে। আমি খুব আশাবাদী মানুষ কিন্তু লকডাউনের এই ৫/৬ মাস সবার মতো আমাকে ডিপ্রেস করে তুলেছিল, এর থেকে পরিত্রাণের জন্য একটা ব্রেক ছিল সে-সময়ের সিলেট-ভ্রমণ। তাই এর কথা বিশেষ করে বলতে চাওয়া। 

আমি আর আমার মতোই একজন, আমার সহকর্মী দু’জনে রাতের বাসে সিলেটের উদ্দেশে রওনা করলাম, খুব বেশি হিসাব-নিকাশ না-করেই। রাতের বাসে রওনা করে ভোরবেলা আমরা সিলেট শহরে পৌঁছে গেলাম। আমাদের প্রথম গন্তব্য ছিল জাফলং, তাই বাস থেকে নেমে আগে থেকে ঠিক করে রাখা বাহনযোগে আমরা জাফলংয়ের পথে যাত্র করলাম। 

অক্টোবরের এই সময়ে সচরাচর বৃষ্টির দেখা মিললেও প্রকৃতি অনেকটাই কঠিন, আসলে কঠিন সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে চলতে চলতে মানুষ আর প্রকৃতি সবাই যেন দিন দিন রুক্ষ হয়ে যাচ্ছে। সিলেট প্রকৃতির এক অপার সৌন্দর্যের ভাণ্ডার, আমি এযাবৎ কম করে হলেও বার দশেক সিলেট গিয়েছি, তবে এর সিকিভাগ দেখা হয়েছে কি না সন্দেহ। আবার একই জায়গায় বার কয়েক যাওয়া হয়েছে এমনও ঘটেছে। এই যেমন জাফলং-এ আমি এই নিয়ে চারবার গিয়েছি কিন্তু এর পাশেই লালাখাল বলে যে মোহনীয় জায়গাটি আছে সেখানে এ পর্যন্ত যাওয়া হয়নি। তবে, এবার নিশ্চয়ই যাব। আমরা সিলেট শহর থেকে জাফলং-এ পৌঁছি তখন সকাল তার আড়মোড়া ভাঙছে, আমরা অতিথিশালায় পৌঁছে একটু ফ্রেস হয়ে নাশতা করতে বের হব। বাসে সারারাত জেগে থাকার কারণে প্রচণ্ড খিদেও পেয়েছে, তাই তড়িঘড়ি তৈরি হয়ে নিচে নেমে এলাম। আমাদের এই ভ্রমণে আমাদের ড্রাইভারই আমাদের গাইড, যদিও সেই অর্থে আমাদের কোনো গাইডের প্রয়োজন নেই। তবু ওই যে বলে না, ‘ঘোড়া দেখলে খোঁড়া’। যেহেতু গাড়ি এবং ড্রাইভার সারাক্ষণের সঙ্গী হিসেবে আছে তাই তাকে গাইড মেনেই যাত্রা শুরু করলাম। আমাদের অতিথিশালার খুব কাছেই বেশ কিছু স্থানীয় রেস্তোরাঁ ছিল, দেখে শুনে তার একটিতে ঢুকে পড়লাম। নাশতা করতে করতে আমরা দিনের পরিকল্পনা ঠিক করে নিলাম। যেহেতেু জাফলং এলাকাটি খুব বিস্তৃত নয়, এখানে ঘুরে-বেড়ানো বলতে পিয়াইন নদীতে নৌকাভ্রমণ আর নদীর অন্যধারে প্রায় নবীন কিছু চা-বাগান। 

