সুন্দর নাম সবসময়ই স্বস্তিদায়ক ; কী নাম ধরে ডাকতে, কী কান পেতে শুনতে। নতুন কোনো নাম শুনলেই তাই আগ বাড়িয়ে স্বস্তি জানতে চায়- অর্থ কী ? দেখা যায়, বেশিরভাগ সময়ই নামধারী জানেই না, তার নামের অর্থ আসলে কী !
স্বস্তির নিজের ডাকনামটাও ছিল ইংলিশ-এ ; হ্যাপি । কী অস্বস্তিকর! বাঙালি হয়ে ইংলিশ নামধারী ! তাছাড়া, কেউ শুদ্ধ করে ডাকতে পারে না! ছোটোরা ‘হাপি’, বড়োরা ‘হেপি’ আর গ্রামের মানুষ ‘হেফি’। বড়ো দুলাভাই ডাকতেন- হ্যাপ্টোনাপ্লাস্! অবস্থা এমন দাঁড়ালো যে, নিজের নামটা বিকৃত উচ্চারণে শুনতে হবে এই ভয়ে কেউ নাম জানতে চাইলে স্বস্তি সার্টিফিকেটের আরবি নামটাই বলতে শুরু করল। যারা প্রবাসী বা বিদেশ ফেরত, তারাও শুদ্ধ উচ্চারণে ‘হ্যাপি’ বলেন না ! অগত্যা কী আর করা ! বদলাতেই হলো নামটা।
স্বস্তি যখন থেকে নিজের বই নিজে কিনতে শুরু করেছে, তখন থেকেই ‘শিশুর সুন্দর নাম’ শিরোনামের বই-ও কিনেছে। সে-সব বই, চেনা মানুষেরা চেয়ে নিয়ে গিয়ে ফেরত দিতে ভুলে যায়! কত আর কেনা যায় ? দরকারই নেই আর অন্য ভাষার নামের অর্থ খোঁজার- ধাক্কা খেতে খেতে স্বস্তি শেখে। মাতৃভাষাই সই। অভিধান তো রয়েছেই বাড়িতে। বাড়তি বইয়ের কী দরকার ?
আল্ট্রাসনোগ্রাফির কল্যাণে জানাই ছিল বাড়িতে কন্যা শিশু আসছে। ছোটো ভাবি বলেও রেখেছিলেন। ডায়েরির পাতায় স্বস্তি তাই অগ্রণী দীপনা, অণুভা আলোক, অনন্য দিশারী, অমিত্রা অনামিকা অমিয়া অমানিতা আপন সত্তা, আস্থাবতী, ঈপ্সিত আস্থা, ঋজুব্রতী, কাক্সিক্ষতা দীয়া, জয়ী আরাধিতা,দীপ্ত-মানবী ধরিত্রী জয়া, নন্দিত মাধুর্য, নন্দিতা সর্বজয়া, পুষণ পাবণী,প্রত্যাশা প্রাপ্তি, প্রাকৃত নৃ, প্রাজ্ঞ ঈশিতা, প্রিয়ংবদা, মায়াবী বিভা, মুক্তমনা প্রাজ্ঞ, সৌমি সুধা... এরকম গোটা বিশেক নাম টুকে রাখে। ডায়েরিটা ছিল ভাতিজার। ওরই ছোটো বোন হবে। আনন্দে তাই ও বলে ওঠে - আমি ‘রিমঝিম’ ডাকব।
-ঠিক আছে ডেকো। ‘রিমঝিম বৃষ্টি’ও একটা নাম হতে পারে ; স্বস্তি সায় দেয়।
-এটা আবার কী রকম নাম ! স্বস্তির সেজ বোন মুখ কালো করে বলেন, ‘আমরা মুসলিম। আমাদের নাম হবে ইসলামিক। ওসব নামে ডেকো না।’
হায়রে বাংলা ভাষা! হায়রে, ভাষা-শহীদদের আত্মত্যাগ!
ভাতিজি নির্দিষ্ট সময়ে পৃথিবীতে ওর আগমনী- বার্তা ঘোষণা করে। এদিকে অপারেশন করতে গিয়ে ডাক্তারের ভুলের কারণে যখন মাকে বাঁচানোই দায়, তখন আর নাম নিয়ে কে-বা মাথা ঘামায় ?
