বাসায় একটা আমগাছ ছিল। সেটা, যতটা না ফলদায়ক, তার চেয়ে অনেক বেশি ছিল মৌমাছিসহ অন্যসব পোকামাকড়, পাখি আর পরগাছাদের আশ্রয়স্থল। গাছটায় একবছর বাদে বাদে গুটিকয়েক আম ধরত। বিশাল বপু নিয়ে গাছটা আমাদের বাড়ির সীমানা ছাড়িয়ে পেছনের বাড়ির আকাশসীমানা দখল করেছিল। আমের আকৃতি ফজলির মতো হলেও প্রকৃতি ভিন্নতর আঁশযুক্ত এবং সুমিষ্ট। তো, কোনো এক বছর মাত্র দুটো আম দেখা গেল গাছে - একটা বড়ো, একটা ছোটো। বাড়ির মুরুব্বিরা ফতোয়া জারি করলেন : বড়ো আমটা এলাকার পীর সাহেবকে দিতে হবে। হলো ! দেওয়া হলো তা-ই দেওয়া হলো !!!
তখনো আমি শিশু। মা’র যুক্তি ছিল, গাছতলায় যে ফল পড়ে, সেটা গাছপাকা বলেই বোঁটা খসে পড়ে যায়। তাই সেটা খেতে অবশ্যই সুস্বাদু হয়। সেই প্রলোভনে আমের মৌসুমে ভোর হতে না হতেই দে ছুট বিছানা ছেড়ে উঠোনে। যদিও ভাগ্যে জুটত খুব কম দিনই, কিন্তু যেদিন ভাগ্য সুপ্রসন্ন হতো, সেদিন আমাকে আর পায় কে একটা আম পেয়েই যেন রাজ্য জয়ের আনন্দে মেতে উঠতাম
সম্ভবত সম্মান প্রথম বর্ষে পড়ছি তখন। মেজাপিদের সঙ্গে একদিন গেলাম উত্তরখানে। মেজ দুলাভাই জমি কিনে ছোটো ভাইকে সপরিবারে সেখানে থাকতে দিয়েছেন। গাছপালা ঘেরা গ্রামীণ পরিবেশ। ফলের গাছের মধ্যে ‘আম’ অন্যতম। আমগাছের ছায়ায় আরাম করে বসলাম সকলে পাটি পেতে। গালগল্প চলছে। টুপ্ ! শব্দ পেয়েই চট করে সবার আগে উঠে পাকা আম কুড়িয়ে নিয়ে টিউবওয়েলের পানিতে ধুয়ে খেলাম। আ-হা, কী আনন্দ আকাশে-বাতাসে ! ঠিক পরের বছরই, গ্রীষ্মকালে ওরাই কাঁচা-পাকা মিলিয়ে দুটো ছালার বস্তা ভরে আম দিয়ে গেল মেজাপিদের। সেখান থেকে এক বস্তা আম আমাদের প্রাপ্তিযোগ হলো। ছোটো ছোটো আম। অনায়াসেই একেকবারে তিন-চারটা করে খেয়ে ফেলা যায়। না খেলে পচে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে খুব তাড়াতাড়ি। বাসার ছোট্ট ফ্রিজে রাখার জায়গাও নেই। ব্যস, সেটাই আমার জন্য হলো কাল। সকালে নাস্তা না খেয়ে পেটভরে খাচ্ছি আম। দুপুরেও ভাত খাওয়া বাদ দিয়ে আমটাকেই টেনে নিচ্ছি আগে। কী করব ? নষ্ট হয়ে যাচ্ছে যে !
দু’দিন পার হতে পারল না, পেটে গ্যাস জমিয়ে প্রকৃতি শিক্ষা দিল এভাবে, প্রধান খাবার হিসেবে, প্রতিবেলায় আম খাওয়া স্বাস্থ্যের জন্য কতটা ক্ষতিকর ! অম্বলের কষ্ট অনুভব সম্ভবত জীবনে সেবারই প্রথম। গলা দিয়ে যে কীভাবে শিস্ উঠছিল ; বাপরে, মনে পড়লে ভয়ে কুঁকড়ে যাই এখনো !