গাড়ি আমাদের ঘাট পর্যন্ত পৌঁছে দিল, আমরা ঘাট থেকে একটা মাঝারি আকারের নৌকা ভাড়া করে নিলাম। এখানে নৌকাগুলো অধিকাংশই খেয়া পারাপার করে, তাই রিজার্ভ নৌকা পেতে কিছুটা বেগ পেতে হলো। যেহেতু আমাদের মূল লক্ষ্য নৌ-ভ্রমণ, যদিও আমরা চা-বাগান পর্যন্ত যাব সে ক্ষেত্রে অবশ্য নদী পার হয়ে সংগ্রামপুঞ্জী ঘাট পর্যন্ত যেতে হবে। নৌ-ভ্রমণে আরও যে-সব দৃশ্যপট চোখে পড়ে তার মধ্যে অন্যতম ডাউকি নদীর উপর ঝুলন্ত ব্রিজ। দূর থেকে দেখা এই অপরূপ দৃশ্যপটের কাছে যাওয়া বারণ। কারণ, এটি ভারতের সীমানার মধ্যে অবস্থিত। আমরা জিরো পয়েন্ট পর্যন্ত গিয়ে কিছু সময় বিরতি দিলাম। অক্টোবরের সূর্য তখন পাথরের সাম্রাজ্যে প্রবেশ করে শান্ত-শীতল পাথররাজিকে তাঁতিয়ে তুলেছে, আমরা জুতো পায়ে হেঁটে যেতেও তাপ টের পাচ্ছি। এদিকে সূর্য তখনো কিন্তু মধ্যগগণ পর্যন্ত পৌঁছুতেই পারেনি। যাহোক, অল্পকিছু সময় তপ্ত পাথরের উপর কাটিয়ে আবার নৌকায় উঠে এলাম। নৌকা থেকেই পানিতে পা ভিজিয়ে শীতলতার পরশ নিয়ে নিলাম। এরপর আমরা সংগ্রমপুঞ্জীর পথে, এ-পথেই পড়ে মায়াবী ঝরনা। কোনো এক ঘোর বর্ষায় আমি মায়াবী ঝরনার যে অপরূপ রূপ দেখেছিলাম তার যেন আর কিছুমাত্র অবশিষ্ট নেই। আসলে আমি প্রথম যখন মায়াবী ঝরনা দেখেছিলাম সেই সময় [২০১২] এর আগে আমি মায়াবী ঝরনা সম্পর্কে কিছুই জানতাম না। হঠাৎ চলতি পথে আমরা এর দেখা পেয়েছিলাম, তখন নাম না-জানা এই ঝরনার সৌন্দর্য এখনো আমার কাছে অমলিন। সেই ঘোর বর্ষার পূর্ণ যৌবনা ঝরনা এখন বাস্তবে বেশ মলিন। কিছুটা প্রকৃতির খেয়াল কতকটা আমাদের অত্যাচার। এই যেমন এখন ঝরনা প্রতিটি খাঁজে খাঁজে পর্যটকেরা এমনভাবে অবস্থান করছেন, দূর থেকে মনে হয় যেন মানুষ নয়, তার পূর্ব-পুরুষেরা ঝুলে আছে। এই অসহনীয় দৃশ্য দেখে কষ্ট না-পাওয়াটাই অস্বাভাবিক। তাই এখানে আর সময় ব্যয় করতে মন চাইল না, আমরা তখন আমাদের পরবর্তীগন্তব্য সংগ্রামপুঞ্জীর চা-বাগানের দিকে যাওয়াই শ্রেয় মনে করলাম।

ঘাটে নেমে আবার বিপত্তি, আসলে আমাদের দেশে পর্যটনশিল্প এখনো পর্যন্ত প্রাতিষ্ঠানিক রূপ না-পাওয়ায় যেটা হয় আরকি, স্থানীয় লোকজন যারা পর্যটন সম্পর্কে কোনো ধারণা না-নিয়েই শুধু মুনাফালোভী ব্যবসায়ী হয়ে পথে নামে। তাদের থেকে পর্যটকেরা স্বাভাবিকভাবেই কাক্সিক্ষত সেবা পাবে না। এটা যে শুধু তাদের দায় তা বলা যাবে না, বরং আমাদের পর্যটন করপোরশনকে এর পুরো দায়ভার নিতে হবে। এত কথা বলার কারণ, ঘাটে নেমে একটু নিশ^াস নিতে না নিতেই অটোওয়ালাদের যে-বিরক্তিকর হাঁকডাক, যা হাঁকডাকে সীমাবদ্ধ না-থেকে অনেকটা টানাহেঁচড়ায় পরিণত হয়েছে আর সাথে ভাড়া নিয়ে সিন্ডিকেটের ছল-চাতুরী, তাতে বিরক্ত না-হয়ে উপায় নেই। তাই আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম একটু রয়ে-সয়ে অটো নেব। কারণ, পথটা খুব লম্বা না-হলেও চেনা-জানার অভাব ছিল, সাথে তীব্র রৌদ্রতাপ। অটো নিতেই হলো। 

