‘ছড়া’ উদ্ধার : মাহমুদা আখতার

06 May 2021, 09:53 PM মুক্তগদ্য শেয়ার:

ছড়া - কোথায় ? ছড়া - কোথায় ?

কোথায় আমার ছড়া ?

বলতে বলতে গলায় তোমার

আওয়াজ হলো চড়া।


সে তো ঠিকই, ছড়া তো চাই ;

কিন্তু কীসের ছড়া ?

ছড়া তো হয় হরেকরকম

শব্দ দিয়ে গড়া।


মাঠে গেলেই ধানের ছড়া,

গলায় মালার ছড়া,

বাজার থেকে মা-তো আনেই

কলারও এক ছড়া।


সে-সব ছড়া নয়, তা জানি।

ভোরের সুখে ভরা,

মুখে তোমার পড়–ক এসে

‘প্রথম আলোর ছড়া’।

শঙ্খ ঘোষের এ-ছড়ায় যে-সব ছড়ার কথা বলা হয়েছে, এর বাইরেও ‘ছড়া’ রয়েছে। তরল গোবর বা ছড়ে যাওয়া অর্থেও ‘ছড়া’ হয়। এছাড়াও, পার্বত্য অঞ্চলের ঝরনাও স্থানীয় কথ্যভাষায় ‘ছড়া’। শোনা যায়, ছড়িয়ে থাকে বলেই নাকি ছন্দবদ্ধ পঙ্ক্তিমালার নাম হয়েছে ‘ছড়া’। ছড়িয়ে থাকা ছড়া কুড়িয়ে নিয়ে আমরা স্ব স্ব প্রয়োজনে ব্যবহার করি।


***


সাল-তারিখ-প্রয়োজন কিছুই মনে নেই। শুধু মনে আছে, তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিসএসসিতে নিয়মিত যাতায়াত ছিল। মুক্তধারা সংস্কৃতি চর্চা কেন্দ্র-র সভ্য হয়ে মহড়া করতে যেতাম। বাড়তি কর্তব্য হিসেবে পালন করতে হতো অর্থসম্পাদকের দায়িত্ব। সে-সময় একদিন কোনো এক দায়িত্ব পালন শেষে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানসংলগ্ন হাঁটার রাস্তা ধরে সাধারণ সম্পাদক [আদর] আর আমি হেঁটে ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্রে ফিরছি। হঠাৎ ওঁ উবু হয়ে কোনো একটি পত্রিকার পড়ে থাকা ছেঁড়া একটি পৃষ্ঠা কুড়িয়ে নিয়ে একটু তাকিয়েই পৃষ্ঠাটি আমার হাতে অর্পণ করে বললেন, ‘আপনি না পত্রিকা থেকে টা-টাট্কা রচনা আবৃত্তি করেন ? এই নিন। দেখুন, পছন্দ হয় কি না।’

চটজলদি দেখি, অলঙ্করণসহ একটি প্রাণবন্ত ছড়া তাকিয়ে আছে আমার পানে। একনজরেই পছন্দ হয়ে গেল। কাঁধের ঝোলায় পুরে নিলাম পৃষ্ঠাটি ধুলা ঝেড়ে। প্রথম চারটি চরণ একবার দেখেই মনে গেঁথে গেল, যদিও ছড়াকার তো বটেই তাঁর নামটিও একেবারেই অচেনা।

আছে। ছড়াটা ওভাবেই ডায়েরির ভাঁজে ঘুমিয়ে আছে। আমি দেখতে চাইলে ও-ও চোখ মেলছে। সুযোগ খুঁজছি কাজে লাগানোর। সুযোগ মিলছে না। এভাবে কয়েক মাস না বছর পেরিয়ে গেল বলতে পারব না। হঠাৎই এল সুযোগ। বিশদভাবে মনে পড়ছে না কিছুই। শুধু মনে আছে, কোনো একটি অনুষ্ঠানের জন্য [নববর্ষের হতে পারে] টিএসসি’র বারান্দায় মহড়ায় বসেছি। বৃন্দআবৃত্তি ছাড়াও একক-আবৃত্তি কে কোনটা করবে ঠিক করা হচ্ছে। সে-সময় ‘হঠাৎ আলোর ঝলকানি’র মতো মনে পড়ল কুড়িয়ে পাওয়া ছড়াটার কথা। স্মৃতি হাতড়ে প্রথম চারচরণ শোনালাম। ঠিক হলো, আগামীকাল কাগজটা নিয়ে এসে দেখাবো- শোনাবো।