অনেক -অনেক বছর পরে, ২০১০ সালে রবীন্দ্র সার্ধশতবর্ষে রংপুর, রাজশাহী ভ্রমণের সুযোগ হয়েছিল বাংলাদেশ সরকার এবং ‘বাংলাদেশ আবৃত্তি সমন্বয় পরিষদ’-এর কল্যাণে রবীন্দ্রনাথের কবিতার আবৃত্তি করতে। প্রথমেই রংপুর। উঠেছি সার্কিট হাউজে। গোসল করে খেয়ে তৈরি হয়ে বেরুবো মাত্র, প্রাঙ্গণে এসে দাঁড়াতেই বিধাতার আশীর্বাদ হয়ে গাছ থেকে একটা আম ঝরে পড়ল। স্থান-কাল-পাত্র-বয়স সÑব ভুলে, গাড়িতে না উঠে দৌড়ে গিয়ে আমটি কুড়িয়ে আনলাম। একে তো তাড়া, তার ওপর আমের বোঁটা থেকে তখনো কষ ঝরছে। কক্ষের তালা খুলে টেবিলের ওপর আমটি রেখে ঘর আটকে সদলবলে বেরিয়ে গেলাম।
রাতে সার্কিট হাউজে ফিরে তালা খুলে ঘরে ঢুকেই হতবাক ! একটিমাত্র মাঝারি আকারের আমের ঘ্রাণে সমস্ত ঘর মৌ মৌ ! দেখতেও কী আকর্ষণীয় ! এখন এটা খাই কী করে ? আমার তো শোকেসে সাজিয়ে রাখতে ইচ্ছে করছে। তারপরও, আনন্দ-বেদনার মিশ্র অনুভবে রাঙা হয়ে সেই ঘরে আশ্রয় পাওয়া তিন রমণী স্বাদ আর ঘ্রাণে মাখামাখি হয়ে হাতভরা সুগন্ধ নিয়ে ঘুমাতে গেলাম। আ-হা ; জীবন এত সুখের কেন !
সেবার রাজশাহীতে আমাদের জন্য অপেক্ষা করছিল আরেক বিস্ময় ! ‘রাজশাহী আবৃত্তি পরিষদ’র বিল্টু ভ্রমণসঙ্গী সবাইকেই দশ কেজি করে আম সৌজন্য উপহার দিলেন। উপরন্তু বাড়তি বিশ কেজি আম দিয়েছিলেন হাসান আরিফ এবং আহ্কামউল্লাহ্র জন্য। ওরা পথসঙ্গী হতে পারেনি বলে কি বঞ্চিতের দলে পড়বে ? ধন্যযোগ বিল্টু। ধন্য হলাম।
আম খাবে কি আম ?
আমের অনেক নাম !
ফলের রাজা আম খেলে হয়
শরীরটা উদ্দাম।
সারা দেশে আম পাওয়া যায়
গ্রীষ্ম এলে পরে
হোক তা কাঁচা, কিংবা পাকা
আম থাকে সব ঘরে।
আমটা দারুণ মুখরোচক
আমটা যে সুস্বাদু
আমে বাড়ে শরীরে বল
আমে আছে জাদু !
