ইউরোপের ১৫০ দিন : সৈয়দা তাসলিমা আক্তার

29 Sep 2024, 03:08 PM ভ্রমন শেয়ার:
ইউরোপের ১৫০ দিন : সৈয়দা তাসলিমা আক্তার


[পূর্ব প্রকাশিতের পর]


ইউরোপে শীত মানে একটা প্যাঁচপ্যাঁচে ভাব, হাড় কাঁপানো ঠান্ডাকে আরো উসকে দিতে গুঁড়িগুঁড়ি বৃষ্টির জুড়ি নেই। এর মধ্যে আমরা ফ্রাঙ্কফুর্টের পথে ঘুরে বেড়াচ্ছি। শহরের বুক চিরে বয়ে চলা ছোট্ট নদী, নাম মেইন নদী। নদীর একধার ধরে হাঁটতে হাঁটতে আমরা চলে এলাম পায়ে চলা সেতুর কাছে। আগেই বলেছি, ইউরোপে নদীগুলোর উপরে আড়াআড়ি আনেক কটা সেতু থাকে যা নদীর এপার-ওপারকে সংযুক্ত করে। আমরা হাঁটতে হাঁটতে সেতুর উপর উঠে এলাম ওপারে যাবো বলে। ইউরোপে এটা খুব প্রচলিত একটি বিষয় নদীর উপরে যে সেতু থাকে তার রেলিংগুলোতে প্রচুর তালা ঝুলানো থাকে, এগুলোকে লাভলক বলে ; এ নিয়ে আগেও বলেছি, এখন আর বিস্তারিত আলোচনায় যাচ্ছি না। নদী পার হতে সময় লাগল না। নদীর এপাড়টি অনেক বেশি ছিমছাম। যেহেতু পাশ দিয়ে হাইওয়ে চলে গেছে তাই পথচারীর সংখ্যা খুব কম। আর আমাদের মতো অতিপাগল লোকজনের সংখ্যা তো আরো কম। একেতে প্রচ- ঠান্ডা তার ওপর বৃষ্টি, সব কিছু উপেক্ষা করে আমরা শহর দেখতে বের হয়েছি। কারণ, আমাদের হাতে সময় খুব কম, বড়জোর আর ঘণ্টাচারেক আমরা এই শহরে থাকব, তাই যতটা পারা যায় ঘুরে দেখা। নদীর ধার ঘেষে ঝাউয়ের ঝাড়, যদিও এ সময় পাতা হারিয়ে এরা নিঃস্ব। এখানে সেখানে কাঠের বেঞ্চি, এটা আমার কাছে খুব অবাক লাগে, অতো বৃষ্টির মধ্যে কাঠের স্থাপনাগুলো দিনের পর দিন কেমন করে টিকে থাকে। প্রায় ঘণ্টাখানেক সময় পথ হেঁটে আমরা আরেকটি সেতু পার হয়ে কোলহলপূর্ণ মূল শহরে ফিরে এলাম। শহরের বিনোদন কেন্দ্র, আবাসিক হোটেল, রেস্তরাঁ সবই এ পাশটায় অবস্থিত। চলতে চলতে দু-এক জায়গায় দ্বিতীয় বিশ^যুদ্ধের স্মৃতি বহন করে এমন কিছু স্থাপনাও চোখে পড়ে। চলতি পথে তারকাশোভিত একটি স্ট্রাকচার দেখে কিছুটা সময় থামলাম, জানলাম এটি ইউরোর সাইন আর আমরা ইউরোপীয়ান সেন্ট্রাল ব্যাংক এর ফ্রাঙ্কফুর্ট শাখার সামনে।