আনা হলো পরদিন। সেদিন মহড়া করার জন্য কক্ষ তো দূরের কথা, বারান্দাতেও জায়গা নেই। অগত্যা বসলাম মাঠে। সবাই সবার থলে ঝেড়ে দেখাচ্ছি একক আবৃত্তি করার মতো কার কাছে কী আছে। দলের এক জুনিয়র মেয়ে মণি, যে কিনা আবার আমার দূরবর্তী প্রতিবেশী, ছড়াটি শোনামাত্র স্থান-কাল-পাত্র ভুলে উচ্চরবে হেসে উঠে আবদার জুড়ল- মাহমুদা আপি, ছড়াটি আমাকে দিয়ে দিন ; প্লিজ-প্লিজ-প্লিজ। আশেপাশের সবাই মাথা ঘুরিয়ে তাকাচ্ছে। আমি তো কিছুতেই দেবো না। মণিও নাছোড়বান্দা- নিয়ে ছাড়বেই। ‘এটা আমাকে না দিলে আজকেই বাসায় যাওয়ার পথে চুরি করব, আপনি টেরও পাবেন না।’ ‘পারলে করো।’ ‘এমন করেন কেন ? বড়ো বোনেরা ছোটোদের জন্য স্যাক্রিফাইজ করে না ? এই অনুষ্ঠানে আমি পড়ি। পরে অন্য কোনো অনুষ্ঠানের জন্য আপনার দুয়ার তো খোলাই রইল।’ ‘ইস্ ! খুঁজে পেলেন আদর। হ্যাঁ, বলতেই হচ্ছে যে, ছড়াটা নিঃসন্দেহে মনকাড়া। চাইলে ওঁ চাইতে পারতেন। ওর বদলে তুমি এরকম করছ কেন ?’

‘আপনার জায়গায় আমি হলে এতক্ষণে দিয়ে দিতাম, এতবার চাইতেও হতো না। আদর ভাইয়া, কিছু বলছেন না কেন ?’

‘ভাই, এটা এখন আমার সম্পত্তি না। আমি তো সম্প্রদান করেছি। দেওয়া-না-দেওয়া এখন উনার স্বাধীনতা।’

‘ঘোড়ার ডিম!’ মরিয়া হয়ে মণি এরপর হাসতে হাসতেই বাজে বকতে লাগল। মহড়া লাটে, মাথায় উঠল। 

ফেরার পথে বাসে এবং চলতি পথে অনবরত ঘ্যান ঘ্যান করে মণি ত্যক্ত করে ছাড়ল। নিমরাজি সত্ত্বেও ওর প্যানপ্যানানিতে অতিষ্ঠ হয়েই রাস্তার মোড়ে এসে বললাম, ‘ঠিক আছে। দেবো তোমায়। তবে কালকে। আজ আমি বাসায় নিয়ে যাই। ফোটোকপি করে বা হাতে লিখে কাল দেবো। কারণ, এটার আর কোনো কপি নেই আমার কাছে।’

‘এই কষ্টটা আমি করব। আমাকে আজকেই দিয়ে দিন। আমি এটা লিখে রেখে আগামীকালই কাগজটা ফেরত দেবো। প্রোমিজ।’

‘আমাকে বিশ্বাস করছ না ? দেবো যখন বলেছি- দেবো।’

‘না, বিশ্বাস হচ্ছে না। বাসায় গিয়ে যদি মাইন্ড চেইঞ্জ হয়ে যায় ?’

কেন জানি না, পৃষ্ঠাটা হাতছাড়া করতে মন মানছিল না। তবুও মণির বাড়াবাড়িতে শেষ পর্যন্ত অনিচ্ছা সত্তে¡ও দিলাম। ‘ওহ্ থ্যাংক ইউ মাহমুদা আপি’ - উচ্ছ্বসিত মণি তিনরাস্তার মাথায় দাঁড়িয়ে আবারও সোল্লাসে জনগণকে সচকিত করে চিৎকার দিয়ে উঠল।


***


শংকর দিয়েই যেতে-আসতে হয়। আমি তাই বাসা থেকে বেরিয়ে প্রথমে সামান্য উণ্টো ঘুরে মণিদের বাসায় যাই। ওরা দু’বোন যুক্ত হয় পথসঙ্গী হিসেবে। একসঙ্গে গেলে পথের ক্লান্তি নাশ হয়। যদিও তখন যানজট ছিল না, তবে সকলেই ছিলাম ছাত্রী। হাতখরচ জোগাড় করতে তিনজনই টিউশনি করতাম। বাসা থেকে বেরিয়ে এবং বাস থেকে নেমে বেশ খানিকটা হাঁটতে হতো। তাই পথসঙ্গী পেলে যাত্রাটা অনায়াস হতো।