পরের সপ্তাহেই কুরবানির ঈদ। ঈদের আগের দিন ছোটো ভাইয়ার হঠাৎ মনে হয়, আকিকাও একইসঙ্গে সেরে ফেলি। খোঁজ পড়ে তখন চারদিকে- একটা ভালো নামের। ভাবি হাসপাতাল থেকেই মুঠোফোনে জানান- স্বস্তিকে তো বলে এসেছিলাম। ও নিশ্চয়ই লিখে রেখেছে।
দেওয়া হয় ডায়েরি। নাম দেখে তো সকলের চক্ষু চড়কগাছ! এসব কী-ই-ই ! সবগুলো হিন্দু নাম!
‘এ হলো নালন্দা বিদ্যালয়ে শিক্ষকতার ফল।’---ছোটো খালা আর ভাইয়ার মন্তব্য।
স্বস্তির মনে পড়ে যায়, শৈশবে একবার ও পাড়ার কুমোরবাড়ির দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে এক বৃদ্ধ নারীর চাক ঘুরিয়ে মাটির হাঁড়ি-পাতিল বানানো দেখছিল। একমনে বৃদ্ধার কাজ পর্যবেক্ষণ করতে দেখে খুশিমনে তিনি স্বস্তির তত্ত্ব-তালাশ করেন। প্রসঙ্গক্রমে স্বস্তি ওর বড়ো ভাতিজার নাম ‘উজ্জ্বল’ বলায় ক্ষেপে গিয়ে সেই বৃদ্ধা মন্তব্য করেন- আম্গো নাম রাখছো ক্যান? ‘উজ্জ্বল’ হিন্দুগো নাম না ?
কথক নৃত্যগুরু সাজু আহমেদকে ফোন করেও অনেকে জানতে চেয়েছেন---মেয়ের নাম কেন ‘সুদেষ্ণা’ রেখেছেন ? ছাত্রীর নাম কেন ‘অগ্নি’ ? ও মুসলমান না ?
এতেই শেষ নয়। স্বস্তির বোন ছেলের নাম ‘শাহরিয়ার’ রাখতে চাওয়ায় দুলাভাই রাখতে দেননি। দুলাভাইয়ের যুক্তি ছিল, ‘শাহরিয়ার’ শব্দটির মধ্যে ‘রিয়া’ শব্দটি রয়েছে। [আরবিতে ‘রিয়া’র অর্থ নাকি ভালো কিছু নয় (!)।] তাই, যদি তাঁর ছেলে বড়ো হয়ে বখে যায় (!) এই আশঙ্কায়ই নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা আর কী! অথচ, ‘নাম মানুষকে বড়ো করে না, মানুষই নামকে জাঁকিয়ে তোলে’---কথাটা সবারই জানা!
তাহলে কী দাঁড়ালো ? বাঙালি হয়ে বাংলায় নাম রাখলে ‘হিন্দুয়ানী’ নাম হয়ে যায়, এ কারণেই মাতৃভাষা হওয়া সত্ত্বেও ‘বাংলা’য় নাম রাখা যাবে না ; হিন্দু-মুসলিম সকলেরই এ কেমন মানসিকতা! ‘মাতৃভাষা’য় নাম রাখা যাবে না---ধর্মগ্রন্থে এরকম কথা লেখা আছে কি ? বিস্ময়াহত স্বস্তি মনের চারপাশে দেয়াল তুলে নিজের মধ্যেই ডুব দেয়। চোখ থাকতেও দেখে না। কান থাকতেও শোনে না। মুখ থাকলেও বলে না। ভাতিজির নাম রাখা হয় ‘আরিয়ানা আজিজ’।
আকিকা যথারীতি হয়ে যায়। আরিয়ানার বড়ো ভাই আলীম ছোটোবোনকে ‘রিমঝিম’ সম্বোধনে ডাকতে গেলে সবাই গালমন্দ করে। ডায়েরিটাও বাসা থেকে আলাদীনের দৈত্যই মনে হয় উধাও করে ফেলে!
