নিসর্গবাস -দিল আফরোজ রিমা

02 Mar 2023, 02:03 PM মুক্তগদ্য শেয়ার:
নিসর্গবাস -দিল আফরোজ রিমা

প র্ব ১


ভোরের আবছা আঁধারি, মিষ্টি বাতাস আর পাখির ক‚জনে শাকিলার বারান্দায় স্নিগ্ধ, মনমুন্ধকর পরিবেশ। ভোরের স্নিগ্ধ বাতাসে প্রতিদিন বারান্দায় এসে বসে সে। এমন ক্ষণে পাণ্ডুলিপি হাতে দু,-চার পৃষ্ঠা লিখতে বেশ লাগে। বারান্দায় সবুজের আনাগোনা। এর মাঝে দলমেলে হাসছে সাদা-গোলাপি নয়ন তারা। নীল ডেইজি, বেগুনি রঙের বোতাম ফুল, মিষ্টি রানি গোলাপি মর্নিং গ্লোরি। নানা রঙের পর্তুলিকা, লাল কাটামুকুট। এরাই তাকে ডেকে জানতে চায়, কোথায় তোমার কবিতা লেখার খাতা ? 

কী সুন্দর পুঁই শাকের ডগায় বাতাস খেলা করছে, নানা রঙের পাতাবাহার ভোরের বাতাসে দোল খাচ্ছে। শহরের রুক্ষ ইট পাথরের মাঝে থেকেও একটুকরো সবুজে ঘেরা বারান্দা তার শান্তির ঠিকানা। প্রকৃতি বড়ো ভালোবাসে শাকিলা চৌধুরী। মাটিতে বীজ ফেলা, ছোটো চারাগাছের বেড়ে ওঠা এসব দেখতে তার খুব ভালো লাগে। গ্রামের সবুজ শ্যামল প্রান্তরে কেটেছে শৈশব। প্রকৃতির মাঝেই বেড়ে উঠেছে সে। তাদের বাড়ির চারপাশে সবজি গাছের কথা মনে পড়ে। রাখাল গণি কাকার সাথে সেও গাছের পরিচর্যা করত। এখনো গাছের পরিচর্যা করতে খুব ভালো লাগে তার। যাহোক, তার বারান্দায় এত সবুজের সমারোহ, যার প্রেরণায় এবং যার সহযোগিতায় গড়ে উঠেছে তিনিই এই কথকথার মধ্যমণি। তিনি একজন খুবই গুণী ও পরিবেশ বান্ধব ব্যক্তি। তার ঘরে সুন্দর ইনডোর প্ল্যান্ট মনোরম করেছে ঘরের পরিবেশ। তার হাতের ছোঁয়ায় সবুজ হয়েছে তার বারান্দা, ছাদ-সহ তার প্রতিবেশীর উঠোন।

তিনি শাকিলার সুপরিচিত ড. জেসমিন। ড. জেসমিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মৃত্তিকাবিজ্ঞানে অনার্স-মাস্টার্স পাস করেছেন। বিসিএস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে কলেজে অধ্যাপনা শুরু করেন। তার কিছুদিন পর রিসার্চ শুরু করেন এবং পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন।

একদিন শাকিলা ড. জেসমিনের বাসায় বেড়াতে যায়। ড্রইং রুমে, জানালার পাশে বেড রুমের শু-স্ট্যান্ডে, দেয়ালের কোনায় কোনায় খুব সুন্দর বাহারি ইনডোর প্ল্যান্ট দেখে মুগ্ধ হয় সে। তার মন ভরে যায়। সে ড. জেসমিনকে জিজ্ঞেস করে, ম্যাডাম, আপনি ঘরে কেন এত গাছ লাগিয়েছেন। সুন্দর লাগছে কিন্তু ঘরে মশার উপদ্রবও হতে পারে। তাছাড়া বাজারে এখন কত ধরনের শো-পিস পাওয়া যায়। সেসব দিয়ে আরও সুন্দর করে সাজাতে পারতেন।

শাকিলার কথা শুনে তিনি মুচকি হাসলেন। বললেন, বাজার থেকে সুন্দর চকচকে শো-পিস এনে সাজাতেই পারতাম। কিন্তু সেসবতো কৃত্রিমতায় ভরা। নির্জীব, নিষ্প্রাণ। কোনো সজীবতা নেই। দেখে মনে প্রশান্তি মেলে না।