তো, পরদিন ওদের বাসায় গিয়ে দেখি শুধু রাবেয়া তৈরি হয়ে অপেক্ষমাণ। মণি নেই। আমাকে দেখে রাবেয়া বলল, ‘মণি আপনার ভয়ে বাসা থেকে পালিয়েছে।’ কিন্তুু কেন ? ‘ও লেখার জন্য ছড়াটা ব্যাগ থেকে বের করে রেখেছে। রেখে, বাথরুমে গেছে। ফ্যানের বাতাসে পৃষ্ঠাটা উড়ে মেঝেতে লুটোপুটি খাচ্ছে। মা তো এ ব্যাপারে কিছুই জানেন না। উনি ঘরঝাড়– দিয়ে আর সব ময়লাসহ ওটাও ফেলে দিয়ে এসেছেন। মণি বাথরুম থেকে বেরিয়ে প্রথমে চিৎকার-চেঁচামেচি-ঝগড়া করে পাড়া মাথায় তুলেছে। তারপর কান্নাকাটি করে, এখন পালিয়েছে।’ হাসতে হাসতেই বলল রাবেয়া কথাগুলো। তার মনে, ছড়াটা ওকে টানেনি ! তাই নিরাসক্ত ও !

মাথায় বজ্রপাত হলো যেন। অধিক শোকে পাথর হয়ে গেলাম। কী করার আছে আমার ? কোন পত্রিকায়, কবে এটি ছাপা হয়েছিল ; জানি না। নবীন ছড়াকার কি না, কে জানে। প্রথম চারটি চরণ ছাড়া আর কোনো ক্লু-ও তো নেই হাতে বা মাথায়।


***


বছরের পর বছর গড়িয়েছে। আমি হাল ছাড়িনি। কোনো ছড়ার সঙ্কলন চোখে পড়লেই হাতে নিয়ে খুলে দেখেছি। কোনো ছড়াকারের সঙ্গে সখ্য হলে আগ বাড়িয়ে জানতে চেয়েছি সেই প্রথম চারচরণ শুনিয়ে- চেনেন ছড়াটা ? শুধু এই ছড়াটি পাওয়ার লোভে কোনোরকম সম্মানী দেবে না জেনেও একবার একটা ছড়াকারদের ছড়া পাঠের আসর সঞ্চালন করতে রাজি হয়েছিলাম। ভেবেছিলাম, সঞ্চালনার একপর্যায়ে নাটকীয়ভাবে বলব, ‘একটি হারানো বিজ্ঞপ্তি...।’ ওই একই দিনে কুমিল্লায় আবৃত্তির ক্লাস নেওয়ার ডাক পাওয়ায়, শেষ পর্যন্ত আর সঞ্চালনা করা হয়নি। অথচ অত্যন্ত দুঃখের বিষয়, অন্তিমমুহূর্তে জানানো হয়েছিল যে, অনিবার্য কারণে ক্লাসটিও হচ্ছে না। এ-ই হয় ; এরকমই হয়ে থাকে !

আখতার হুসেন, আলম তালুকদার [গত বছর করোনায় প্রয়াত], নাসের মাহমুদ, ইকবল খোরশেদ, শফিকুল ইসলাম বাহার, জাহীদ রেজা নূর, মু. সিদ্দিকুর রহমান পরভেজ- এরা প্রত্যেকেই ছড়া-কবিতা-আবৃত্তির ব্যাপারে নিবেদিতপ্রাণ। খোঁজ করলেই, খুঁজে দেন। বিশেষ করে দুটো ঘটনা বলা যেতেই পারে :


