[পূর্ব প্রকাশিতের পর]
আমরা একরকম উদ্দেশ্যহীনভাবেই পথ চলছি- কোথাও থামার ইচ্ছে হলে থামছি, ছবি তুলছি। এই উদ্দেশ্যহীন পথেই মাঝেমাঝে চমৎকার সব স্থান ও স্থাপনার সাথে দেখা হয়ে যাচ্ছে। এই যেমন চলতি পথেই আমরা জার্জিম দ্য সেরকা দ্য গ্রাসা নামক একটি জায়গায় চলে এলাম, এটি মূলত একটি উন্মুক্ত বাগান যেখানে রয়েছে চমৎকার পায়ে চলার পথ সাথে নাম না জানা সবুজের সমারোহ, রয়েছে ছোটোদের জন্য নানারকম খেলার আয়োজন, এছাড়াও বসে কফি ও ¯েœকস্ এর সাথে আড্ডা দেওয়ার ব্যবস্থাও রয়েছে এখানে। নরওয়ের সাথে বিশেষ করে বার্গেন শহরের সাথে লিসবনের একটি মৌলিক পাথর্ক্য হলো এখানে আমাদের দেশের মতোই খাবার দোকান রয়েছে ছড়িয়ে ছিটিয়ে, যেখানে বার্গেনে মাইলের পর মাইল হেঁটেও কোনো চা বা কফি শপের দেখা মিলত না।
আজ ক্রিসমাস, পুরো লিসবন আলোয় আলোকিত। আলো ঝলমলে রাত্রিতে পায়ে হেঁটে নগর প্রদক্ষিণ একটি চমৎকার অভিজ্ঞতা। এ সময়টাতে ইউরোপের প্রায় সকল শহরে ক্রিসমাস ট্রি ডেকোরেশনের একটি রেওয়াজ আছে, সম্ভবত এখানে কোনো নীরব প্রতিযোগিতাও থাকে, কোন শহরের ক্রিসমাস ট্রি কত সুন্দর বা বড়ো হয়। আমরা অলিগলি ছেড়ে এখন রাজপথে, তবে এখনো পদব্রজেই আছি, পথ থেকে পথে চলতে চলতে আমরা এখন শহরের কেন্দ্র, জায়গাটির নাম প্রাকা দো কমেরসিও অর্থাৎ শহরের বাণিজ্যিক স্কয়ারে। প্রাকা দো কমেরসিও তাগস নদীর খুব কাছে। কেননা, প্রাচ্য থেকে পাশ্চাত্য সব জায়গায়ই কিন্তু বাণিজ্যক কেন্দ্রগুলো নদী বা সাগর তীরঘেঁষে গড়ে ওঠে। এর মূল কারণ উন্মুক্ত পানিপথ। প্রাকা দো কমেরসিও-এর ক্রিসমাস ট্রি-টা সত্যিই অসাধারণ। এখন সবে রাত্রি সন্ধ্যা পেরিয়েছে, ক্রিসমাসের এই সময়ে রাতের সাথে অনুষ্ঠানের জাঁকজমকতা বাড়তে থাকে। কেননা, রাতে আলোয় সজ্জিত নগরী তার অবয়ব থেকে প্রচীন মলিনতাকে ঢেকে রাখতে বেশি পারদর্শী।
তরুণী রাত্রিতেই আমরা ডিনার সেরে নিলাম, না তখন আর ভাত খাওয়ার জন্য উল্টো পথে মুরিয়ায় না গিয়ে পথে পড়ে এমন একটি রেস্টুরেন্টই বেছে নিয়েছিলাম। তবে, অবশ্যই তা বাঙালি রেস্টুরেন্ট। অনেকটা আমাদের দেশের ফুটকোর্টের দোকানগুলোর মতো, যেখানে চায়নিজ থেকে শুরু করে বাঙালি, ইন্ডিয়ান সকল ধরনের খাবারই পাওয়া যায়। যেহেতু দুপুরের খাবার খেতে খেতে প্রায় সন্ধে হয়ে গিয়েছিল তাই আর ভারি কোনো মেন্যুতে গেলাম না, শর্মা আর ড্রিংস দিয়েই রাতের খাবার সেরে নিলাম। এই রেসটুরেন্টের সবাই বাংলাদেশি। খেতে খেতে তাদের চালচ্চিত্রের খবর নিচ্ছিলাম। যে বিষয়টা অবাক করার মতো এখানে খাবারের দোকানগুলোতে যারা কাজ করছে তাদের অধিকাংশই ইংল্যান্ড থেকে