গত শতকের সাতের দশক থেকে মঞ্চের সঙ্গে যুক্ত খলিলুর রহমান কাদেরী। টানা ১৫ বছর মঞ্চে অভিনয় করেছেন। এরপর ১৯৮৬ খ্রিষ্টাব্দে বাংলাদেশ টেলিভিশন ও বেতারের তালিকাভুক্ত শিল্পী হন। দীর্ঘদিনের ক্যারিয়ারে কাজ করেছেন অসংখ্য নাটক ও চলচ্চিত্রে। এখনও অভিনয় করে চলেছেন দাপটের সঙ্গে। বিস্তারিত লিখেছেন শেখ সেলিম...
অনেকটা হুট করেই অভিনয়ের সঙ্গে সম্পৃক্ত হন অভিনেতা খলিলুর রহমান কাদেরী। ১৯৭৭ খ্রিষ্টাব্দে এসএসসি পরীক্ষা দেওয়ার আগে খলিলুর রহমান কাদেরী আশীষ খন্দকার, বিপুল ভট্টাচার্য, স্বপ্নকে নিয়ে গড়ে তোলেন নাট্যদল ‘মেঘদূত নাট্যসংস্থা’। এই দলের হয়েই মঞ্চে অভিনয় করতে শুরু করেন কাদেরী। তারাই প্রথম ১৯৭৯ খ্রিষ্টাব্দে গাইবান্ধায় ‘নূরলদীনের সারাজীবন’ নাটকটি মঞ্চস্থ করেন। ১৯৮১ খ্রিষ্টাব্দে কাদেরী ঢাকায় চলে আসেন। ১৯৮৩ থেকে টানা ছয় বছর ‘আরণ্যক’-এর হয়ে এবং পরবর্তীসময়ে টানা নয় বছর ‘নাগরিক নাট্যসম্প্রদায়ের’ হয়ে মঞ্চে অভিনয় করেন। ১৯৮৬ খ্রিষ্টাব্দে বাংলাদেশ টেলিভিশন এবং বেতারের তালিকাভুক্ত শিল্পী হন তিনি।
১৯৯২ খ্রিষ্টাব্দে বিটিভির আলোচিত নাটক খ ম হারুনের প্রযোজনায় ‘শঙ্কিত পদযাত্রা’ নাটকে কাছিম পাগলা চরিত্রে অভিনয় করে সাড়া ফেলেন। নাটকের পাশাপাশি বড়োপর্দায়ও নিয়মিত কাজ করেন তিনি। তার অভিনীত প্রথম সিনেমা ‘ধনী গরিবের প্রেম’। এরপর একে একে ৫৩টি সিনেমায় অভিনয় করেন। অর্ধশতাধিক সিনেমায় অভিনয় করে প্রশংসা কুড়ালেও কখনো জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পাননি তিনি। এই প্রসঙ্গে কাদেরী বলেন, ‘আমি কখনোই পুরস্কারের জন্য কাজ করি না। দর্শক আমার অভিনয় দেখে প্রশংসা করেন এটাই আমার কাছে সবচেয়ে বড়ো পুরস্কার।”
অভিনয়ের পাশাপাশি ‘মুক্তধারা’ নামের একটি আবৃত্তি সংগঠন গড়েন তিনি। এই প্রসঙ্গে কাদেরী বলেন, “‘মুক্তধারা’ আমার প্রাণের সংগঠন। আমরা ক’জন আবৃত্তিপ্রেমী ৩৫ বছর আগে গঠন করি ‘মুক্তধারা’। অনেক চড়াইউতরাই ছিল আমাদের দীর্ঘ পথচলায়। সেসব পেরিয়ে ‘মুক্তধারা’ তার অগ্রযাত্রায় এখনো দূরন্ত গতিশীল, আস্থায় অবিচল মানুষের ভালোবাসা নিয়ে।”

সুরের ধারায়ও নিজেকে মেলে ধরেন এই শিল্পী। গান গাওয়া প্রসঙ্গে বলেন, “প্রাতিষ্ঠানিকভাবে গান শেখার সুযোগ থাকলেও অনাদরে অবহেলায় তা শেখা হয়ে ওঠেনি। ছেলেবেলা থেকেই ভালো লাগা থেকে গান গাইতাম, এখনো গাই পুরনো দিনের গান। সচীন দেব বর্মণ, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, ভূপেন হাজারিকা, মান্না দে, কিশোর কুমারদের গাওয়া সেইসব গান চিরদিন অনুরণিত হতে থাকবে আমার মনে ও প্রাণে।”
