মানিকগঞ্জ জেলার শিবালয় উপজেলায় যমুনা নদীর তীরে তেওতা জমিদারবাড়ি অবস্থিত। মানিকগঞ্জের প্রভাবশালী দাশগুপ্ত পরিবারের সন্তান পঞ্চানন দাশগুপ্ত আঠারো শতকের মাঝামাঝি সময়ে মানিকগঞ্জের শিবালয় উপজেলার তেওতা গ্রামে জমিদারদারি শুরু করেন। জনশ্রুতি রয়েছে বাল্যকালে এলাকার মানুষ তাকে আদর করে পাচুসেন বলে ডাকত। তাঁর প্রকৃত নাম পঞ্চানন দাশগুপ্ত। পঞ্চানন দাশগুপ্ত বাল্যকালে পিতাকে হারিয়ে অর্থকষ্টে পড়েন। ভাগ্য ফেরাতে তিনি দিনাজপুরে গিয়ে বর্গা জমিতে তামাক চাষ করে বিড়ি ব্যবসায়ীদের নিকট বিক্রি করতেন। তামাকের ব্যবসা করে কয়েক বছরের মধ্যে তিনি অনেক অর্থসম্পদের মালিক হয়ে যান। এরপর তিনি দিনাজপুর থেকে নিজ এলাকা মানিকগঞ্জের শিবালয়ে ফিরে এসে অনেক জমি ও সম্পত্তি ক্রয় করেন।
পঞ্চানন দাশগুপ্ত উনিশ শতকের প্রথমভাগে ইংরেজ শাসকদের কাছ থেকে মানিকগঞ্জের শিবালয় এলাকার জমিদারি লাভ করেন। এরপর তিনি দিনাজপুর জেলার খানসামা উপজেলার আগলঝাড়ি ইউনিয়নের জয়গঞ্জ এলাকার জমিদারি কিনে নেন। জমিদারির দায়িত্ব পাওয়ার পরই ইংরেজ নীলকরদের কাছ থেকে শিবালয়ের তেওতা গ্রামের পরিত্যক্ত নীলকুঠিটি কিনে নিয়ে সংস্কার করে তিনি সপরিবারে বসবাস করতে শুরু করেন। নির্মাণরীতি দেখে বোঝা যায় কুঠিবাড়ির অট্টালিকাটি মোঘল শাসনামলের শেষদিকে নির্মাণ করা হয়েছিল। পরবর্তীসময়ে ইংরেজরা অট্টালিকাটিকে নীলকুঠি হিসেবে ব্যবহার করতে শুরু করে। অট্টালিকাটির নিচের তলায় চারটি কক্ষ রয়েছে। এর একটি কক্ষে লক্ষ্মীপূজা হতো। ভবনটির দোতলার দু’টি আয়তকার বড়ো কক্ষ ও সংলগ্ন বারান্দা রয়েছে। দোতলার কক্ষ দু’টির দেয়াল ও মেঝেতে সিরামিকের কাজ লক্ষ্য করা যায়। অন্দরমহলটিতে রান্নাঘর, পূজার ঘর, বৈঠকখানা ও একাধিক শয়ন কক্ষ রয়েছে। এই অট্টালিকার নিচতলায় একটি ভূগর্ভস্থ কক্ষও রয়েছে। ধারণা করা হয়, বিপদের সময়ে আত্মরক্ষা অথবা ধনরত্ন লুকানোর জন্য ভূগর্ভস্থ কক্ষটি নির্মাণ করা হয়েছিল। অট্টালিকাটি জমিদার বাড়ির অন্দরমহল হিসেবে পরিচিত।