ঘটনা : এক 

তখন টাঙ্গাইলের ‘আনন্দপাঠ’-এ প্রতি মঙ্গলবার যাই। কায়সার ভাই ঠিক করলেন একটা চিত্র প্রদর্শনী করবেন। এর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে আনন্দপাঠ’র শিশুরা আবৃত্তি করবে-গাইবে-নাচবে। অনুষ্ঠানটির গ্রন্থনা এবং নির্দেশনার দায়িত্ব আমার। চলল বিস্তর খোঁজাখুঁজি। ছবি আঁকা বিষয়ে গান-কবিতা কোথায় কী আছে খুঁজে বের করতে হবে। মুঠোফোনে খোঁজ করা ছাড়াও শিশু একাডেমির গ্রন্থাগার, নীলক্ষেত, নিউমার্কেট চষে বেড়িয়েছি। গণ-গ্রন্থাগারের শিশুবিভাগ ঘুরে দেখেছি। নির্দিষ্ট একটি ছড়া [‘আঁকতে পারি-আবুল খায়ের মুসলেহউদ্দীন’] খুঁজতেই আমার এই দৌড়াদৌড়ি। আমি প্রযুক্তিবান্ধব নই। তাছাড়া ২০১২-২০১৩ সালে অনলাইনে বোধহয় এখনকার মতো এতকিছু পাওয়াও যেত না। পাওয়া গেলে নিশ্চয়ই জাহীদ রেজা নূর অন্তত যেভাবেই হোক খুঁজে বের করতেনই।

আলম তালুকদারকে তখনো আমি সশরীরে চিনি না। শফিকুল ইসলাম বাহার খোঁজ দিলেন। আর ইকবাল খোরশেদ দিলেন মুঠোফোন নম্বর। যোগাযোগ হলো। কী কারণে ছড়াটি খুঁজছি জানালাম। ঘণ্টাখানেক পরেই ওঁ গণগ্রন্থাগারের ল্যান্ড ফোন থেকে ফোন করেই বললেন- লেখেন। কৃতজ্ঞতায় চোখে পানি চলে এল।


ঘটনা : দুই

২০১৮ সাল। নূরুল ইসলাম মানিক একদিন ফোনে জানতে চাইলেন : এক পিঁপড়ে অনেক চেষ্টাতে, হায়, শেষটাতে... কৃষ্ণদয়াল বসুর এই পদ্যটা ছেলেবেলায় পড়েছেন না ? মনে আছে ?

: জ্বি না ; পড়িনি।

: পিঁপড়ে ও ঘুঘুপাখি... পড়েননি ? স্কুলপাঠ্য ছিল ?

: জ্বি না ; আমাদের আমলে ছিল না।

: একটু দেখুন না খোঁজ করে। আমি ইসলামিক ফাউন্ডেশন থেকে একটা সঙ্কলন বের করব নীতিকথা বা উপদেশমূলক কবিতার। সেখানে, এটা দিতে চাচ্ছি।

: আমিও তো শিশু-কিশোরদের জন্য একটা সঙ্কলন বের করব বলে ঠিক করেছি। মনিরুজ্জামান পলাশ ঠিক এই শিরোনামেই, একই ঘটনা নিয়ে লেখা একটি পদ্য জমা দিয়েছেন। পড়ে শোনাই ?

: আচ্ছা শোনান [কণ্ঠস্বরে র্গরাজি ভাব]।

: শোনালাম। ওঁ তিনটা ভুল ধরিয়ে দিলেন। বললেন, আপনি কৃষ্ণদয়াল বসুর কবিতাটাই খোঁজ করুন।

পলাশের পদ্যটায় আগেও দু’-চার জায়গা এদিক-ওদিক করতে হয়েছে। ওঁ বড়োদের কবিতা লেখে ভালো। সে তুলনায় ওঁর লেখা শিশুতোষ ছড়া-কবিতা-পদ্য রচনাভঙ্গির মান ঠিক ততটা নজরকাড়া নয়। তারপরও নিয়েছিলাম, গল্পটা স-বা-র জানা বলেই। নূরুল ইসলাম মানিক খুবই সূ² কিছু ভুল ধরিয়ে দেওয়ায় মনে হলো, কৃষ্ণদয়াল বসুর লেখাটার খোঁজ পেলে ভালোই হবে ; আমিও নিয়ে নেবো। পলাশের অন্য কবিতা তো নিয়েছিই।

চলল খোঁজ। জাহীদ রেজা নূর গড়গড়িয়ে দু’চরণ মুঠোফোনে শোনালেন। খোঁজ পেলে জানাবেন বলে জানালেন। তারপর নানান চাপে ভুলে গেলেন। আমার ‘অন্ধের যষ্টি’ আখতার হুসেন কিন্তু ভুললেন না। তিনি এঁকে-ওঁকে জিজ্ঞাসা করে জানতে পারলেন, মিজানুর রহমানের ত্রৈমাসিক পত্রিকায় পদ্যটি ছাপা হয়েছিল পুনরায়। মিজানুর রহমান যদিও ইহলোকে নেই কিন্তু তাঁর স্ত্রী বেঁচে আছেন। তিনি চাইলে এ বিষয়ে সাহায্য করতে পারেন। আখতার ভাই ফোন করে আমাকে তথ্যটুকু জানিয়ে যুক্ত করলেন, ‘আপনি কোনো চিন্তা করবেন না মাহমুদা। আমিই আপনাকে ভাবির ফোন নম্বর জোগাড় করে দেবো।’