এই অঙ্গনে কাজ করা প্রসঙ্গে কাদেরী বলেন, “যখন অভিনয় করি অন্যরকম ভালো লাগা আমার মনকে দোলা দেয়। আমি নিজেকে কাদামাটি মনে করি। তাই যেকোনো ধরনের চরিত্র চিত্রায়ণ আমার কাছে এক চ্যালেঞ্জ।” কোন ধরনের গল্পে কাজ করতে আপনার ভালো লাগে ? কাদেরী বলেন, “সমাজকে সচেতন করবে যে-গল্প তেমন গল্প, যে-গল্প মানুষের হৃদয়ে দাগ কাটবে তেমন গল্প।” এমনই একটি দাগ কাটার মতো চলচ্চিত্রের কথা বললেন তিনি। ছবির নাম ‘ভাঙ্গন’ নির্মাণ করেছেন মির্জা শাখাওয়াত হোসেন। ছবিতে তিনি একজন ভিক্ষুকের চরিত্রে অভিনয় করেছেন। টানা ৮ দিন তাকে তেজগাঁও রেলস্টেশনে শুটিং করতে হয়। সেখানকার একটি স্মৃতি তুলে ধরেন এইভাবে, “ভিক্ষার জন্য আমি ভিক্ষুকের প্লেট নিয়ে বসে আছি, একটি ১০ বছরের শিশু এসে দুই টাকা হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে, আমার পাশে, আামাকে বলল, দাদু এই টাকা আপনাকে দেব, আমি বললাম, দাও, বাচ্চাটি ভেবেছিল আমি সত্যিকারের ভিক্ষুক। দিতে দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভুগছিল ? আর একটি মজার ব্যাপার ছিল, সেখানে হুইল চেয়ারে করে এক দম্পতি ভিক্ষা করেন, তারা এসে আমার প্লেটে ৫ টাকা দিলেন, আমি অবাক হলাম, আসলেই কি আমি ভিখারি ! বিষয়টি আমার খুব ভালো লেগেছে, এই জন্য যে, আমি চরিত্রের ভেতরে প্রবেশ করতে পেরেছি।”
একটা সময়ে সাংস্কৃতিক অঙ্গনে কাজ করার পাশাপাশি ব্যবসা করলেও, এখন শুধু অভিনয় নিয়েই ব্যস্ত সময় পার করছেন তিনি। অভিনয়কেই এখন পেশা হিসেবে নিয়েছেন কাদেরী। একজন সিনিয়র শিল্পীর জন্য অভিনয়কে পেশা হিসেবে নেওয়া যায় কি? এই প্রসঙ্গে কাদেরী বলেন, “দেখুন এই মুহূর্তে অভিনয়কেই পেশা হিসেবে নিতে হয়েছে আমাকে। তাই খুব একটা হিসাব নিকাশ করার সুযোগ নেই ! তবে ৬০ ভাগ ভোট দিতে চাই পেশা হিসেবে অভিনয়টাকে।”
বর্তমানের নাটক প্রসঙ্গে বলেন, “বর্তমানে বিভিন্ন ধরনের গল্পে নাটক নির্মিত হচ্ছে। একেক দর্শকের একেক রকম রুচি, রুচির তারতম্যভেদে নাটকও হচ্ছে।”
খলিলুর রহমান কাদেরী সবমিলিয়ে চারশো’র অধিক নাটকে অভিনয় করেছেন। নাটক সিনেমার পাশাপাশি বিজ্ঞাপনচিত্রেও মডেল হয়েছেন তিনি। প্রথম বিজ্ঞাপনচিত্র অমিতাভ রেজার পরিচালনায় একটি গুঁড়ো সাবানের।
যে-পরিমাণ নাটকে কাজ করছেন তাতে সন্তুষ্ট কি না ? কাদেরী বলেন, “যে-পরিমাণ নাটকে কাজ করলে একজন শিল্পী ভালোভাবে জীবিকা নির্বাহ করতে পারে, সেই পরিমাণ কাজের সুযোগ আসে না।”
নাটক ছাড়া এই মুহূর্তে আর কী করছেন ? কাদেরী বলেন, “আমার একটা কবিতার দল আছেÑ ‘মুক্তধারা সংস্কৃতি চর্চা কেন্দ্র’। আবৃত্তি ও গান এখনো চলছে। যতদিন বেঁচে থাকব, চলবে ইনশাআল্লাহ।”
প্রাপ্তি অপ্রাপ্তি সম্পর্কে বলেন, “অভিনয়শিল্পী হিসেবে মানুষের যে-ভালোবাসা পেয়েছি, পাচ্ছি এই প্রাপ্তিকে অন্যকিছুর সাথে তুলনা করা যায় না। আরেকটি কথা না বললেই নয়, তা হলো শিল্পী যেন তার সস্মান যা তার প্রাপ্যটা যেন জীবদ্দশায় পায়। মরনোত্তর নয়!”
উল্লেখযোগ্য কাজ : ‘অঘটন’, ‘জার্নি উইথ ম্যাড’, ‘কাছের মানুষ দূরে থুইয়া’, ‘অন্ধকারের গান’, ‘জিম্মি’, ‘হুমায়ূন সমীপে’, ‘ওঙ্কার’ প্রমুখ।