ঠান্ডার মধ্যে অনেক্ষণ হাঁটাহাঁটিতে আমাদের হাত-পা জমে যাবার যোগাড়, তাই উপান্তর না দেখে একটি রেস্তোরাঁয় ঢুকে পড়লাম। ভেতরটায় লোকজনে ঠাসা, অনেক খুঁজে-পেতে দু’জনের বসার মতো একটি টেবিল পেলাম। অনেকক্ষণ পর উষ্ণতা পেয়ে বেশ ভালো লাগছে। আমরা এর মধ্যে খাবারের অর্ডার করে দিলাম। বুঝতে পারছিলাম খাবার সার্ভ করতে সময় লাগবে, তাই আগেভাগেই অর্ডার করা। ইউরোপের অন্যান্য রেস্তোরাঁ থেকে এই রেস্তোরাঁর একটা ভিন্ন চরিত্র চোখে পড়ল, ইউরোপীয়ানরা সাধারণত খুব একটা হট্টগোল পছন্দ করে না। এরা নিজেদের মধ্যেও খুব চাপা গলায় কথা বলে। কিন্তু এখানে, একেতে মিউজিক চলছে, মোটামুটি লাউডই বলা যায়, তার ওপর আড্ডা হাসি, মাঝে মাঝে দু-এক কলি গানও গেয়ে উঠছে কেউ কেউ। এর মধ্যেই এক স্বর্ণকেশী হ্যান্ডক্যাম দিয়ে ভিডিও করছেন, বিভিন্ন টেবিলে গিয়ে অন্যের সাথে পরিচিত হচ্ছেন তা আবার ভিডিওতে ধারণও করছেন, বেশ জমজমাট অবস্থ্।া ইরফান এরমধ্যে আমাদের পরবর্তী কর্মপন্থা ঠিক করে নিল। আমরা রাইড শেয়ারের মাধ্যমে প্রথমে লুক্সেমর্বাগ যাব। খাবার সার্ভ করে দেওয়ায় আপাতত আমরা খাবারে মনোনিবেশ করলাম। লাঞ্চ শেষে একমগ কফি শেষ করে আমরা আবার বেরিয়ে পড়লাম। তখনো ঝিরঝির বৃষ্টি, বৃষ্টি যেন আজ পণ করেছে কোনো রকম বিশ্রাম নেবে না। আর যেহেতু আমাদের ফেরার তাড়া আছে তাই বসে বসে বৃষ্টি বিলাসের সুযোগ নিই। এখন আমরা একটা বিশাল ভবনের লবিতে চলে এসেছি, ভবনটির নাম ‘মেইন টাওয়ার’, নদীর নামে নাম। এখানে কেন এসেছি তখনো পর্যন্ত আমি জানি না, ইরফান আমাকে দাঁড়াতে বলে হেল্প ডেস্কে কথা বলতে গেল, ফিরে জানালো যে, অনুমতি পাওয়া গেল না। কীসের অনুমতি জিজ্ঞেস করে জানলাম এই ভবনের উপরে একটি ওয়াচ টাওয়ার আছে যেটা থেকে ফ্রাঙ্কফুর্ট শহরের প্রায় পুরোটাই দেখা যায়, সাধারণ সময়ে এটা উন্মুক্ত থাকে ; তবে, আজ কনফারেন্সের কারণে তা বন্ধ আছে। সুতরাং, পাখির চোখে শহর দেখা হলো না। এরপর খানিকক্ষণ এদিক-সেদিক ঢুঁ মেরে, ইউন্ডো শপিং করে আমরা আমাদের নির্ধারিত গন্তব্যে রওনা হলাম।

