বসন্তকাল, দেশি গান, দেশি মুরগি আর ছোটো মাছ পছন্দ তার

02 Sep 2025, 02:37 PM সারেগারে শেয়ার:
বসন্তকাল, দেশি গান, দেশি মুরগি আর ছোটো মাছ পছন্দ তার


সংগীতশিল্পী মুর্শিদুজ্জামান সোহেল এরই মধ্যে তার সুরেলা কণ্ঠমাধুর্য দিয়ে বহু দর্শক-শ্রোতাদের মন জয় করতে সক্ষম হয়েছেন। ছেলেবেলা থেকেই তার গানের প্রতি খুব আগ্রহ ছিল। স্কুলজীবন থেকেই তিনি বিটিভিতে অনুষ্ঠান করেন। সিনেমায় প্লেব্যাক ছাড়াও তার রয়েছে ৭০-৮০টি মৌলিক গান। দেশীয় সংস্কৃতিকে সবার কাছে পরিচিত করতে প্রতিনিয়ত চেষ্টা করে চলেছেন তিনি। এবারের আনন্দভুবনের সারেগারে আয়োজনে মুর্শিদুজ্জামান সোহেলকে নিয়ে থাকছে বিস্তারিত। লিখেছেন শহিদুল ইসলাম এমেল...


মুর্শিদুজ্জামান সোহেলের সংগীতের হাতেখড়ি তার বাবার কাছেই। তার বাবা ছিলেন ঢাকার মিউজিক কলেজের প্রথম ব্যাচের ছাত্র। সেই সময় নীনা হামিদ, ইন্দ্রমোহন রাজবংশীর মতো গুণী শিল্পীরাও ওই কলেজে অধ্যয়ন করতেন। ফলে ছোটোবেলা থেকেই বাবা তাকে সবসময় উৎসাহ দিতেন গান শেখার জন্য।

তিন বছর তিনি গান শিখেছেন বশির আহমেদের কাছে। বশির আহমেদের সঙ্গে পারিবারিক সম্পর্ক থাকায় তিনি সোহেলকে নিজের সন্তানের মতো ভালোবাসতেন, বিনা ফিতে ঘরে বসিয়েই গান শিখিয়েছেন। এছাড়া ‘ইন্দিরা গান্ধী কালচারাল সেন্টার’-এ ভারতের সৌরভ নাহার ওস্তাদের কাছেও একটা কোর্স করেছেন। তিনি মিউজিক কলেজেও লেখাপড়া করেছেন। এভাবেই গানের ভিত তৈরি হয় তার জীবনে।

১৯৮৯ খ্রিষ্টাব্দে হাইস্কুলের একটি অনুষ্ঠানে বাবার হাত ধরে প্রথমবার মঞ্চে গান করেন। তখন তিনি ক্লাশ ফাইভে পড়তেন। এরপর ধীরে ধীরে নিয়মিত গান গাইতে থাকেন। ১৯৯৭ খ্রিষ্টাব্দে কলেজে পড়াকালীন তিনি প্রথম বিটিভিতে গান গাওয়ার সুযোগ পান। ২০০০ খ্রিষ্টাব্দে বাংলাদেশ বেতারে আধুনিক গানের শিল্পী হিসেবে তালিকাভুক্ত হন তিনি। মূলত সেখান থেকেই তার পেশাদার সংগীতজীবনের শুরু।

২০০১ খ্রিষ্টাব্দে প্রণব ঘোষের সুর ও সংগীত পরিচালনায় ‘শ্রাবণী তুমি পাষাণী’ শিরোনামে তার প্রথম একক অ্যালবাম প্রকাশিত হয় সঙ্গীতা থেকে। তবে পারিবারিক জীবনে বড়ো ধাক্কা আসে ২০০২ খ্রিষ্টাব্দে, যখন মাত্র এক সপ্তাহের ব্যবধানে তার বাবা-মা দু’জনই মৃত্যুবরণ করেন। এতে তিনি ভীষণ ভেঙে পড়লেও গানের প্রতি ভালোবাসা তাকে টিকিয়ে রাখে।

২০০৫ খ্রিষ্টাব্দে তার জীবনে নতুন মোড় আসে। সেবছর তার সাথে পরিচয় হয় বিখ্যাত সংগীত পরিচালক আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুলের সঙ্গে। এরপর ছয় বছর তিনি বুলবুলের সহকারী হিসেবে কাজ করেন এবং তার কাছ থেকে শেখেন সংগীতের নানা দিক। সেই সময়ে আজাদ মিন্টু ও আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুলের সুরে তার ‘বড়ো কষ্ট এই বুকে’ অ্যালবাম প্রকাশিত হয় সিডি জোন থেকে। পরে তিনি সিনেমায়ও প্লেব্যাক করার সুযোগ পান। আজাদ মিন্টুর সংগীতায়োজনে ‘ভালো হতে চাই’ ছবিতে দু’টি গান করেন- যার একটি বেবী নাজনীন এবং আরেকটি তানজিনা রুমার সঙ্গে। এছাড়া ‘হাইরিস্ক’ ছবিতেও তানজিনা রুমার সঙ্গে গান করেন তিনি।