বোধহয় ১০-১২ দিন পর, কোনো এক শুভদিনের বিকেলে গুটি-গুটি পায়ে, ধানমন্ডি ১৯ নম্বরে ‘কাশবন’ অ্যাপার্টমেন্টে গিয়ে, কেক-মিষ্টি খেয়ে, নূরজাহান আপার কাছ থেকে পদ্যটির ফোটোকপিসহ মিজানুর রহমানের ত্রৈমাসিক পত্রিকার অন্য একটি সংখ্যা শুভেচ্ছাস্বরূপ সৌজন্য উপহার নিয়ে বাড়ি ফিরলাম। নূরুল ইসলাম মানিক শেষ পর্যন্ত পদ্যটি কাজে লাগিয়েছেন কি না জানি না। কারণ, অন্য প্রকাশনায় জড়িয়ে পড়ায় কাক্সিক্ষত বইটি বের করতে পারেননি ইসলামিক ফাউন্ডেশন থেকে। তবে আমি ‘চয়নিকা’য় ‘পিঁপড়ে ও ঘুঘুপাখি’ পদ্যটি সযত্নে ছাপিয়েছি। শিশুদেরও শেখাচ্ছি।

ফিরে চলি মূল কথায়- কোথায় যেন ছিলাম... ? ও-হ্যাঁ, মনে পড়েছে। বিনাশর্তে যাঁরা আমাকে বিনিময়মূল্য ছাড়াই আবৃত্তি উপযোগী কোনো কিছু খুঁজে দিয়ে কৃতজ্ঞতাপাশে আবদ্ধ করেন, তাঁরাও বিফল হলেন আন্তরিকভাবে খুঁজেও। ধ্যাঁৎ-ছাই! পারবেন কী করে ? ততদিনে ছড়াকারের নামও যে গেছি ভুলে ! ছড়ার নাম তো ভুলেছি সেই কবেই। সম্বল শুধু প্রথম চার চরণ। তাও ভুলতে বসেছি প্রায়। বছর তো কম গড়ালো না।


***


২০১৯-এ পূর্বনির্ধারিত, সোমবারের বেলা তিনটার খবর পড়তে গিয়ে একদিন বাংলাদেশ বেতার’র এক ভালোমানুষ অনুবাদক ‘নাজিম’কে দেখলাম, ইন্টারনেটে ঢুঁ মেরে পুরনো কবিতা গান খুঁজে খুঁজে বের করছেন। আমায় আর পায় কে ? সঙ্গে সঙ্গে সেই ছড়াটির চার চরণ শুনিয়ে অনুরোধ করলাম- দেখুন না একটু খুঁজে। ওঁ কিছুক্ষণ ঘাঁটাঘাঁটি করে খুঁজে না পেয়ে বললেন, ‘প্রথম চার চরণ লিখে দিয়ে যান। আমি অবসরে খুঁজে রাখব। পরের সোমবার পেয়ে যাবেন’।

পরের সোমবার আমাকে দেখতে পেয়েই নাজিম বলে উঠলেন, ‘খুবই দুঃখিত। আপনার সেই ছড়াটি কিছুতেই খুঁজে পেলাম না’। 