গ্রাজুয়েশন করা। এখানে এসে কাজ করার কারণ জানতে চাইলে তারা জানায় যে, এরা আবার ইংল্যান্ডে ফিরে যাবে, তাদের মূল লক্ষ্য সেখানে সেটেল্ড হওয়া। ইংল্যান্ডে সরাসরি সেটেল্ড হওয়া কিছুটা কঠিন কিন্তু ইউরোপের অন্য কোনো দেশে কিছুদিন থাকা বা কাজ করার অভিজ্ঞতা থাকলে পরবর্তীসময়ে ইংল্যান্ডে পিআর (পারমানেন্ট রেসিডেন্ট) পাওয়া সহজ হয়। তাই ইংল্যান্ডে স্টুডেন্টশিপ শেষ হওয়ার পরে অনেকেই পর্তুগালে চলে আসে। আসলে শুরু থেকেই এই বিষয়টা আমাকে ভাবাচ্ছিল, যেমন রোমে প্রচুর বাংলাদেশি আছে, যাদের অধিকাংশই পেশায় হকার বা ওয়েটার এবং কথাবার্তায় বোঝা যায় যে, তাদের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা খুব একটা এগোয়নি, যাদের আদতে আমরা অদক্ষ শ্রমিক বলে থাকি। কিন্তু লিসবনে যারা বিভিন্ন শপ বা রেস্তোরাঁয় কাজ করে তাদের সাথে কথা বললেই বোঝা যায় তারা প্রাতিষ্ঠানিকভাবে শিক্ষিত, পেছনের কারণটা জানার একটা ইচ্ছে ছিল অবশেষে জানাও হলো।

আবার পথে নামলাম এবার অবশ্য একটা লক্ষ্য আছে, আমার অস্থায়ী আবাসে। রাত বাড়ছে ফিরতে তো হবেই- তবে, আবারও সেই একইভাবে, চলতি পথে নতুন কিছু দেখে অথবা এমনিতেই ইচ্ছে হলেই থামছি। যা বলছিলাম পথেই একটি মেলা পড়ে গেল জায়গাটা বেশ উঁচুতে যেখান থেকে ঝলমলে শহরের একটি অংশ চোখে পড়ে। মেলা চরিত্রও ঠিক আমাদের দেশীয় মেলার মতো হস্তশিল্পের প্রধান্য, যদিও হরেকরকম পণ্যেও সমারোহ নেই। তবে, যা আছে সেগুলো পর্তুগালের ঐতিহ্যকে তুলে ধরছে। এখান থেকে অবশ্য কিছু কেনার সাহস করিনি, দাম দেখে ছোঁয়ারই সাহস হয়নি, কেনা তো দূরে থাক ! তবে ঘুরে বেড়াতে ভালো লাগছিল নিঃসন্দেহে।
হোটেলে ফিরতে ফিরতে রাত প্রায় ১১.৩০টা। সারাদিনের ঘোরঘুরিতে বেশ ক্লান্ত ছিলাম তাই আর রাত না করে ফ্রেস হয়ে শুয়ে পরলাম। অবশ্য করার মতো কোনো কাজও ছিল না। পরদিন একটু বেলা করে ঘুম ভাঙলো। কিচেনে চা করে স্কাইলাইটের নিচে বসে এককাপ চা পান করে একদম তল্পিতল্পাসহ বেরিয়ে পড়লাম। কারণ, আমার চেক আউটের সময় বেলা ১১টা। এর মধ্যে দেলোয়ারকে ফোন দিলাম, কিন্তু সংযোগ পেলাম না, সম্ভবত নেটওয়ার্কজনিত জটিলতা। পথে নেমে প্রথমেই সেই মুদি দোকানে গেলাম যেখানে প্রথম গিয়েছিলাম। আমার ফ্লাইট বিকেল চারটায় আর বাকি সময়টা আমি লিসবনের পথে ঘুরেফিরে কাটাবো তাই ল্যাগেজটা কোথাও রাখতে হবে। আগের রাতেই রুমে ফেরার পথে দোকানি ভদ্রলোকের সাথে কথা বলে গিয়েছিলাম, তাই ল্যাগেজটা রাখতে এলাম। ভদ্রলোক চা অফার করলেন, কিন্তু যেহেতু আমি চা পান করে বের হলাম তাই আর চা খেলাম না। তবে, কিছুটা সময় তার সাথে গল্প করলাম তিনি তার নিজের কথা পরিবারের কথা, দেশের কথা বললেন। তিনি আমার ভিজিটিং কার্ড নিলেন, দেশে এলে যোগাযোগ করবেন। আমি তার দোকান থেকে টুকটাক কেনাকাটা করে সেগুলো আবার ল্যাগেজে ভরে বেরিয়ে এলাম।