২০১০ খ্রিষ্টাব্দে প্রকাশিত হয় তার একটি মিক্স অ্যালবাম, যেখানে বেলাল খান ও ক্লোজআপ ওয়ানের শিল্পী নওরীনের সঙ্গে ডুয়েট গান গেয়েছেন। এরপর ২০১৪ খ্রিষ্টাব্দে সিডি চয়েজ থেকে প্রকাশিত হয় তার একক অ্যালবাম ‘পারবে না ভুলিতে’।

মুর্শিদুজ্জামান সোহেল শুরু থেকেই মৌলিক গানকে গুরুত্ব দিয়ে আসছেন। এ পর্যন্ত প্রায় ৭০-৮০টি মৌলিক গান প্রকাশিত হয়েছে তার। অন্যের গান গেয়ে ভাইরাল হওয়ার ইচ্ছা তার নেই। বরং তিনি চান শ্রোতারা যেন তাকে চেনে তার নিজস্ব মৌলিক গান, সুর ও কণ্ঠের জন্য। তিনি বিশ্বাস করেন- একজন শিল্পীর আসল পরিচয় তার মৌলিক সৃষ্টিতেই।

সংগীতজীবনের একটি বিশেষ স্মৃতির কথা জানতে চাইলে সোহেল বলেন, ‘আমি ২০০১ খ্রিষ্টাব্দে মাদারীপুরে একটি প্রোগ্রামে গান গাইতে যাই। ফরিদা পারভীন ও আবিদা সুলতানা আপার মতো বিখ্যাত শিল্পীদের সঙ্গে ছিলাম আমি। দর্শকরা প্রথমে আমাকে গান গাইতে বাধা দেন। ঠিক তখনই আবিদা সুলতানা আপা মঞ্চে উঠে বলেন- আপনারা যদি ওর গান না শোনেন তাহলে আমরাও কষ্ট পাব, ভালোভাবে গান গাইতে পারব না। এরপর দর্শকেরা শান্ত হয় এবং আমি একটানা চারটি গান পরিবেশন করি। শ্রোতারা মুগ্ধ হয়ে আমার গান শোনেন। এটা ছিল আমার জীবনের একটি মজার স্মৃতি।’

বর্তমানে মুর্শিদুজ্জামান সোহেল গান, সুর ও লেখা নিয়ে সমান ব্যস্ত। টেলিভিশন অনুষ্ঠান ও স্টেজ শো-এর পাশাপাশি তিনি নিজে গান লেখেন, সুর করেন, এমনকি নাটকের স্ক্রিপ্টও লিখে থাকেন। ইতোমধ্যে তিনটি নাটকের স্ক্রিপ্ট প্রস্তুত করেছেন, ভালো প্রযোজক পেলে নাটক নির্মাণ শুরু করবেন। তিনি পরিচালক সেখ সেলিমের দু’টি ধারাবাহিক ও দু’টি সিঙ্গেল নাটকেও অভিনয় করেছেন।

মুরশিদজ্জামান সোহেল বর্তমানে গাজীপুরে ল্যাবরেটরি স্কুল অ্যান্ড কলেজে সংগীত শিক্ষক হিসেবে কর্মরত আছেন। পাশাপাশি নিজের প্রতিষ্ঠিত সংগীত একাডেমি ‘সুরের ভেলা’ পরিচালনা করছেন। যেখানে নতুন প্রজন্মকে সুস্থ ধারার সংগীত ও দেশীয় সংস্কৃতি শেখানোর কাজ করছেন তিনি। সোহেলের জন্ম ও বেড়ে ওঠা টাংগাইল জেলার নাগরপুর থানার আউটপাড়া গ্রামে। তিনি গান, নাটকের স্ক্রিপ্ট লেখা এবং নতুন প্রজন্মকে সংগীত শিখতে আনন্দ পান। তার প্রিয় শিল্পী বশির আহমেদ, সাবিনা ইয়াসমিন ও কিশোর কুমার।

প্রিয় গান- ‘অনেক সাধের ময়না’ এবং ‘সব ক’টা জানালা খুলে দাও না’। অবসর সময়ে গান ও নাটকের স্ক্রিপ্ট লিখে কাটান। তার প্রিয় ঋতু বসন্ত আর প্রিয় খাবার ছোটো মাছ ও দেশি মুরগির মাংস।

মুর্শিদুজ্জামান সোহেল বিশ্বাস করেন- দেশীয় সংস্কৃতি ও মৌলিক গানই একজন শিল্পীর আসল পরিচয় তৈরি করে। তাই তিনি অন্যের গান নয়, বরং নিজের রুচিসম্মত মৌলিক গান দিয়েই মানুষের কাছে পরিচিত হতে চান। তার কণ্ঠে মিশে আছে আবেগ, নিষ্ঠা আর সংগীতের প্রতি গভীর ভালোবাসা, যা ভবিষ্যতে তাকে আরো বড়ো সাফল্যের দিকে নিয়ে যাবে বলে প্রত্যাশা করা যায়।