অটোতে মিনিট পনেরমতো সময় লাগলো চা-বাগানে পৌঁছুতে, হয়ত আরও কম সময়ে পৌঁছানো যেত কিন্তু পথের অবস্থা খুবই নাজুক। এই অল্প পথ অতিক্রম করতেই আমাদের হাড়গোড় মনে হলো যেন এদিক থেকে ওদিকে সরে গেছে। চা-বাগানের প্রকৃত সৌন্দর্য দেখতে হলে সকালবেলাই উত্তম। বিকেলের পড়ন্ত বেলাও মন্দ নয়, কিন্তু এই কাঠফাটা দুপুর খুবই খারাপ সময়। যেহেতু এদিকটায় আর আসা হবে না তাই একচক্কর ঘুরে যাওয়া। প্রচ- রোদ সবুজ পাতার শ্যামলিমা কেড়ে নিয়েছে, সবুজ পাতা বিবর্ণ হয়ে আমাদের চোখে ধরা দিচ্ছে। অবশ্য খালি চোখে তাকানোই দায় ছিল। অসহনীয় গরম আর প্রচণ্ড রোদে বেশি সময় বাগানে টেকা গেল না, আমরা ফিরতি পথ ধরলাম। আবার নৌকায় উঠে ছাতা মেলে দিয়ে একটু স্বস্তি, কারণ নদীতে বাতাস ছিল। এরপর সরাসরি অতিথিশালায়, যদিও দুপুরের মধ্যভাগ ইতোমধ্যে উত্তীর্ণ, পেটের ক্ষুধাও চরমে কিন্তু গোসল না করে কোনোভাবেই খাওয়া সম্ভব হবে বলে মনে হলো না।

আমরা যখন লাঞ্চ করতে নামলাম, তখন প্রায় সব রেস্তোরাঁই তাদের মধ্যাহ্ন ভোজনের আয়োজন গুটাচ্ছিল। আর কিছুক্ষণ পর হয়ত খাবার পাওয়াই যেত না। খাবার মেন্যু কী ছিল তা মনে নেই, তবে আহামরি কিছু ছিল না বলাই বাহুল্য। খেতে খেতে বেলা চারটা অতিক্রম করে গেল, এরপর আমরা কাছেপিঠে এদিক-ওদিক ঘুরে বেড়ালাম। তামাবিল জিরো পয়েন্টে নেমে সীমান্তঘেঁষে বাংলাদেশ পয়েন্টের শেষ স্তম্ভ পর্যন্ত যেয়ে ফিরে আবার গাড়িতে উঠলাম। এবার গন্তব্য মেঘালয় পাহাড়ের গাঘেঁষে গড়ে ওঠা জইন্তা হিল রিসোর্ট। এখানে যাওয়ার পেছনে অবশ্য একটি কারণ আছে, বছর আটেক আগে এক বর্ষায় এখানে এসে ছিলাম তখন এটি বেশ প্রণবন্ত একটি রিসোর্ট ছিল। রিসোর্টের রুমের বরারান্দা থেকে দেখা মিলত মেঘালয়ের গা-বেয়ে নেমে যাওয়া রুপালি ঝরনার ঝলক আর শোনা যেত মৃদু ছন্দ। আজ এই সময়ে এটি যেন কোন এক অতীত। সেই জমজমাট আমেজ আজ কেবলই স্মৃতি, দেখে মনটা খারাপ হয়ে গেল। বেশ একটা স্মরণীয় সময় সেখানে কাটিয়েছিলাম। যদিও করোনার করাল থাবা থেকে পৃথিবী তখনও পুরোপুরি মুক্ত নয় ; তবু এই ধ্বংসপ্রায় স্থাপনা দেখে মনে হলো এর জন্য প্রকৃতি যতটা না দায়ী তার থেকে বেশি ছিল অযত্ন। 