চলছে করোনাকাল। গৃহবন্দি আমরা খাঁচায় আবদ্ধ পাখির মতো ছটফটিয়ে মরছি। ‘কিছুই ভালো লাগে না’ রোগে আক্রান্ত সবাই। যদিও, কিনে রেখে দেওয়া বইগুলো পড়ার অযাচিত সুযোগ এসেছে। রাবেয়া খাতুন, হুমায়ূন আহমেদ, মুহম্মদ জাফর ইকবাল প্রমুখ সঙ্গ দিচ্ছেন এই অফুরন্ত অবসরে। জমে থাকা সেলাই-ফোঁড়াইও চলছে। নেই মোটর সাইকেল, প্রাইভেট কারের অকারণ হর্নের উৎপাত। তাই, শ্রবণযন্ত্র শান্তিতেই আছে। প্রতিবেশী অনেকেই শৈশব-কৈশোরের দিনগুলোতে ফিরে গেছেন। ছাদে গিয়ে সপরিবারে আড্ডা দেওয়া, ঘুড়ি ওড়ানো, মুড়ি মাখানো খাওয়া চা সহযোগে- চলছে এসব। আমি দেখনদার। দেখেই সুখ। ‘দৃষ্টি প্রদীপ জে¦লে’ দেখছি দূরবর্তী প্রতিবেশীদের আর ভাবছি, করোনাকাল শেষ হলে যখন রাস্তায় দেখা হবে তখন বলব, ‘ভাই, চাইলে আপনি একজন অভিনেতা হতে পারেন ; এখনও।’ নাম না জানা সেই ভদ্রলোক যখন আমার এই উড়ে এসে জুড়ে বসা মন্তব্যে বিস্মিত হয়ে জানতে চাইবেন, ‘কেন - কেন ?!’ প্রতিউত্তরে বলব, ‘করোনাকালের প্রতি বিকেলে আপনি ছ’তলার ছাদের পানির ট্যাংকের ওপর বসে আপনার প্রতিবেশী বা বন্ধুর সঙ্গে যখন বিভিন্ন বিষয়ে আড্ডা দিতেন, আমি তখন দোয়া ইউনুস পড়তে পড়তে আমাদের তেতলার বারান্দা থেকে আপনাদের দেখতাম। আপনি যেভাবে হাত-পা ছুঁড়ে, নানারকম মুখভঙ্গি আর অঙ্গভঙ্গি করে বন্ধুকে নানান বিষয়ে বোঝাতে থাকতেন, তাতে প্রায় ২০ গজ দূর থেকে আপনার আঙ্গিক অভিনয় দেখতে আমার কোনোই সমস্যা হয়নি।’


***


মুঠোফোনে ‘কেমন আছেন, কী করছেন’ চলল কিছুদিন। তারপর অবস্থা দাঁড়াল ওই গানটির মতন- আমার দিন কাটে না, আমার রাত কাটে না। আয় রোজগার শূন্যের কোঠায়। অথচ দিনরাত চলে ভিখারির কোরাস- ও আম্মা, ও খালাম্মা ... বিষয়টা কী ? ওরা ‘ও আব্বা, ও বাবা’ বলে না কেন ! সব সম্বোধনই নারীবাচক কেন ? হকারের চিৎকারেও করুণ আর্তি, নয়ত বিরক্তির বীণ বাজে!


***


ক্যালেন্ডারের তারিখ ধরেই এল রমজান মাস। আমি ঠিক করলাম, প্রতিদিন সামান্য পরিমাণে হলেও জঞ্জাল পরিষ্কার করব। বই-খাতা-ডায়েরি-পত্রিকা-ম্যাগাজিন ঘেঁটে-বেছে তিনভাগ করছি। যেটা রাখবো না, ডাস্টবিনে ফেলছি। যেটা দান করবো, ব্যাগে ভরছি। যেটা বিক্রয়যোগ্য, সেটা স্টোররুমের কোণায় জমাচ্ছি আপাতত। ঘাঁটতে ঘাঁটতেই হঠাৎ একটা ছোট্ট ডায়েরি পেলাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের। সেজাপি পুষ্টিভবন’র রিসার্চ অফিসার ছিলেন। আমি আইআর-এ এমএড [সান্ধ্য] ভর্তি হওয়ায় সেজাপি পরপর দুবছর ওঁর ডায়েরি আমাকে ব্যবহার করতে দিয়েছিলেন। সেটা ২০০২-২০০৩ সালের কথা। তার মানে প্রায় ১৮ বছর আগের স্মৃতিচিহ্ন ! একবার মনে হলো, পাতা না উল্টেই ধরে ফেলে দিই ডাস্টবিনে। দেখতে গেলেই, প্রয়োজনীয় এটা-সেট চোখে পড়বে। তখন আর ডায়েরিটা ফেলা হবে না। দৈনন্দিন ব্যবহারের ডায়েরিতে আমি হঠাৎ দেখতে পাওয়া বাণী, ছড়া-কবিতা, সাংসারিক টিপ্স তুলে রাখি কেটে বা লিখে। এছাড়াও কবে কখন কোথায় যেতে হবে, কোন কাজ করতে হবে, কী কী কিনতে হবে, কোন খাতে কত আয় ব্যয় হলো এসব লেখা তো আছেই ; সে বলাই বাহুল্য।

ভাবনামতোই, মেঝেতে ফেলেও দিলাম ডায়েরিটা, ডাস্টবিনে ফেলার যোগ্য আর সব কাগজপত্রের সঙ্গে। হাতের কাজ শেষ হলে স্ত‚প করা কাগজ যথাস্থানে রাখতে গিয়ে মনে হলো -দে-খি-ই না একবার ডায়েরির পাতা উল্টে।


***


আলগা হাতে পাতা উল্টে যেতে যেতে ২৮-এ ফেব্রুয়ারি সোমবার নিজের লেখা একটা ছন্দোবদ্ধ শুভেচ্ছাবার্তা আবিষ্কার করলাম :

কে এলোরে ? হোঁদল দেখি!