আক্ষেপের বিষয়, এই যে নামের ক্ষেত্রে গোঁড়ামি কিংবা কুসংস্কার,---এ কেবল মানুষের নামকেই নয়, এলাকার নামকেও গ্রাস করেছে। বৃহত্তর রায়েরবাজারের জাফরাবাদ এলাকায় স্বস্তির বসবাস। গত তিন দশকে নামফলকে রাস্তার নাম লিখতে গিয়ে অভিজাতপন্থীরা ‘পশ্চিম-ধানমন্ডি’, গোঁড়া মুসলিমরা ‘মোহাম্মদপুর’, কেউ আবার ‘আজিজ-কো-অপারেটিভ’ কলোনি’র রাস্তা- এভাবে যার যা খুশি লিখছে! স্বস্তির ছোটো ভাইয়া আবার আরেক কাঠি সরেস! একক সিদ্ধান্তে নামফলকে ‘রায়েরবাজার’-এর পরিবর্তে ‘শঙ্কর’ লিখেছেন ; ‘পশ্চিম-ধানমন্ডি’তে থাকো বলবে, তাহলে লোকে তোমায় অভিজাতপাড়ার বাসিন্দা ভাববে’ - এ পরামর্শ স্বস্তিকে শিল্পকলা একাডেমির একজন সাবেক পরিচালকও দিয়েছিলেন। হাহ্, একসময়ের ধানক্ষেত আজ জাতে ওঠার টিকিট! আর তাই বোধহয়, এতবছরের পুরনো ‘শঙ্কর জামে মসজিদ’ও এখন ‘পশ্চিম-ধানমণ্ডি জামে মসজিদ’। মসজিদেরও আভিজাত্যের দরকার পড়লো কী কারণে, কে জানে ?! না কি, অর্থগত কারণে ‘শঙ্কর’ শব্দটিই যত সমস্যার মূল ?
এর আগেও অনেকেই স্বস্তির কাছ থেকে একগাদা বাংলা নাম চেয়ে নিয়ে শেষ পর্যন্ত সন্তানের নাম রাখতে বেছে নিয়েছেন আরবি বা ইংলিশ শব্দকেই। অনেকে আবার অর্থ যাচাই না করে বড়ো হয়ে ইচ্ছে- খুশি নামধারণ করতে গিয়ে শব্দাবলির আসল অর্থই গুলিয়ে ফেলেছেন।
মজার অভিজ্ঞতাও আছে ‘নাম’ নিয়ে। নালন্দা বিদ্যালয়’র একটি শিশুর নাম- এবং ও। শিশুটির মাকে প্রশ্ন ক’রে স্বস্তি জানতে পারে, প্রথম সন্তান ছেলের নামটি কেউ শুদ্ধ করে ডাকতে পারে না বলেই মেয়ের এরকম নাম রাখা হয়েছে । মন্দ কী; বাবা-মা এবং ও--- এভাবে ভাবলেই হয়।
এক নারীর নাম ছিল ‘পরিষ্কার বানু’ ; হ্যাঁ, বাবা-মাই রেখেছিলেন এ নাম। ‘দি রেইন’ চলচ্চিত্র দেখে মুগ্ধ পিতা কন্যার নাম রেখেছেন ‘দি রেইন’, এরকম নামের নারীর সঙ্গেও দেখা হয়েছে স্বস্তির। আর ‘আলিফ লায়লা’ নামের নারী সঙ্গীতশিল্পীকে কে না চেনে ? আবার নির্ঝর, ফারজানা, শাফিন, নিসর্গ- এরকম একশব্দের নামের মানুষের সংখ্যাও নেহাত হাতে গোনা নয়। বিশাল নাম রাখার প্রবণতা কমে এসেছে ক্রমান্বয়ে। যমজ মেয়ের নাম মা-বাবা রেখেছেন ‘যথা-তথা’। বাঃ! কী চমৎকার যথার্থ নাম !