সন্ধ্যা শেষ করে রাত্রির মুখোমুখি আমরা অতিথিশালায় ফিরে আসি। এই রেস্ট হাউজ নিয়ে কিছু কথা না-বললেই নয়। এর অবস্থান প্রায় পিয়াইন নদীর তীরঘেঁষে। এটি খুব সম্প্রতি না-হলেও এর বয়স বেশি নয়। বিজন ভূমিতে একমাত্র রেস্ট হাউজ, যার মালিক বাংলাদেশ রোডস অ্যান্ড হাইওয়ে। আমরা ছাড়া তৃতীয় ব্যক্তি হচ্ছে এই রেস্ট হাউজের কেয়ার টেকার। দিনে নদীতীরবর্তী দোকানগুলোর ব্যস্ততায় পুরো এলাকাটি কোলাহলেমুখর থাকলেও রাতে দু’একটি খাবারের দোকান ছাড়া পুরো চরাচর নিস্তবদ্ধ। যেন জনবিচ্ছিন্ন বিজন কোনো দ্বীপ। নির্জন কোলাহলমুক্ত সময় শুধু ঝিঁঝি পোকা আর নাম না জানা রাতপাখির ডাক ছাড়া আর কোনো শব্দ নেই। কিছুটা ভূতুড়ে-অতিপ্রাকৃত ; রাতের এই নির্জনতা সত্যিই উপভোগ্য। তবে, এর জন্য অন্তরে সাহস থাকা জরুরি। কেননা, এই নির্জনে দু’জন নারী কেন, দুইয়ের অধিকও অনেক ক্ষেত্রে থাকতে সাহস করবে না। আমরা অবশ্য সময়টাকে বেশ উপভোগ করেছি। রাত্রির এই অপার্থিব নির্জন সময় আমার ভ্রমণ-অভিজ্ঞতার ঝুলিতে পরম সঞ্চয়।

পরদিন সকাল সকাল তৈরি হয়ে ব্যাগ-পত্তর নিয়ে বের হলাম। পথেই কোথাও নাশতাটা সেরে নেব, এমনই পরিকল্পনা। প্রথমে আমরা লালাখাল যাব, এরপর সিলেট। লালাখালে আগে যাওয়া হয়নি বলে পথ ভুল করলাম, আসলে ভুলও বলা যায় না। এখানে দুটি পয়েন্ট থেকে নৌকা ভাড়া পাওয়া যায়, হয়ত পর্যটক কম থাকায় একটি পয়েন্ট এখন বন্ধ। তাই আমাদের আবার পিছিয়ে যেতে হলো। গ্রামের মেঠোপথে ধুলো উড়িয়ে আমরা লালাখালের পাশে পৌঁছে গেলাম, মূল সড়ক থেকে এই পর্যন্ত আসতে প্রায় মিনিট ৪০-এর মতো লাগল। লালাখাল ঘাটে এসে চমৎকৃত হলাম নাজিমগড় রিসোেের্টর নতুন একটি শাখা দেখে। যারা নির্জনতাকে খুব আপন করে উপভোগ করতে চান, তাদের জন্য এটি একটি চমৎকার আয়োজন।

এসময় পর্যটকের আনাগোনা কম থাকায় লালাখালে নৌকার মাঝিরা অনেকটা অলস দিন পার করছে। ঘাটে বেশ কিছু নৌকা বাঁধা কিন্তু মাঝিদের দেখা নেই। আমরা এদিক-সেদিক খোঁজ করে দু’জনের সন্ধান পেলাম, এরা নিজেদের মধ্যে কথা বলে ঠিক করে নিলো কার নৌকা যাবে। আমরা ড্রাইভারকে ঘাটে রেখে নৌকায় উঠে বসলাম। পুরো খালে এই একটি মাত্র নৌকা ঘাট ছেড়ে গেল, প্রথমে একটু টেনশন কাজ করছিল কিন্তু প্রকৃতির অপার সৌন্দর্যের মোহে পড়ে সব ভুলে গেলাম। আমাদের নৌকার মাঝি কিশোর বয়সী একটি ছেলে, চলতে চলতে তার সাথে কথা হচ্ছিল। করোনার সময়ে তাদের জীবন-জীবিকা কেমন ছিল তা নিয়েও আলাপ হচ্ছিল। সে আমাদের বিভিন্ন জায়গা সম্পর্কে ধারণা দিচ্ছিল। আমরা থেমেছিলাম একদম জিরো পয়েন্টে গিয়ে। সে জায়গাটার সৌন্দর্য ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব নয়। মনে হলো যদি আরও কিছুটা এগিয়ে যেতে পারতাম কিন্তু, বৈশি^ক সীমানার অদৃশ্য কাঁটাতারে আটকে গেলাম। নৌকা থেকে পা ডুবিয়ে দেখছিলাম নীল পাহাড়ও যেন সবুজ পানিতে পা ডুবিয়ে আছে। পাহাড়েরর গাঘেঁষে পেজাতুলা মেঘাবৃত শুভ্র সাদা আকাশ, সেও যেন জলে নেমে নাইতে চাইছে কিন্তু পাহাড় তার পথ আগলে আছে। সব মিলিয়ে অপার্থিব এক সৌন্দর্য। ছেড়ে আসতে মন চাইছিল না কিন্তু ফিরতে যে হবেই।