সঙ্গে ওটা কে ?

কম্বলমোড়া ভোম্বলছোড়া

সঙ্গ ধরেছে!


বেশ-তা হলে, ভালোই হলো

নববর্ষ বর্তে গেল।...

তারপর আর নেই! তাৎক্ষণিক কোনো আবেগের বিস্ফোরণ আর কি! আবারও পৃষ্ঠা উল্টে যেতে যেতে একটা পৃষ্ঠায় এসে চোখের পলক আর পড়ে না-


উচ্চচিন্তা

খালেদ হোসাইন


চান্দা তো খুব পাতলা

আর মোটকু ভীষণ কাতলা

এসব ছেড়ে কী মাছ খাবি

তাই আমাকে বাতলা।...


কী বললি, তাড়া আছে খুব

পারবি না আর থাকতে

আবার এলে খেতেই হবে...


তারপর আর কিছু লেখা নেই। বিস্ময়ে-আনন্দে-উত্তেজনায় চড়–ই পাখির মতো ছটফট করতে থাকলাম ; যেন গুপ্তধন পেয়েছি! সুফি মুস্তাফিজুর রহমান স্যারের কল্যাণে খালেদ হোসাইন স্যারকে তো এখন আমি চিনি !

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলার অধ্যাপক, কবি খালেদ হোসাইনের একটি পদ্য আমাকে দিয়েছিলেন সুফি স্যার, ‘ভাই গিরিশচন্দ্র সেন স্মৃতি জাদুঘর’ উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে আবৃত্তি করার জন্য। সেটা ২০১৭ সালের কথা। শেষ পর্যন্ত যদিও নানান ঝামেলায় আড়ম্বর করে অনুষ্ঠানটি আর হয়নি। কিন্তু এই সূত্রে মুঠোফোনে খালিদ স্যারের সঙ্গে পরিচয় হয়েছে।


এত যে উত্তেজনা জমে আছে মনে, আবিষ্কারের আনন্দে মনটা ভরে আছে, এত বছর পর ছড়াটা তাহলে পাওয়া যাবে... উহ্ কত বছর হলো যেন ? আ-ঠা-র বছর ! আন্দাজ করতে পারছি, ছড়াটা যেন একেবারে ভুলে না যাই, সেজন্যই যেটুকু যেভাবে মনে আছে ছোট্ট ডায়েরিতে সেভাবেই স্মৃতি থেকে টুকে রেখেছি। তার মানে, ছড়াটা কুড়িয়ে পেয়েছিলাম আরও আগে। সে হিসেবে ১৯/২০ বছর আগের ঘটনা সেটা। কী আশ্চর্য ! এ-ত বছরেও আমার আগ্রহ মাঠে মারা যায়নি ? আমার আগ্রহের জোয়ারে ভাঁটা পড়েনি !

গ্রামীণফোনের আইটি বিভাগে কীসব ঝামেলার কারণে ৫/৬ মাস হলো নানারকম সমস্যায় ভুগছি। তার ওপর চলছে করোনাকাল। গৃহবন্দি। দেড় মাস হলো ফোনে টাকা ভরছি না ঝামেলা এড়াতে। সমস্যা নেই। ২০ বছর অপেক্ষা করতে পেরেছি, আর কয়েকটা দিন পারব না ?

মে মাসের ১৭ তারিখে, বিকেলে, হঠাৎ আমার মুঠোফোনে কে যেন ১০৯ টাকা পাঠালো। তখন ‘রেডিও ভূমি’-তে নাটক শুনছিলাম। নাটক শোনা শেষ হলে দেখি ভাগ্নে নাহিয়ানের মিস্ড কল দেখা যাচ্ছে। ওকে ফোন করে নিশ্চিত হলাম যে, এটা ওরই কীর্তি। ওর সঙ্গে কথা শেষ করেই খালেদ স্যারকে ফোন করলাম। ধরলেন না। কে জানে, ভুলে গেছেন কি না। বছর দুয়েক তো হবেই ; কোনো যোগাযোগ নেই।

সন্ধ্যায় ইফতার খাচ্ছি, তখন স্যার ফোন করে খুব পরিচিত কণ্ঠস্বরে বলে উঠলেন- কী, আপনার কোনো অনুষ্ঠান ; দেখতে হবে ? হঠাৎই মনে পড়লো, ‘রাঙা সকাল’ আর ‘জানার আছে বলার আছে’ দেখার অনুরোধ জানিয়ে স্যারকে মুঠোবার্তা পাঠিয়েছিলাম, তাই হয়ত...