‘এ’ ভিটামিন, ‘বি’ ভিটামিন
‘সি’ ভিটামিন আছে
প্রোটিন, খনিজ, শ্বেতসারও পাই
আমরা আমের কাছে।
আম দিয়ে হয় মোরব্বা আর
আমসত্ত্ব, আচার
আমের জুস খুবই প্রিয়
সকল কচিকাঁচার।
২০ কেজিতে ৪৮ টা আম
রহিম শাহ’র লেখা ছড়াটা মনে পড়ে গেল ‘বাংলাদেশ বেতার, ঢাকা’ প্রসঙ্গে ঢুকতে গিয়ে। কারণ, ভাতিজা আলীমের বেতারজীবনে বলা প্রথম ছড়া এটি। শিশুদের জন্য শুক্রবারের সজীব অনুষ্ঠান ‘কলকাকলি’র ‘ফুলপাখিদের আসর’-এ এই ছড়াটি আবৃত্তি করেছিল ও শৈশবে। আমারই সংগ্রহ ও আগ্রহে ‘আম’ শীর্ষক ছড়াটি মুখস্থ করেছিল ও। কারণ, তখন চলছিল গ্রীষ্মকাল।
বাংলাদেশ বেতার, আগারগাঁর আমগাছে প্রতিবছরই আম ধরতে দেখি। ১৯৯৪ সাল থেকে আসছি-যাচ্ছি। যে ঘটনাটা লিখব বলে মনস্থির করেছি, সেটা ২০১৬ সালের কথা। এর আগে গাছের আম কোনোদিন আলাদা করে খেয়ালও করিনি আর কোনোদিন কপালেও উড়ে এসে জোটেনি। অপেক্ষারত গাড়ির চালকেরা অনেকসময় ঢিল মেরে কাঁচা আমই পেড়ে খায় ; সে আমি সইতে পারিনে। তোমরাই তো খাবে ; বড়ো হলে বা বড়ো করে খাও ! কী দরকার কষ্টা আম খাওয়ার ? না আছে মুখের সুখ ; না পেটের।
২০১৬ সালের কোনো একদিন ‘হোম সার্ভিস’-এ ঢুকতে গিয়ে গুটিকয়েক অপুষ্ট আর অকালপক্ব আম কুড়ানোর সুযোগ হলো। সেদিন উপরে তাকিয়ে গাছে প্রমাণসংখ্যক আম ঝুলে থাকতে দেখে, মানে, সত্যিকার অর্থে, গাছের আম গাছেই আছে দেখে মনে আশার সঞ্চার হলো যে, বোধহয় এ বছর ভাগ্যের শিকে ছিঁড়বে !
কেন আমি এরকম ভেবেছি, এ কথার কী ব্যাখ্যা কীভাবে দেব ? আম কিনে খাবার সামর্থ্য তো সেই আড়াই যুগ আগে থেকেই হয়েছে। তবে খেয়াল করেছি, কেনা আম খেয়ে তৃপ্তি খুব কমই পেয়েছি ; তা সে যার টাকাতেই কেনা হোক না কেন। উপরন্তু, মনে আসন গেঁড়ে বসেছে ফরমালিন আর কার্বাইডের ভয়। সেই মনের বাঘও হয়ত-বা প্রকৃত সুখ পাওয়া থেকে বঞ্চিত করে ; কে জানে ?
যাই হোক, যে কথায় ছিলাম... বাংলাদেশ বেতারে যেহেতু গড়ে সপ্তাহে অন্তত দু’দিন ক’রে যাওয়া হয়, তাই কাচের দরজা ঠেলে ভেতরে ঢোকার আগে এবং কাজ শেষে বেরিয়ে যাওয়ার প্রান্তে ইচ্ছে করেই মাথা বাড়িয়ে দেখে নিতাম গাছে আম ঠিকঠাক ঝুলছে তো ? অথবা, গাছের নিচে কোনো গাছপাকা আম পড়ল কি ? নাহ্, সে আশায় গুড়েবালি ! হঠাৎ একদিন চোখে পড়ল বআরে, আমগাছের নিচে দেখি একজন প্রহরীও বসে আছেন ! যাক্, স্বস্তি পাওয়া গেল। কী যে ছেলেমানুষ আমি এ বয়সেও !
আমার অকারণ দুশ্চিন্তা আর ফিরে ফিরে তাকানো তো দূর হলো। কিন্তু শৈশবের একটা ঘটনা মনে পড়ল। যৌথ পরিবারে বেড়ে উঠছিলাম। আমার প্রাক-শৈশবেই আব্বা অবসরে চলে গেছেন। সুতরাং, ইচ্ছের সঙ্গে প্রাপ্তির সংযোগ দুর্লভ ছিল। ওইসময় কখনো ভাবতেই পারতাম না যে, একটা ফজলি আম কেউ গোটা একা খেয়ে ফেলতে পারে। একদিন যখন দেখলাম, দুলাভাই এনেছেন বলে ভাগ্নি রত [সাত বছুরে] তা-ই খাচ্ছে, মনে আছে, আমিসুদ্ধ বাড়ির অন্যান্য শিশু হতবাক হয়ে দেখছিলাম আর ভাবছিলাম এ-ও কি সত্যিই সম্ভব !