যাই হোক, ঈদের দশদিন পর আরিয়ানাকে প্রথম টিকা দিতে একই হাসপাতালে নেওয়া হলে পরিচিত হয়ে ওঠা ডাক্তার জানতে চান, ‘নাম কী রেখেছেন?’ ‘আরিয়ানা’।’ ‘হায়-হায় ! করেছেন কী! হিন্দু নাম রেখেছেন কেন ? আরিয়ান মানে তো ‘আর্য’!’ মাথায় যেন বাজ পড়ে স্বস্তির ভাই-ভাবির।
‘স্বস্তি তুমি জানতে না আরিয়ান মানে আর্য ?’- বাসায় পা দিয়েই ভাবির জিজ্ঞাসা। ‘হ্যাঁ, না জানার কী আছে! আরবি ‘ইয়া’, সংস্কৃত ‘ইয়’ বাংলায় ‘য’ হয়ে যায়। ঐশ্বরিয়া যেমন বাংলায় ঐশ্বর্য, ইয়াদভ যেভাবে যাদব, ইয়মুনা-যমুনা ; ঠিক সেভাবেই...’ ‘তুমি অভিধান দেখেছিলে ?’ ‘হ্যাঁ। ওখানে আর্য শব্দের অর্থ আছে মনুষ্যজাতি বিশেষ, মান্য, সম্মানিত, সুসভ্য, সদাচার, ধর্মশীলতা, জ্ঞানী, শাস্ত্র পারঙ্গম, অভিজাত। তো, যখন দেখলাম, অর্থ কোনটাই খারাপ নয় ; তখন আর মিছে নাক গলাইনি। তাছাড়া নামের অর্থ নিয়ে দ্বন্দ্ব, মানসিক দোটানা, অনিশ্চয়তা এড়াতেই তো বাংলায় নাম রাখার পক্ষে আমি। তাহলে তো আর অর্থ নিয়ে কেউ দ্বিধায় ফেলতে পারবে না।’
সংশয় আর দ্বিধার পাকেচক্রে বছর গড়িয়ে যায়। নতুন নাম আর রাখতে সাহস পায় না কেউ। পছন্দসই আরবি শব্দের অর্থ একেক বইয়ে একেকরকম লেখা। কী করবেন ভাই-ভাবি ? কিছু একটা ব’লে ভাতিজিকে ডাকতে হবে তো, তাই স্বস্তিই প্রথম ‘বাবু’ ডাকতে শুরু করে। সঙ্গে সঙ্গে সকলেই ‘বাবু’ শব্দটিকে নিতান্ত আত্মীয়ের মতোই যেন লুফে নেয়।
উপলক্ষ, মামার বিয়ে। তাই, সপ্তাহখানেক নানাবাড়িতে বেড়িয়ে ‘বাবু’ যখন ফিরেছে ; স্বস্তি তখন নিজের ঘরে বসে লিখছিল। নানাবাড়িতেই বাবু এক-পা, দু’পা হাঁটতে শিখেছে। ওর আগমনী সঙ্কেত শুনে নিজের ঘরে বসেই স¦স্তি গলা বাড়িয়ে ডাকে- ‘বাবু, বাবু কোথায় ?’ । সঙ্গে সঙ্গেই গুটি গুটি পায়ে শব্দের উৎস খুঁজতে ‘বাবু’ এগোয়।
ওর ছোট্ট ছোট্ট পা ফেলে আসার হাল্কা নরম শব্দ স¦স্তি ঘরের মধ্যে বসেই অনুভব করে। পরিচিত পরিবেশে ফিরে আসার আনন্দে ‘বাবু’ শিশুসুলভ আনন্দধ্বনি করতে থাকে। ও দরজার কাছাকাছি পৌঁছলে, স¦স্তি ঘর থেকেই আবার ডাকে- ‘বা- বু!’
দরজা পেরিয়ে সামনে মায়ের ঘরে চলে যাচ্ছিল প্রায়, পরিচিত শব্দে বাবু পাশ ফিরে ডানে তাকায়। তারপরই আনন্দে উদ্ভাসিত চোখ-মুখ আর ফোকলা দাঁতের স্বর্গীয় হাসি উপহার দিয়ে দু’-এক পা এগিয়েই স্বস্তির কোলে ঝাঁপিয়ে পড়ে।
জ্যান্ত পুতুলসম বাবুকে কোলে বসিয়ে স্বস্তি আদরমাখা স্বরে জানতে চায়- ‘আমাদের বাবু’ কোনটা ?
নিজের বুকে হাতের তালু রেখে বাবু দেখায়- এইতা।