আমরা যার গাড়িতে শেয়ারিংয়ে যাব তিনি আমাদের ফ্রাঙ্কফুর্টের ক্রিসমাস মার্কেট থেকে পিক করবেন, সেই মতো আমরা আগেভাগেই ক্রিসমাস মার্কেটে পৌঁছে গেলাম, এলাকাটির নাম রোমারবাগ। ফ্রাঙ্কফুর্ট ক্যাথিড্রালের চারপাশ ঘিরে চমৎকার আয়োজন। দিনটি সম্ভবত ডিসেম্বরের ২১ তারিখ, ক্রিসমাস দরজায় কড়া নাড়ছে। মার্কেটগুলো জমজমাট। আর ক্রিসমাস মার্কেটের একটি বিশেষত্ব হচ্ছে, এটি স্থায়ী কোনো মার্কেট নয়, এটাকে এক্সিবিশন বা মেলা বলা যায়, যা ক্রিসমাস উপলক্ষেই আয়োজিত। এই আয়োজনে বেশ কিছু থিম থাকে। যেমন আমার আমাদের দেশে ঈদ বা নবর্বষ উপলক্ষে আয়োজিত বিভিন্ন মেলায় দেখে থাকি। এখানে যিশুর জন্মের সঙ্গে জড়িত গোয়াল ঘারের একটি আদলে পাপেট দিয়ে সেই সময়ের চিত্র তুলে ধরার একটি প্রয়াস ছিল, বেশ নান্দনিক উপস্থাপনা। হাতে কিছু সময় থাকায় আমরা পুরো মেলাটি ঘুরে দেখলাম, ছোটোখাটো দু-একটি স্যুভিনিরও কেনা হলো।

ইতোমধ্যে আমাদের রাইডার চলে এসেছে, আমরাও আর দেরি না করে তার সঙ্গী হয়ে গেলাম, এরপর টানা পথচলা। দিনের আলো আনেকক্ষণ হলো ফুরিয়েছে, আলোর যেটুকু আভা ছিল তাও বিলীন। তবে সড়ক-বাতির আলোয় চারপাশ স্পস্টই দৃশ্যমান। মাঝেমাঝেই আমরা বিস্তৃর্ণ চরাচর পাড়ি দিয়ে ঢুকে পড়ছি আলো ঝলমলে কোনো শহরে, আবার কখনো পাশ কাটিয়ে যাচ্ছি আলোর ঝলকানি। বসে থেকে থেকে খিদে লেগে গেল, তখনই মনে হলো সাথে কিছু শুকনো খাবার রাখলে ভালো হতো, আর পথটা এমন যে, কোথাও থেমে কিছু কিনে নেব তার জো নেই। তাই অপেক্ষা কখন লুক্সেমর্বাগ পৌঁছাবো, পৃথিবীর মধ্যে অন্যতম ধনকুবের দেশ, নিজেকেও কেমন যেন ধনিক শ্রেণির অংশ বলে মনে হচ্ছে। প্রায় সাড়ে তিন ঘণ্টার পথ পাড়ি দিয়ে আমরা যখন লুক্সেমর্বাগ, তখন মনে হলো সময় সেখানে থমকে আছে তরুণী রাতের মতো। আসলে ইউরোপে রাত খুব কমসময়ই যৌবন হারায় আর এখন তো ক্রিসমাস বেল বাজছে। একদিক থেকে আমরা খুব লাকি একটা উৎসবমুখর সময়ের সাক্ষী হতে পেরেছি।