আরো দুটো অন্যরকম ঘটনার কথাও বলি। সেজাপিরা একসময় ধানমন্ডি পাঁচ নম্বরে সচিবদের কোয়ার্টারে থাকতেন। সেজাপিদের শোবার ঘর-সংলগ্ন বারান্দায় পিছনের কোয়ার্টারের আমগাছে আম ঝুলছিল। বাসায় সদস্য সংখ্যা চার। দুলাভাই, সেজাপি, কিশোর আদীব আর কাজে সাহায্যকারী মহিলা। বিস্ময়কর হলেও সত্য, চারজনের কেউই সেই সরকারি আম কাঁচা কি পাকা অবস্থায় ছুঁয়েও দেখেনি ! যেদিন পিছনের বাড়ির সদস্যরা লোক ডাকিয়ে আয়োজন করে আম পাড়ান, সেদিনও সেজাপি বারান্দা থেকে অনায়াসে হাত দিয়ে আমগুলো পেড়ে ওঁদের হাতে তুলে দেন। এই উদারতায় মুগ্ধ হয়ে অবশ্য সেই বাড়ির কর্তা-গিন্নি গোটাকয়েক আম সেজাপিদের উপহারস্বরূপ দিয়ে গিয়েছিলেন। এখনো ব্যাপারটা মনে পড়লে মাথায় তাল-গোল পাকিয়ে যায়। কারণ আমি জানি, সরকারি গাছের আম, যেগুলো ওদের বারান্দার সীমানায় ঝুলছে ; সেগুলো ওদেরই প্রাপ্য। তাছাড়া, সেজাপি-দুলাভাই নিয়মিত আম কিনে খান এবং খাওয়ান। আম ওঁদের খুবই প্রিয় ফল। ঘটনাটা ২০০৩ সালের।
দ্বিতীয় ঘটনাটা ঘটেছে ২০১৫ সালে। সেটা আরো চমকপ্রদ। তখন গাইবান্ধা শহরে জুলফিকার চঞ্চলদা যে বাসায় ভাড়া থাকতেন, তার সঙ্গের বাসাটিই ওয়াপদার অফিস। সেই অফিসের একটি আমগাছ বেশ কিছু ডালপালাসহ সঙ্গের বাসার একতলার ছাদের একাংশ দখল করেছে। সেই ডালে আমও ধরেছে। বেশ বড়ো বড়ো, ফজলি আমের মতোই আকৃতি। আমি কাঁচা দেখে এসেছি একবার আবৃত্তির ক্লাস নিতে গিয়ে। পরের মাসে গিয়ে সে আমের খোঁজ করতে গিয়ে যা শুনলাম, তা অভিনব ! ওই বাড়ির সদস্য তখন বাড়িওয়ালারা চারজন আর ভাড়াটিয়া অর্থাৎ চঞ্চলদা’রা তিনজন। দু’বাসায়ই কিশোর ছেলে আছে। বাড়িওয়ালার মেয়ে আছে কিশোরী। কেউই ছাদে এসে গাছের আমে হাত দেয়নি। আম পাকার পর মধ্যবিত্ত বাড়িওয়ালা [শাড়ির দোকানি] নিজের হাতে আমগুলো পেড়ে ওয়াপদা অফিসে দিয়ে এসেছেন। তখন সেই অফিসের লোকজন গোটা চারেক আম তাঁকে ফেরৎ দিয়েছেন খেতে। সেখান থেকে দুটো আম চঞ্চলদা’দের দিয়ে দু’টো তিনি নিজে রেখেছেন। কে বলে দুনিয়ায় মানবিক মানুষ নেই ?
