ইউরোপের ১৫০ দিন : সৈয়দা তাসলিমা আক্তার

22 Dec 2024, 02:19 PM ভ্রমন শেয়ার:
ইউরোপের ১৫০ দিন : সৈয়দা তাসলিমা আক্তার


[পূর্ব প্রকাশিতের পর]


কাতালেনিয়ার এই প্রাসাদটির নাম আমার জানা নেই। আমি প্রথমেই প্রাসাদের ছাদে চলে গেলাম, বিস্তৃত ছাদ থেকে বিশাল ভূ-মধ্যসাগরের একাংশ চোখে পড়ে। সমুদ্র যেন এখানে কাছে থেকেও অনেক দূরে। কারণ, শহরের এই অংশ সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে বেশ উপরে। ছাদে ঘুরতে ঘুরেত ছেলেবেলায় চলে গেলাম, এখানে ছাদের আনাচে-কানাচে অনেক জানা-অজানা গাছের ছড়াছড়ি। ছোটোবেলায় যখন পাড়াময় ঘুরে বেড়াতাম তখন আমি কোথাও কোনো সুন্দর গাছের চারা পেলে তুলে নিয়ে বাড়ির বাগানে লাগিয়ে দিতাম। এখানে এমন অনেক চারাগাছ ছিল মনে হলো যেন এগুলোর সাথে আমি পরিচিত, এই মিষ্টি শীতের সকালও আমার বেশ চেনা। সুন্দর এই সময়কে ধরে রাখতে বেশ কিছু ছবি তুলে নিলাম, ছবি তুলতে গিয়ে খুব সমস্যা হচ্ছিল। কেননা, আমি একা ছিলাম। আমার ছবি তুলে দেওয়ার জন্য কেউ ছিল না। তখন একটা সেলফি স্টিকের অভাব বোধ করছিলাম। কী আর করা ! সেলফি স্টিক সাথে ছিল না।

ছাদে ঘোরাঘুরি সেরে নিচে নেমে এলাম যেখানে মূল প্রাসাদের প্রবেশদ্বার। গেট দিয়ে ঢুকে বেশ খানিকটা পথ পেরিয়ে লম্বা করিডোর যার এক কোণে অভ্যর্থনা ডেস্ক, কাছে যাওয়ার পর বুঝতে পারি এটি আসলে টিকেট কাউন্টার, তার মানে প্রাসাদের ভেতরে ঢুুকতে টিকেট লাগবে, যা এখান থেকে নিতে হবে। বয়সভেদে দুই ধরনের টিকেট রয়েছে, তিন উইরো আর পাঁচ ইউরো। ত্রিশ বছর পর্যন্ত দর্শনার্থীদের জন্য তিন ইউরো আর যাদের বয়স ত্রিশ উর্ধ্ব তাদের জন্য পাঁচ ইউরো। আমি পাঁচ ইউরোর একটি টিকেট চাওয়াতে কাউন্টরের স্বর্ণকেশী অবাক বিষ্ময়ে বলল, ‘তুমি নিশ্চিত তোমার জন্য পাঁচ ইউরো টিকেট নেবে, তিন ইউরো না ?’ তার প্রশ্নে প্রথমে অবাক হলেও পরে ঠিকই বেশ ভালো অনুভব হলো।

প্রাসদের ভেতরটা আমার কাছে বেশ গতানুগতিক লেগেছে ; যা হয় আরকি, পুরানো প্রাসাদ সেই সময়ের আসবাবপত্র আর তৈজস দিয়ে সাজোনো অনেকটা মিউজিয়ামের আদলে। পুরানো প্রাসাদের স্থাপত্য শৈলী আমাকে যতটা আকৃষ্ট করে, পুরানো তৈজস বা আসবাবপত্র আমাকে ততটা টানে না। যা হোক, পয়সা খরচ করে যেহেতু ঢুকলামই একটু অন্তত ঘুরে যাই। প্রাসাদটি দোতলা নিচ তলা ঘুরে দেখে সরু সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠে গেলাম। এখানে এসে মনটা খুব ভালো হয়ে গেলে সমুদ্রঘেঁসে খোলা অলিন্দ, মনে হলো অনন্তকাল এখানে কাটিয়ে দেওয়া যাবে। তবে, আমার তো আর এখানে অনন্তকাল থাকার জো নেই। তাই আবার চলতে শুরু করলাম। দোতলায় একাধিক বারান্দা, সবগুলোই বিশাল, কোনো একটি থেকে প্রাসাদের বাগানের পুরোটাই দেখা যায় আবার কোনো একটি যেন অন্দরমহলের আন্তঃপুর বাসিন্দাদের জন্য তৈরি যেখানটায় নিরিবিলি সময় কাটানোর ফুসরত রয়েছে। আসলে রাজা-রাজরাদের ব্যাপার-স্যাপারই আলাদা।