প্রথমেই মুরিয়ায় চলে গেলাম, নাশতা করবো বলে। আগেই বালেছি মুরিয়া এলাকাটা আমার কাছে ঢাকার নীলক্ষেতের মতো মনে হয়েছে। আগের দিন যে রেস্তোরাঁতে লাঞ্চ করেছিলাম সেখানেই সকালের নাস্তা সেরে নিলাম। রেস্তোরাঁ থেকে বেরিয়েই উল্টো দিকে ফোন-ফ্যাক্সের দোকান, সেখানে গিয়ে খোঁজ নিলাম প্রিন্ট করা যাবে কি না। আমার এয়ার টিকেটটি প্রিন্ট করা দরকার ছিল। দোকানে কাস্টমারের সংখ্যা নেহায়েত কম না, আমাকে কিছুটা সময় অপেক্ষা করতে হলো প্রিন্ট নিতে। প্রতি পেজ প্রিন্ট করতে বাংলাদেশি টাকায় ত্রিশ টাকা। আমরা যারা পেজ প্রতি পাঁচ টাকায় প্রিন্ট করে অভ্যস্ত তাদের জন্য এটা হার্টব্রেকিং। যাহোক, কাজ সেরে আমার বিশ^স্ত পথবন্ধু ঠরংরঃ অ ঈরঃু আ্যাপের সহযোগিতায় জেনে নিলাম কাছাকাছি কোনো পর্যটন স্পট আছে কি না। আমি এরপর শহরের সিটি সেন্টারে গেলাম, সেখান থেকে পুরোনো ট্রামে করে শহরের প্রচীন অংশটি ঘুরে এলাম। এর আগে যেমন বলেছি, অনেকটা আমাদের পুরোনো ঢাকার আদল- যার কিছু অংশ আগের দিন পায়ে হেঁটে ঘুরেছি এখন পুরোটাই ঘোরা হলো। আর পুরোনো আমলের এই বিশেষ পর্যটন-ট্রামে চড়ার অভিজ্ঞতাও হলো। সেখান থেকে যে জায়গাটায় গেলাম তার নাম মার্টিম মোনতাজ স্কয়ার, মার্টিন মোনতাজ একজন পর্তুগীজ বীর ও নাইট ছিলেন, তার স্মরণে এখানে একটি গেট আছে- মূলত এটি তার বীরত্ব গাঁথার স্মরক। পরে এই গেটটি ঘিরে গড়ে ওঠে মার্টিন মোনতাজ স্কয়ার। এটি একটি পর্যটন স্পট আর ক্রিসমাস উপলক্ষে এখানে মেলা/এক্সিবিশন চলছে। এখানে কিছুটা সময় ঘোরাঘুরি করে ভাবলাম একটি টমটম নিয়ে তাগস নদীর ধারে যাব অথবা শহরটা ঘুরব, ঘণ্টাদুয়েক সময়ে যতটা ঘোরা যায়। কিন্তু টমটমওয়ালাদের সাথে কথা বলে হিসাব মেলেনি, এখানকার অধিকাংশ টমটমওয়ালা বাংলাদেশি, বলাবাহুল্য এদের স্বভাব-আচেরণ বাংলাদেশি অটোওয়ালাদের মতো, যা সত্যিই দুঃখজনক। দু-একজনের সাথে কথা বলে বিরক্ত হয়ে পায়ে হেঁটেই রওনা হলাম। আগেই বলেছি, লিসবন শহরের এই অংশটি অর্থাৎ তাগস নদীর দক্ষিণ তীরে লিসবনের যে বিস্তৃতি তা খুব বড়ো নয়, চাইলে পায়ে হেঁটেই পুরো শহর ঘোরা যায়। যাহোক, মিনিট ১৫-২০-এর মধ্যেই আমি নদীর তীরে পৌঁছে গেলাম। গতরাতে একবার এদিকটা ঘুরে গিয়েছি। তবে, বেশিদূর যাওয়া হয়নি, তাই এখন যতদূর সম্ভব যাওয়ার ইচ্ছে আছে- অবশ্যই তা নির্ধারিত সময়ের মধ্যে। কারণ, আমাকে আজই প্যারিসে ফিরতে হবে। হ [চলবে]