ফিরে আসা যাক ‘বাংলাদেশ বেতার’র আমগাছের আম প্রসঙ্গে। ২০১৬-র মে মাসের প্রথম সোমবার বেলা তিনটার খবর পড়ে বেরিয়ে আসছি, চোখে পড়ল, লোক লাগিয়ে আম পাড়া হচ্ছে। সে কী ! গাছের আম তো এখনো কাঁচা ! গাছে তিনজন চড়েছে। নিচে ৪-৫জন দাঁড়িয়ে পাহারা দিচ্ছে। আশেপাশে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আরো কয়েকজন চটের ছালা নিয়ে দাঁড়িয়ে। নিজের বয়স-অবস্থান-অভিজ্ঞতা সব ভুলে এগিয়ে গেলাম। পরিচিত একজনকে দেখতে পেয়ে চিৎকার করে উঠলাম আম এখনই পাড়ছেন কেন ? আমগুলো তো পাকেনি !
যে-লোক সদর দরজায় দাঁড়িয়ে থাকা অবস্থায় আসতে-যেতে সালাম ঠোকে, সে এমন অদ্ভুত দৃষ্টিতে আমার পানে চাইল যেন ভূত দেখছে। তারপর সে দৃষ্টিটাকে এমন বাঁকা করল, যার অর্থ, আমি কেন এখানে দাঁড়িয়ে ! আর মুখ ফসকে বেরিয়ে যাওয়া কথাটি বলে ঘোরতর কোনো অন্যায় করে ফেলেছি। লোকটার হাবভাব এমন, যেন সে ‘একদিনের রাজা’ বনে গেছে ! আমাকে কেউ পাত্তাই দিচ্ছে না। আমি কে ? এখানে কেন এসেছি ! [আসলেই তো, কী হয়েছিল আমার ? আমার কি বাহ্যজ্ঞান লোপ পেয়েছিল সেদিন ! আত্মবিস্মৃত হয়ে কেন পায়ে-পায়ে এগিয়ে গিয়েছিলাম ? ধিক্ নিজেকে ‘ঝিকে মেরে বউকে শেখানো’র মতোই সেই লোকটা, মানে একদিনের রাজা, একপর্যায়ে সেখানকার পিয়ন গোছের কোনো একজনকে প্রায় অর্ধচন্দ্র দিয়ে বের করে দিল। সেই অর্ধচন্দ্র খাওয়া লোকটিও করল কি, আমগাছের তলা ছেড়ে যাওয়ার আগে আশেপাশে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা কয়েকটি আম কুড়িয়ে নিয়ে ছালায় ফেলে দিয়ে চলে গেল। ভাবখানা এই যেন, ‘তোমরা আমাকে যা ভাবছ, আমি তো তা নই। আমি তো এসেছিলাম তোমাদের সাহায্য করতেই ...! তো-ম-রা, মানুষ চিনলে না হে !
হঠাৎ ঘটে যাওয়া ঘটনার ধাক্কা সামলে উঠে নির্বাক হয়ে একটু দূরে দাঁড়িয়েছিলাম। চলে যাওয়া পিয়নগোছের লোকটি যখন ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা আম কুড়াচ্ছিল, তখনই চোখে পড়েছিল, নষ্ট হয়ে পড়ে থাকা একটা গাড়ির চাকার নিচে একটা আম আট্কে আছে। আপাতত আমি ছাড়া আর কারও নজরে পড়েনি আমটি। নেব না কি ?