জমিদারি লাভের কিছুদিন পর বাড়িটির অন্দরমহলের পশ্চিম পাশে লাগোয়া আরো একটি আয়তাকার অট্টালিকাটি নির্মাণ করা হয়। ভবনটি বহির্মহল হিসেবে পরিচিত। আয়তাকার দো’তলা বহির্মহলের পশ্চিম দিকে এর প্রধান ফটক। এই ফটক দিয়ে প্রবেশ করে বাঁ’দিকে তাকালেই এখনো চোখে পড়বে শ্রীধর মন্দির। অনেকেই মন্দিরটিকে নাটমন্দির বলে জানেন। মন্দিরটিতে দুর্গাপূজাসহ অন্যান্য পূজা, যাত্রাপালা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হতো। ভবনের উত্তর দিকে একতলায় মালখানা ছিল। মালখানার পাশের কক্ষগুলোতে জমিদারির দাপ্তরিক কাজ হতো। ভবনটির পশ্চিম দিকের নিচতলার দক্ষিণ পাশের বড়ো কক্ষটি ছিল পাঠাগার। দোতলায় ছিল একাধিক শয়নকক্ষ ও বৈঠকখানা।
পঞ্চানন দাশগুপ্তের জমিদারির প্রসার ঘটলে দাপ্তরিক কাজ ও অন্যান্য প্রয়োজনে জমিদার বাড়ির উত্তর পাশে আরও একটি অট্টালিকা নির্মাণ করেন। এই অট্টালিকার পূর্বপাশে একতলাবিশিষ্ট ভবনের কক্ষগুলোতে দাপ্তরিক কাজ হতো। উত্তর দিকে ছিল দুর্গামন্দির এবং দক্ষিণ দিকে দোতলা ভবন। দোতলা ভবনের নিচতলার দু’টি কক্ষ তোষাখানা হিসেবে ব্যবহৃত হতো। তোষাখানার ঠিক উপরে দু’টি শয়নকক্ষ ছিল। কক্ষ দু’টির বারান্দা থেকে দুর্গাপূজা ও অনুষ্ঠান দেখার ব্যবস্থা ছিল। দোতলার বারান্দার ছাদটি সে-সময়ে টালি ইটের নকশা ছিল। টালি ইট খসে পড়লে পরবর্তীসময়ে ঢেউটিন লাগানো হয়। পশ্চিম পাশের নিচতলায় দরজার দক্ষিণ পাশে বন্দিশালা ও উত্তর পাশে বাঘের খাঁচা ছিল। খাজনা পরিশোধে অপারগদের এখানে বন্দি রেখে ভয় দেখানো হতো।
জমিদার পঞ্চানন দাশগুপ্তের পরবর্তী বংশধর হেমশংকর বাড়িটির উত্তর পূর্বাংশে আরো একটি অট্টালিকা নির্মাণ করেন। অট্টালিকাটির তিনদিকে দোতলা ভবন এবং একদিকে খোলা। দোতলা ভবনে একাধিক শয়নকক্ষ, অতিথিকক্ষ, পারিবারিক বৈঠকখানা, মালখানা ও সংযুক্ত শৌচাগার রয়েছে। এই অংশটিও অন্দরমহল হিসেবে ব্যবহৃত হতো।
জমিদার বাড়িটি নির্মাণের সময়ে পশ্চিম পাশে একটি দিঘি খনন করা হয়। পারিবারিক দেবতার সন্তুষ্টির জন্য দিঘি ও বাড়ির মাঝখানে ১৮৫৮ খ্রিষ্টাব্দে একটি সুউচ্চ নবরত্ন মঠ নির্মাণ করা হয়। ২৫০০ বর্গফুটের বর্গাকৃত প্লাটফর্মের উপর নির্মিত নবরত্ন মঠটির উচ্চতা ৭৫ ফুট। ১৮৯৭ খ্রিষ্টাব্দের ভয়াবহ ভূমিকম্পে নবরত্ন মঠটি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ১৯০৬ খ্রিষ্টাব্দে নবরত্ন মঠটি সংস্কার করা হয়। মঠটিকে অনেকেই দোলমঞ্চ বলে থাকেন।
তেওতা জমিদারবাড়ির দক্ষিণ-পশ্চিম কোণে টালি ইট ও কাঠ দিয়ে নির্মিত একটি আটচালা দোতলা ভবন রয়েছে। ভবনটি পঞ্চানন দাশগুপ্তের তৃতীয় পুরুষ জয়শংকর দাশগুপ্ত নির্মাণ করেন। ভবনটি জয়শংকর এস্টেটের প্রধান কার্যালয় হিসেবে ব্যবহৃত হতো।