আমরা শহরের একেবারে কেন্দ্র চলে গেলাম। মূল শহরটা একটু নিরিবিলি, বরং শহরতলীগুলোই বেশি জমজমাট। এর কারণ ভাবতে গিয়ে বুঝলাম সেগুলো আসলে শহরের প্রবেশমুখ। সেখানটাতে জনসমাগম এবং জনসংযোগ দুটোই বেশি, বাণিজ্যিক একটা কারণ অবশ্যই আছে। আগেই বলেছি খিদে লেগেছে, বেশখানিকটা পথ হেঁটে আমরা কোনো হালাল রেস্টোরেন্ট খুঁজে না পেয়ে ডোনাট আর চিপস খেয়েই আপাত খিদা নিবারন করলাম। আমাদের পরবর্তী রাইড রাত এগারোটায়, এখন সময় রাত আটটা, আমাদের হাতে ঘণ্টাতিনেক সময় আছে, এই সময়টা আমরা হেঁটে শহর দেখার পরিকল্পনা করলাম। আমরা শহরের মাঝখান থেকে একটি দিক ধরে হাঁটছি, যেটা আদতে শহরে ঢোকার মুখ, আমরা এ পথ দিয়েই বের হবো। এছাড়া শহরে যখন প্রবেশ করি, তখন শহরের এ দিকটাতে একটি এক্সিবিশন দেখেছিলাম, এক ফাঁকে সেখানেও ঢুুঁ মারা যাবে। আসলে একটা লক্ষ্য স্থির করে এগোনো। সামনেই ক্রিসমাস শহরজুড়ে এর আবহ, এখানে সেখানে ছোটো ছোটো দলে আড্ডা চলছে, কোথাও গানবাজনার আয়োজনও আছে। আমরা কোথাও আসলে সেভাবে থামছি না। লুক্সেমবার্গ শহরটি বেশ মজার, দুটি পাহাড়ি উপত্যকাকে একটি সেতু দিয়ে সংযুক্ত করে শহরটি তৈরি। ঠিক সেতুর উপর এসে আমার মনে হলো এটি একটি দোতলা শহর যার উপর তলা থেকে এখন যেন নিচতলা দেখছি। নিচে উপতক্যার ঢাল, তারও নিচে কিছু সমতল ভূমি সেখানেও শহুরে আলো জ¦লছে। ঢাল বেয়ে নিচে নেমে গেলাম, নিচতলার শহরটাকে দেখবো বলে। নিচে নামার ঢালটা বেশ নির্জন আর পথটা বেশ লম্বা হওয়ায় বেশিদূর যাওয়া হয়নি, আবার উপরে উঠে এলাম। এবার গন্তব্য শহরে ঢোকার সময় যে ক্রিসমাস মেলা দেখেছিলাম, সেখানটায়।

লুক্সেমবার্গের মেলা বলে কথা, বেশ জমজমাট আর চোখ ধাঁধানো আয়োজন। এ ধরণের আয়োজনকে স্থানীয় ভাষায় ক্রিসমাস মার্কেট বলে, যেমন ফ্রাঙ্কফুর্টে ছিল। ফ্রাঙ্কফুর্টের ক্রিসমাস মার্কেটের পরিধি বড়ো ছিল, এখানকারটা তেমন বিশাল জায়গাজুড়ে না কিন্তু চমক বেশি। এটা খুব স্বাভাবিক লুক্সেমবার্গ খুব ছোটো একটা জায়গা চাইলে পায়ে হেঁটে পুরো শহর দেখা কয়েক ঘন্টার ব্যাপার। আমরা ভিড়ের মধো ঢুকে গেলাম। সাজানো-গোছানো বিভিন্ন দোকানে ঘুরেঘুরে টুকটাক স্যুভিনিরও কেনা হলো। এই স্বল্প পরিসরেও বেশ কিছু চমকপ্রদ রাইড ছিল, যথারীতি সেগুলোতে লম্বা কিউ থাকায় আমরা আর সে পথে না গিয়ে আবার শহর প্রদক্ষিণে বেরিয়ে পড়লাম। আসলে রাতের মায়াবী আলোয় শহরের অলিগলি ঘুরতেই বেশি ভালো লাগছিল। আজ আকাশে চাঁদটা এত বড়ো ছিল যেন অনেকটা কাছে চলে এসেছে, আমরা খানিকক্ষণ চাঁদের পিছু পিছু ছুটলাম, চাঁদের সঙ্গে ছবি তোলার বহুত কসরৎ করলাম, ব্যর্থ হয়ে গলি ছেড়ে রাজপথে উঠে এলাম। ঘড়ির কাঁটা বলছে আমাদের ফেরার সময় হয়ে এলো, তাই নির্ধারিত পয়েন্টের দিকে এগুলাম, যেখান থেকে আমরা রাইড নেব।  [চলবে]