লোকটা চলে গেছে। একদিনের বাদশাহ্ নিজ কাজে মন দিয়েছে। আমি মূর্তিবৎ, যেন নির্বাক প্রস্তরফলক ! নেব, কি নেব না ? কী হয়েছে আমার হঠাৎ করে ? কী করব এখন আমি ? প্রচ- লজ্জা স্বীকার করেই সরল স্বীকারোক্তি করছি কী যে ইচ্ছে করছিল আমটা নিতে আমার, সে কেমন করে বলি ? সেইক্ষণে মন যুক্তি দাঁড় করাচ্ছিল এতবছর ধরে এখানে কাজ করছ, এ আমে কি তোমার একটুও অধিকার নেই ? একটা মাত্র ছোট্ট আম নিলে কি খুব বড়ো অন্যায় করা হবে ? ওরা তো এখন অন্যমনস্ক। টেরও পাবে না। নিয়েই নিই।
আমটা নিতে পা বাড়াবো মাত্র... তখনই ‘আমার আমি’ আমার সঙ্গে কথা বলে উঠল তুমি কি ভিক্ষুক ? কেন নিজেকে অপদস্ত করবে ? জীবনে তো অনেককিছুই যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও পাওনি। সেসব নিয়ে তো কখনো তোমাকে আফসোস করতে দেখি না। ইচ্ছে করেও তো প্রাপ্য বা প্রাপ্ত অনেককিছু ফিরিয়ে দিয়েছ। তাহলে ? আজ কী হলো তোমার ? সামান্য একটা ছোট্ট আমের লোভের কাছে নতি স্বীকার করবে ? নিজের কাছে নিজে ছোটো হয়ো না আত্মসংবরণ করো ; ফিরে চলো।
চললাম ফিরে ভারাক্রান্ত মনে। মূল ফটক পেরিয়ে রাস্তা পার হয়ে ‘নিসর্গ’ বাসের জন্য দাঁড়াতেই আনমনে চোখ চলে গেল আমগাছের শূন্য চুড়োয়।
মে মাসেরই ১৯ তারিখে গাইবান্ধা যাওয়া হলো। পৌঁছে, গোসল করে বেরুতেই মৌসুমী ভাবি তাঁদের ‘বাড়ির গাছের আম’ কেটে দিলেন খেতে। পরদিন সকালে দারিয়াপুরে আবৃত্তি ক্লাস চলাকালীন সংলগ্ন উঠোনে পাশের আমগাছ থেকে দুটো আম পড়ল। সিঁদুরে আম। পঞ্চম শ্রেণির ছাত্র প্রসেনজিৎ, দুটি চোখের তারায় ঝিকিমিকি আনন্দ নিয়ে ডগোমগো হয়ে বলল, ‘ম্যাডাম, আপনার ভাগ্য কী ভালো ; আম পড়ছে !’
বুঝলাম না ! এই মহড়া কক্ষে ছোটো-বড়ো মিলিয়ে গোটা চল্লিশেক মানুষ আসে-যায়। এঁদের মধ্যে একা আমার ভাগ্য ভালো হওয়ার কী হলো ? কুড়িয়ে পাওয়া আমের দাবিদার তো সকলেই।
এক ফাঁকে চঞ্চলদাকে জিজ্ঞাসা করে জানা গেল, ‘সারথি চত্বর’-এর আমগাছ থেকে যখনই আম পড়েছে, প্রসেনজিৎ কুড়িয়ে নিয়ে, ধুয়ে, ঝুড়িতে জমিয়েছে ; একদিন সকলে মিলে একসঙ্গে খাবে বলে। শিশুটির বোধের জায়গাটিকে স্পর্শ করে বাকি সকলেই নীরব সমর্থন জানিয়েছে। যেহেতু আমি ঢাকা থেকে গেছি। আমার চোখের সামনে আম পড়েছে। তাই, এ আম নাকি আমার ! অথচ আম পড়ার পরিচিত শব্দে সোল্লাসে গোটা ক্লাস মেতে উঠেছে হাততালি দিয়ে ! এই আনন্দে শহরের অ্যাপার্টমেন্ট বা ফ্ল্যাট নামের খাঁচায় বড়ো হওয়া শিশুরা জীবনেও অনুভব করবে কি ?