তিনি বললেন, টবে পানি জমে থাকলে মশার সৃষ্টি হয় এবং উপদ্রবও হয়। তবে গাছ এবং টব দুটোই পরিষ্কার রাখতে হয়। আমি তাই করে থাকি। ঘরের গাছগুলো আমার কোনো অসুবিধা করে না। বরং শান্তি দেয় স্বস্তি দেয়। তাছাড়া ওরা বিভিন্নভাবে আমাদের উপকার করছে। গাছ ঘরের ভেতরের পরিবেশ নির্মল রাখে। ঘরের সৌন্দর্য বর্ধন করে। আমাদের শ্বাস-প্রশ্বাসের মাধ্যমে কার্বনডাইঅক্সাইড গ্যাস বের হয়। এতে বাতাস দূষিত হয়। বাহির থেকে অনেক সময় দূষিত গ্যাস ঘরে প্রবেশ করে। এসি রেফ্রিজারেটর এবং এই ধরনের আসবাব থেকেও দূষিত গ্যাস বের হয়ে ঘরের বাতাস একেবারেই দূষিত করে দেয়। আমরা কি কখনো ভেবে দেখেছি, কী মারাত্মক জীবনঝুঁকিতে আমরা বেঁচে আছি। ঘরে গাছ থাকলেই এই ধরনের খারাপ গ্যাস শোষণ করে ঘরের বাতাসকে দূষণ মুক্ত করে।

তিনি বলেন, গাছ দিনের বেলায় সালোক সংশ্লেষণ প্রক্রিয়া চলাকালীন সময়ে অক্সিজেন সরবরাহ করে। তাছাড়াও কিছু গাছ আছে যারা রাতের বেলায়ও অক্সিজেন সরবরাহ করে। স্নেক প্ল্যান্ট গাছ এবং এ জাতীয় গাছগুলো রাতে অক্সিজেন সরবরাহ করে। স্নেক প্ল্যান্ট গাছ ঘরের বায়বীয় আবর্জনা শোষণ করে ঘরের পরিবেশ পরি”ছন্ন রাখে।

বিভিন্ন ধরনের ক্র্যাকটাস, স্পাইডার প্ল্যান্ট, পিচ লিলি ইত্যাদি গাছ ঘরের স্যাঁতসেঁতে ভাব দূর করে। তিনি আরও বলেন, আমার ঘরে এমন কিছু গাছ আছে যা মশা তাড়াতে সাহায্য করে। যেমন, গ্রিপিং চার্লিং ইতালিয়ান সুইট ব্রেসিল। গাঁদা ফুলের গাছ বারান্দায় অথবা ঘরের আশেপাশে থাকলে মশার কোনো উপদ্রপ থাকে না। তাই বিভিন্ন ধরনের মশার বিষাক্ত কয়েল বা ওষুধ ব্যবহার করার দরকার হয় না।

অন্য একদিন শাকিলা তার মেয়েকে নিয়ে ড. জেসমিনের বাসায় বেড়াতে যায়। সেদিন ওনার খোঁজ করতে করতে বারান্দায় গিয়ে দেখে ম্যাডাম নিজের হাতে প্লাস্টিকের বিভিন্ন সাইজের বোতলে কেটে ডিজাইন করে সুন্দর করে রং করছে এবং বোতলের গায়ে আলপনা করছে। শাকিলা জিজ্ঞেস করে, ম্যাডাম এগুলো দিয়ে কী করবেন ?

তিনি তখন বললেন, এগুলোর মধ্যে গাছ লাগাবো।

-ম্যাডাম গাছ লাগানোর জন্য কত সুন্দর টব পাওয়া যায়। 

-হ্যাঁ পাওয়া যায়। কিন্তু বোতল কেটে টব বানাচ্ছি। এগুলোও দেখতে সুন্দর। টাকা খরচ করে টব কিনতে হলো না। অকেজো বোতলগুলো কাজে লাগল। পরিবেশও অন্তত এতগুলো প্লাস্টিকের ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা পেল।

-ম্যাডাম এই প্লাস্টিকের বোতল আবার পরিবেশের কী ক্ষতি করবে ?