প্রাসাদ পরিভ্রমণ শেষে আবার খোলা চত্বরে ফিরে এলাম। এখান থেকে সমুদ্র অনেকটা কাছে মনে হচ্ছিল। এই চত্বরের বিভিন্ন স্থানে পাটি পেতে বিভিন্ন জিনিসের পসরা সাজিয়ে বিক্রেতারা ক্রেতার দৃষ্টি আকষণের চেষ্টা করছে। না খুব শব্দ করে বা চেঁচিয়ে ডাকছে না ঠিকই, কিন্তু বিনয়ের সাথে পণ্য কেনার অনুরোধ করছে। বিক্রেতাদের দৈহিক আকৃতি দেখে তাদের অধিকাংশই যে এশিয়ান এটা সহজেই অনুমান করা যায়। এখানে একজন পাকিস্তানি বিক্রেতার কাছ থেকে একটি সেলফি স্টিক কিনে নিলাম। এতক্ষণ ধরে একটি সেলফি স্টিকের খুব অভাব অনুভূব করছিলাম। সেলফি স্টিক কেনার পর নিজেকে একটু স্বাবলম্বী লাগছে। চমৎকার সাজানো-গোছানো প্রাসাদ চত্বরের একধারে একটি জলাশয় যেটাকে গল্পের পদ্মপুকুর বলে মনে হয়। যেখানে পরীরা জলকেলী করছে। পদ্মপুকুর ঘিরে রয়েছে বসার ব্যবস্থা, পুকুরের পাড়ঘেঁসে স্বেতশুভ্র পাথরÑ পুরো দৃশ্যপটকে রূপকথার রাজ্যে পরিণত করেছে। মূল জলাশয়ের আশেপাশে আরো কিছু জলাশয় চোখে পড়ে। হয়ত সবক’টি জলাশয় মিলে কোনো একটা প্যাটার্ন তৈরি করা হয়েছে যা আমার জানা বা বোঝার বাইরে। তবে, টলটলে পানিতে পা ভেজানোর ইচ্ছেটাকে দমন করতেই হলো। কেননা, খুব সুন্দর করে নির্দেশনা বোর্ডে লিখা আছে, এটা নিষেধ। আসলে পর্যটনকে শিল্পের পর্যায়ে নিতে হলে অবশ্যই কিছু সুনির্দিষ্ট বিধি-নিষেধ মেনে চলতে হবে। ইউরোপের বিভিন্ন জায়গায় ঘুরতে গিয়ে প্রায় সবখানে এ ধরনের বিধি-নিষেধ চোখে পড়েছে এবং তা খুবই শক্তভাবে মানা হয়। এমনকি মালয়শিয়ায় বিভিন্ন শহর ভ্রমণে রয়েছে বিধি-নিষেধ যা মূলত প্রকৃতিক ভারসম্য রক্ষার বিষয়টি মাথায় রেখে করা হয়। বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলের ইকো সিস্টেমকে সুরক্ষিত রাখতে বিভিন্ন সময় এ ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া হলেও অপরিপক্ব আবেগের কাছে শেষ পর্যন্ত তা আর কার্যকর করা সম্ভব হয়নি, ফলাফল যা হবার তাই হচ্ছে, আমরা চোখের সামনে আমাদের হাওরের স্বাভাবিকতা নষ্ট হতে দেখছি, ঝুঁকির মুখে আছে আমাদের প্রিয় সেন্টমর্টিন আর সুন্দরবন। যাহোক, ফিরে আসি কাতালেনিয়ার রাজপ্রাসাদে, সময় কতক্ষণ কেটেছে আন্দাজ করতে পারছি না, সম্ভবত ঘণ্টাদুয়েকের বেশি তো হবেই, আসলে মুগ্ধতার সময় হিসেব করে ধরে রাখা যায় না। এবার ফিরবো কি না ভাবছি, তাই যেখনে বাস থেকে নেমে ছিলাম আবার সেখানে ফিরে এলাম বাস ধরবো বলে। তবে, এসেই শুনলাম কিছুক্ষণ হলো একটি বাস শহরের উদ্দেশে ছেড়ে গেল সুতরাং পরের বাসের জন্য আপেক্ষা করা ছাড়া উপায় নেই, তাই আবার এদিক-সেদিক ঘুরে বেড়ালাম। এটাকে অবশ্য শাপে-বরই বলা যায়।