সেদিন দুপুরের খাবারের পর প্রসেনজিতের কুড়ানো একঝুড়ি আম কেটে সবাইকে বেঁটে দেওয়া হলো। সন্ধ্যায় অনুষ্ঠান দেখতে আসা নূপুরের দাদি চুপিচুপি আমার হাতে একটা আম তুলে দিয়ে বললেন, ‘আসপার সময়ই গাছ থিকা পড়ল। ইটা আপনি খাবেন। কাউক দিবান না।’ ঢাকায় ফেরার আগের রাতে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের এক স্বাবলম্বী ছাত্র মিলন একটা ব্যাগ ধরিয়ে দিল হাতে, নিজেদের বাড়ির গাছের আম ভরা। চঞ্চলদার বাসায় চারটা রেখে, বাকিগুলো নিয়ে ঢাকা পৌঁছলাম। সেদিনই ছিল শব-ই-বরাত। স্বজনদের বিলিয়ে দিয়ে নিজেও তৃপ্তিভরে খেলাম ‘গাছপাকা রসালো আম’।
দারিয়াপুরে আবৃত্তির ক্লাস
ঘটনার শেষ এখানেই নয়।
১৪ই জুন বেলা সাড়ে বারটার দিকে ‘কথাপ্রকাশ’ প্রকাশনী থেকে নজরুল নামে কোনো এক ভদ্রলোক ফোন করে যা জানালেন এবং জানতে চাইলেন তার সারকথা হলো : কথাপ্রকাশ-র মালিক আমবাগান কিনে প্রতিবছর তাঁর পরিচিতজন এবং তালিকাভুক্ত লেখকদের দশ কেজি করে আম উপহার দেন। সে সূত্রেই বাসার ঠিকানা জানতে চেয়েছেন, আম পৌঁছে দিতে।
জানতে চাইলাম, ‘আমার ফোন নম্বর পেলেন কোথায় ? আমি তো ঠিক সে অর্থে কোনো তালিকাতেই নাই।’
‘ইকবাল খোরশেদ ভাইয়ের কাছ থেকে নিয়েছি।’
প্রসঙ্গত উল্লেখ করা যেতেই পারে, কথাপ্রকাশ’র ‘জনকের মুখ’ বইয়ের প্রকাশনা উৎসবে আমি আবৃত্তি আর পাঠ করেছিলাম। সে সূত্রেই প্রাথমিক পরিচয়। তাই, মনে কোনো দ্ধিধা না রেখে সঙ্গে সঙ্গেই জানিয়ে দিলাম, ‘দেখুন, আমার তো কোনো বই এখনো বেরোয়নি, আগে বই ছাপা হোক ; তারপর না হয় আম নেওয়া যাবে।’
অদ্ভুত ব্যাপার, সেদিন বেতারভবনের মাত্র একটি আমের লোভ সামলাতে কী বেগটাই না পেতে হয়েছিল ! অথচ আজ ? দশ কেজি আম কত অনায়াসে ফিরিয়ে দিতে পারলাম ; যেন বা হরহামেশাই এরকম ঘটনা ঘটে থাকে আমার জীবনে ! উপহার নেওয়া যায় এতটা পূর্ব-পরিচয় যাঁদের সঙ্গে নেই ; কেন নেব তাঁদের দেওয়া আম ? গল্প-পাঠ আর আবৃত্তি করতে গিয়ে আনুষ্ঠানিক পরিচয় হয়েছিল মাত্র বছরখানেক আগে। এই সামান্য কারণে অসামান্য উপহার নগণ্য আমি নিতে পারি না। বোধ আর নীতি সমর্থন করে না বিষয়টা। যাই হোক, এটা কোনো ব্যাপার না। তবে এটুকু উপলব্ধি হলো যে, মানুষ নিজেই নিজের কাছে এক বিস্ময়সূচক-প্রশ্নবোধক চিহ্ন হয়ে দাঁড়ায় কখনো কখনো। মন যে কখন কী বায়না ধরে শরীরটাকে কোন বেকায়দা পরিস্থিতির সামনে নিয়ে দাঁড় করাবে, আগে থেকে টের পাওয়া মুশকিল !
যাকগে, প্রায়ই একটা কথা নিজেই নিজেকে বলি প্রাকৃতিক প্রতিশোধ। আম নিয়ে পরপর ঘটে যাওয়া এই ঘটনাগুলোকে কী বলব ? প্রকৃতির পুরস্কার ? না কি প্রকৃতির অনুদান ?
সে রাতেই কবি সাবেদ-আল-সাদ ফোন করে কুশল বিনিময়ের পর জানতে চাইলেন মাহমুদা, রংপুরের হাঁড়িভাঙা আম নেবেন না কি ?
হ্যাঁ নেব, যদি আপনি দাম দিতে দেন।
সে আপনার মর্জি ...