-কী ক্ষতি করে আপনি না জানলে আপনার মেয়ের কাছে জিজ্ঞেস করেন। ওতো প্রাণীবিজ্ঞানী। সাঈদা আম্মুকে বুঝিয়ে দাও তো।

সাঈদা বলতে শুরু করল, আমার এখন গ্রিক রাজা মিডাসের গল্পটা মনে পড়ল। আমরা সবাই রাজা মিডাস-এর গল্পটা জানি। মিডাস চেয়েছিল পৃথিবীটাকে স্বর্ণ দিয়ে মুড়ে দিতে। সে হাত দিয়ে যা স্পর্শ করত তাই সোনা হয়ে যেত। একসময় সে খেয়াল করল সে কিছু খেতে পারছে না, হাত দিয়ে স্পর্শ করার সঙ্গে সঙ্গে সব খাবার সোনা হয়ে যাচ্ছে! এমনকি তার মেয়েও তাকে স্পর্শ করা মাত্রই সোনা হয়ে গেলো ! এমন কিছু আমরা আশা করি, যেটা পাওয়ার পরে পৃথিবীটা তেমনভাবে বদলে যায় যেমনটা আমরা কখনো চাই না।

শাকিলা বিরক্ত হয়ে বলল, কী বলছ তুমি কিছুই তো বুঝতে পারছি না। 

-আম্মু একটু ধৈর্য ধরে আমার কথা শোনো, তাহলেই বুঝতে পারবে। আজ সেই গল্পের মতোই এক সোনার অভিশাপে আক্রান্ত হয়েছি আমরা। আমাদের বাসভূমি এই পৃথিবীকে অনেক বেশি উন্নত করে তুলতে আমরা আবিষ্কার করলাম প্লাস্টিক। সভ্যতার অসাধারণ আবিষ্কার এই প্লাস্টিক। প্লাস্টিক জীবন বদলে দিল। জীবনের প্রতিক্ষেত্রে নানাভাবে নানা চেহারায় প্লাস্টিকের ব্যবহার।

দাঁত মাজার ব্রাশ, চুল আঁচড়াবার চিরুনি, ভাত খাবার থালা, আসবাবপত্র, গাড়ি-ঘোড়া সব জাগায় নানারকম চেহারায় এই প্লাস্টিক বা সিন্থেটিক পলিমার উপস্থিত! ব্যাকলাইট, পলিথিন, পিভিসি, নাইলন কত রকম তার চেহারা আর কতো বিস্তৃত তার ব্যাবহার। এমনকি আমাদের জামা-কাপড়ও প্লাস্টিক [সিন্থেটিক পলিমারের মাইক্রো ফাইবার দিয়ে তৈরি সিন্থেটিক কাপড়]।

মজার বিষয় হচ্ছে, এইসব প্লাস্টিকের দ্রব্যগুলো আমরা স্থায়ীভাবে ব্যবহার করি না। প্রতিটা প্লাস্টিকের দ্রব্য ব্যবহারের পর ফেলে দিই, নতুন আরেকটা নিয়ে আসি। নতুন প্লাস্টিকের উৎপাদন তো আর থেমে নেই !

কিন্তু একটা কথা কখনো ভাবি না, যেটা ফেলে দিই সেটা কোথায় যায় ? 

-হ্যাঁ, তাই তো। প্লাস্টিক তো পচে না। রয়েই যায়। 

-প্লাস্টিক মাটিতে মিশে যেতে প্রায় ৫০০-১০০০ বছর সময় নেয়। এইরকম একটা সুপার টাফ জিনিসকে একবার ব্যবহার করে ফেলে দিয়ে নিশ্চিন্তে থাকি আমরা ! অর্থাৎ আজ পর্যন্ত যত প্লাস্টিক তৈরি হয়েছে, সব রয়ে গেছে পরিবেশে। আর আমরা সমানে প্লাস্টিক বানাচ্ছি, ব্যবহার করছি, ফেলে দিচ্ছি, আরো বানাচ্ছি। তার মধ্যে ৯% রিসাইকেল করা হয়, ১২% পোড়ানো হয় আর বাকিটা থেকে যায়।

-প্লাস্টিক তো দেখছি খুব ভয়ংকর জিনিস। আর এগুলো বাদ দেওয়াও সহজ নয়।  [চলবে]