কাতালেনিয়ার প্রাসাদটি বিশাল অঞ্চল নিয়ে তৈরি, গত দু’ঘণ্টায় আমি হয়ত এর চার ভাগের একভাগও দেখে উঠতে পারিনি, তাই আবার নতুন উদ্দ্যেমে পদ-পরিভ্রমণ শুরু করলাম। এবার প্রাসাদের চারিধার ঘুরে দেখার বাসনায় শুরু থেকেই শুরু করলাম। কাতালেনিয়ার প্রাসাদের ঠিক ঢোকার মুখেই একটি সাজানো বাগান, যেখানে একটি পাথুরে গোলাকার চত্বরে গোল হয়ে কিছু নারী-পুরুষ নাচ করছেন বা নচের ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছেন, না সত্যিকার নারী বা পুরুষ না পাথরের স্ট্রাকাচরে এমনি একটি চিত্র ফুটিয়ে তোলা হয়েছে ? আসলে নাচের এই ভঙ্গিটিকে ‘সারদানা’ বলা হয়। সারদানা হলো কাতালান সংস্কৃতির একটি বৃত্তাকার নৃত্য কৌশল। বিংশ শতাব্দীতে এই নৃত্যটি কাতালেনিয়াজুড়ে বেশ জনপ্রিয়তা লাভ করে, তারই একটি স্মৃতিস্মরক এই ভাষ্কর্যটি। খুব ইচ্ছে হচ্ছিল বৃত্তের ঠিক মাঝখানে দাড়িয়ে ছবি তুলব কিন্তু ঐ যে একা ভ্রমণে যে-সমস্যা নিজের ছবি নিজেকেই তুলতে হয়, তাই আর ইচ্ছে পূরণ হলো না। তবে, ছবি যে একেবারেই তোলা হয়নি তা কিন্তু নয়। সাধারণভাবে ইউরোপে অনেকেই স্বেচ্ছা-প্রণোদিত হয়ে ছবি তুলে দেয় কিন্তু আজ আর সে রকম স্বেচ্ছাসেবী পাওয়া গেল না।

এরপর বাকিটা সময় প্রাসাদের বাইরের পুরো চত্বরটার আনাচে-কানাচে ঘুরে ঘুরে সময় কেটে গেল। একসময় হেঁটে হেঁেট ক্লান্ত হয়ে আবার প্রসাদের মূল ফটকের কাছে ফিরে এলাম, এবার নিরবচ্ছিন্ন অপেক্ষা, বাসের জন্য। মিনিট পনেরোর মধ্যে বাস এসে হাজির, আমি আগেভাগেই বাসে উঠে পড়লাম, জনালার ধারঘেঁসে বসবো বলে। যেকোনো বাহনের জানলার পাশের সিটের প্রতি আমার চিরন্তন দুর্বলতা, আসার পথে বাসের জানালার ধারঘেঁসে বসতে পারিনি, কিন্তু এখন আর সে সুযোগ হারাতে চাইলাম না। বাস যাত্রীতে পরিপূর্ণ হয়ে ওঠার পর নির্দিষ্ট সময়ে বাস চলতে শুরু করল। যে-পথে এলাম আবার সে-পথেই ফেরা। এবার অবশ্য পথ আর অচেনা নয়, তাই হুট করেই সিন্ধান্ত নিলাম, পথে যেতে যেতে যে স্টপেজটা ভালো লাগবে সেখানেই নেমে পড়ব। যেই কথা সেই কাজ, খুব দ্রুতই একটি জায়গার দৃশ্যপট দূর থেকেই আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে এবং সৌভাগ্যক্রমে সেখানে বাস স্টপেজ রয়েছে, যা আমার জন্য পোয়াবারো। বাস থামতেই আমিসহ আরো কয়েকজন যাত্রী সেখানে নেমে পড়ি। আসলে বাসন্তী আবহে স্পেনের এই সময়ে শহরটা যেন তার রূপের আলো ছড়াচ্ছে। এর পথঘাটের প্রতিটি অলিগলিই সুন্দর। একটু উনিশ-বিশ কিন্তু অসুন্দর না। ও বলা হয়নি, আমি যে-জায়গায় নামলাম তার নাম মন্টজুইক, এটি মূলত একটি অনুচ্চ পাহাড়, তবে ইতিহাসসমৃদ্ধ। হ [চলবে]