সুন্দরবন ক্যুরিয়ার সার্ভিসের মাধ্যমে চলে এল আম ঠিক দু’দিন পরেই। ২০ কেজিতে ৪৮টা আম। ধানমন্ডি ১৫ নম্বর মীনাবাজারের আন্ডারগ্রাউন্ডে, সুন্দরবনের অফিস কাম গোডাউন থেকে নিয়ে এলাম বাসায়। ভাগ্য ভালো, সেদিনই পাশেই ভাগ্নের বাসায় মিলাদ ছিল। বাড়ি বাড়ি গিয়ে আর পৌঁছে দিতে হয়নি আম। এক বাসাতেই সকলকে পাওয়া গিয়েছিল। পরিবারপ্রতি গড়ে তিনটা করে আম বণ্টন করা গেছে। আর সাবেদভাই আমাকে কথার প্যাঁচে কুপোকাৎ করে আমের কোনো বিনিময়মূল্য নেননি।
এ ঘটনাগুলো মনবাক্সেই বন্দি ছিল। তার পরও কাকতালীয়ভাবে, বাংলাদেশ বেতারের পিয়ন বাবুলভাই ১৪২৬ বঙ্গাব্দের ২৩-এ বৈশাখ, সোমবার হঠাৎ করেই, একটু গোপনে, ছয়টি কাঁচা আম তুলে দিলেন হাতে। বাবুল ভাইয়ের কাছ থেকে নিয়মিত শাক আর ডাঁটা কিনতাম। ডাঁটার হালুয়া খাইয়েছিলাম কোনো এক বছর। সে কারণেই এই ‘ভালোবাসার উপহার’ কিনা ; কে জানে ? বাসায় কুমিল্লা এবং ছাগলনাইয়া থেকে আসা কাঁচা আম আছে যথেষ্ট পরিমাণেই। আমি কাঁচা আমের সৌখিন খাদকও নই। কিন্তু নিঃস্বার্থ ভালোবাসার উপহার ফিরিয়ে দিতে হয় না বলেই খুশিমনে এবার বয়ে নিয়ে এলাম বাসায় এক আঁজলা সুখ।
দেখা যাচ্ছে, বঞ্চনার চেয়ে প্রাপ্তিযোগ বেশি। তাই, কলম এখানেই থামাতে চেয়েছিলাম। কিন্তু ২৯-এ জুন মঙ্গলবার, বাংলাদেশ বেতার-এ ধারাবাহিক ভাষা শেখার অনুষ্ঠান ‘আমার বাংলা ভাষা’র বাণীবদ্ধকরণে গিয়ে ঘটলো এক মজার ঘটনা।
সবে বাণীবদ্ধকরণ শুরু হয়েছে। সঞ্চালক ইকবাল খোরশেদ সাদর সম্ভাষণ জানানোর পর শিক্ষার্থীকে জিজ্ঞাসা করছেন, “মাসতুরাৎ, তুমি ‘কলাবউ’ শব্দের অর্থ জান এমন সময় আমার মুঠোফোনের কলধ্বনি শোনা গেল। তাড়াহুড়োয় বন্ধ করতে ভুলে গিয়েছিলাম। লজ্জায় জিভ কেটে মুঠোফোনের ‘স্পিকার’ বোতাম চেপে কথা শুরু করলাম। অপরপ্রান্তের কণ্ঠস্বর স্টুডিওর সকলের চেনা তিনি বাংলাদেশ বেতারের উপ-পরিচালক শাবানা হক। শাবানা আপা কলকলিয়ে বললেন, “আপনি কি রেকর্ডিং শেষ করে একটু আসবেন ? আপনার জন্য একটা ‘কলাআম’ এনেছিলাম। ... গতকালও ওঁ এমন একটা ‘হাঁড়িভাঙা আম’ উপহার দিয়েছিলেন, যেটা কেটে বাসার পাঁচজন তৃপ্তিভরে খেতে পেরেছি ; এমনই বিশাল।
বোঝাই যাচ্ছে এ গল্প ফুরাবার নয়। চলছেই...। চলবেই...।
লেখক : আবৃত্তিকর্মী