: জ্বি না স্যার, এই করোনাকালে অনুষ্ঠান থাকবে কী করে ? অন্য কারণে ফোন করেছিলাম।... সংক্ষেপে, কারণটা জানালাম।

: আমাকে কোনো একটা ই-মেইল আইডি দিলে এক্ষুণি পাঠিয়ে দিচ্ছি।

ভাতিজা আলীমের ই-মেইল আইডি পেয়ে স্যার তৎক্ষণাৎ বই-এর পাতার ছবি তুলে ১২ স্তবকের ছড়াটি পাঠালেন। আমার মুঠোফোন স্মার্ট নয়। আমি তাই আলীমের মুঠোফোন দেখে প্রথমে আমার ফোনে বাণীবদ্ধ করে নিলাম। তারপর সেটা শুনে শুনে চলতি ডায়েরিতে লিখে রাখলাম। তারিখটা ১৭ই মে, ২০২০ রাতের প্রথম প্রহর। এবার মুখস্থ করার পালা।


***


মূল ছড়াটা উদ্ধার করার পর বুঝতে পারলাম, কেন লোকজন খুঁজে বের করতে পারেননি। এত বছরে স্মৃতিভ্রষ্ট হয়ে আমি ‘চান্দা’ মাছকে ‘ট্যাংরা’ মাছ বানিয়ে ফেলেছিলাম। অন্যান্য শব্দে চয়নেও যথেষ্ট ভুল ছিল। তার পরও শেষ পর্যন্ত পাওয়া যে গেল, এজন্য ভবিতব্যকে বলি- ধন্য হলাম। এখন অপেক্ষা- পস্থাপনের। দেখি, ক’দিন/মাস/বছর পর সে সুযোগ মেলে...


উচ্চচিন্তা

খালেদ হোসাইন


চান্দা তো খুব পাতলা এবং

মোট্কা ভীষণ কাত্লা,

বাজার থেকে আনবো কী মাছ

এক্ষুনি তুই বাত্লা।


চিংড়ি নাকি মৎসই নয়

চিংড়ি নাকি পোকা

তা-ই কেনে উচ্চমূল্যে-

মানুষ এত বোকা !


আনতে পারি ইলিশ

সাবধানে খুব গিলিশ

মাছের কাঁটা বিঁধলে গলায়

ঝক্কি হবে কথা বলায়

একটা বেড়াল পঙ্গু যে নয়

হাঁটতে পারে চার পা’য়

ধরতে হবে তার পায়।


আনতে পারি রুই

খাস না কি রে তুই ?

দেশি রুই যে যায় না পাওয়া

বাজারে কিচ্ছুই !

আনবো নাকি পাঙাশ ?

চক্ষু কেন রাঙাস্ !

বাজার থেকে কিনবো তবে

অন্যরকম মাছ কি :

এই যে যেমন কাচ্কি ?


কাচ্কি এত ছোট্ট, আহা-

এত্তটুকুন মাছে

আমার খুবই সন্দেহ হয়

ভিটামিন কি আছে ?


চিন্তা যদি করিস তবে

করবি এটা লক্ষ

ও মাছ খাওয়া, না-খাওয়াতে

নেই কোনো পার্থক্য।


তবু অনেক দিনের পরে

আজকে আমার ডেরাতে

তুই এসেছিস বেড়াতে।

আনবোই কিছু বাজার থেকে-

পারবি না রে ফেরাতে।


পণ্ডিতেরা অবশ্য কন- 

‘চিন্তা হলে উচ্চ,

খাদ্য এবং পোশাক নিয়ে

ভাবনাটা খুব তুচ্ছ।’


মহৎ হবার এ সাধনা

আমরাই তো করবো

আমরা দেশের সু-নাগরিক

ভবিষ্যতের গর্ব।


পান্তা আমার ঘরেই আছে

লঙ্কা না-হয় পুড়ছি

খাদ্য নিয়ে চিন্তা করে

মিছেই মাথা খুঁড়ছি।


কী বল্লি তুই, চলে যাবি,

বড্ড কাজের চাপ ?

ফের এলে তোর খেতেই হবে

করবো না রে মাফ ! 



লেখক : আবৃত্তিকর্মী