পঞ্চানন দাশগুপ্তের মৃত্যুর পর উত্তরসূরিদের মধ্যে তেওতা জমিদারবাড়িটি ভাগ হয়ে যায়। বাড়িটির দক্ষিণ অংশের ভবনগুলো পঞ্চানন দাশগুপ্তের ৩য় বংশধর জয়শংকর এস্টেট নামে পরিচিত।
জমিদারবাড়িটির দক্ষিণ পশ্চিমাংশে টালি দিয়ে নির্মিত আটচালা দোতলা ভবনটিসহ তিনটি ভবন জয়শংকর এস্টেটের অন্তর্ভুক্ত ছিল।

তেওতা জমিদারবাড়ির উত্তরাংশের বাকি তিনটি ভবন পঞ্চানন দাশগুপ্তের পঞ্চম পুরুষ হেমশংকর এস্টেট নামে পরিচিত।
পঞ্চানন দাশগুপ্ত ও তাঁর পরবর্তী বংশধরেরা মানিকগঞ্জের শিবালয় ছাড়াও ফরিদপুর, রাজবাড়ি, পাবনা, রংপুর, দিনাজপুর ও রাজশাহী জেলার অনেক এলাকায় জমিদারি বিস্তৃত করেছিলেন।
৭.৩৮ একর জমির উপর নির্মিত তেওতা জমিদারবাড়ির নীলকুঠি ভবনটি মোঘল স্থাপত্যরীতি লক্ষ্য করা যায়। এছাড়াও পরবর্তীসময়ে নির্মিত আটচালা ভবনটি দেশীয় রীতিতে নির্মাণ করা হয়েছে। এ-দু’টি ভবন ছাড়া বাকি চারটি ভবন ইন্দো-ইউরোপীয় রীতি লক্ষ্য করা যায়। সবক’টি ভবনেই নির্মাণ উপকরণ হিসেবে ইট, চুন, কাঠ, লালমাটি ও সুরকি ব্যবহার করা হয়েছে।
মানিকগঞ্জের তেওতা জমিদারবাড়িটি জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম ও তাঁর প্রিয়তমা স্ত্রী প্রমীলা দেবীর স্মৃতি বিজড়িত স্থান হিসেবে গণ্য করা হয়। তেওতা জমিদারবাড়িতেই কবির সাথে প্রমীলা দেবীর প্রথম দেখা হয়। প্রমীলা দেবীর পিতা বসন্ত সেনের ভাইয়ের ছেলে ধীরেন সেনের সাথে কবি কাজী নজরুল ইসলামের পরিচয় ছিল। সেই পরিচয়সূত্রে কবি মাঝে মধ্যেই মানিকগঞ্জের তেওতা জমিদার বাড়িতে আসতেন। জমিদার বাড়ির দিঘির পাড়ে বসে কবি প্রমীলা দেবীর উদ্দেশে রচনা করেন কালজয়ী গীতিকাব্য -
“তুমি সুন্দর তাই চেয়ে থাকি প্রিয়,
সেকি মোর অপরাধ।”
কবি নজরুল ইসলাম ও প্রমীলা দেবীর স্মৃতি রক্ষার্থে প্রত্মতত্ত্ব অধিদপ্তর জমিদার বাড়ির আঙিনায় একটি স্মৃতিপাঠাগার এবং দিঘির পাড়ে একটি স্মৃতিফলক স্থাপন করা হলেও যমুনা নদীর তীরের এই প্রাচীন জমিদার বাড়িটি অযতেœ জরাজীর্ণ হয়ে নাটম-লসহ কয়েকটি ভবনের ছাদ ও দেয়াল ইতোমধ্যে ধসে পড়েছে।
মানিকগঞ্জ জেলার তেওতা জমিদার বাড়িটি দেশের একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রত্মতাত্ত্বিক নিদর্শন।
লেখক : গবেষক, লেখক ও টেলিভিশন অনুষ্ঠান নির্মাতা