সময়ের জনপ্রিয় সংগীতশিল্পী আয়েশা জেবীন দিপা এরই মধ্যে তার সুরেলা কণ্ঠমাধুর্য দিয়ে অগণিত দর্শক-শ্রোতাদের মন জয় করে নিয়েছেন। ছেলেবেলায় নাচের প্রতি খুব আগ্রহ ছিল তার। তবে সাফল্য পেয়েছেন গানে। দিপা ২০০৯ খ্রিষ্টাব্দে জাতীয় শিশু-কিশোর প্রতিযোগিতায় প্রথম পুরস্কার স্বর্ণপদক অর্জন করেন। ২০১৪ খ্রিষ্টাব্দে ‘ম্যাজিক বাউলিয়ানা’ প্রতিযোগিতায় চতুর্থ স্থান অর্জন করেন। এবারের আনন্দভুবন সারেগারে আয়োজনে আয়েশা জেবীন দিপাকে নিয়ে থাকছে বিস্তারিত। লিখেছেন শহিদুল ইসলাম এমেল...
গাজীপুরের মেয়ে আয়েশা জেবীন দিপা। গাজীপুর জেলা শিল্পকলা একাডেমিতে নাচ শিখেছেন। পরে একই প্রতিষ্ঠানে গান শেখার জন্য ভর্তি হন। দিপা ২০১৭ খ্রিষ্টাব্দে অনুষ্ঠিত প্রথম ইন্টারন্যাশনাল ফোক ফেস্টিভ্যালে পেয়েছেন বিশেষ সম্মাননা।
২০০৯ খ্রিষ্টাব্দে জাতীয় শিশু-কিশোর প্রতিযোগিতায় প্রথম হয়ে স্বর্ণপদক অর্জন করেন। ২০১৪ খ্রিষ্টাব্দে ‘ম্যাজিক বাউলিয়ানা’ প্রতিযোগিতায় চতুর্থ স্থান অর্জন করেন।
দিপা আন্তর্জাতিক মঞ্চেও বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করেছেন। তিনি দক্ষিণ কোরিয়ায় অনুষ্ঠিত বহুজাতিক সাংস্কৃতিক উৎসবে অংশগ্রহণ করেছেন, যেখানে ২০টি দেশের শিল্পীরা অংশ নেন। তিনি ২০২২ ও ২০২৪ খ্রিষ্টাব্দে এই উৎসবে লোকসংগীত পরিবেশন করেন।
আয়েশা জেবীন দিপা বর্তমানে বিভিন্ন চ্যানেলে নিয়মিত লাইভ প্রোগ্রাম, মিক্সড অ্যালবামের রেকর্ডিং, সিনেমায় প্লেব্যাক এবং বিভিন্ন স্টেজ শো নিয়ে ব্যস্ত সময় পার করছেন। এর বাইরে ঈদে নতুন দুটো গান রিলিজ হয়েছে তার। একটা হচ্ছে ‘আমি দীনহীন গো’। গানটি লিখেছেন তপন বাগচি। সুর ও সংগীত করেছেন শান শেখ। আরেকটি গান হচ্ছে ‘যাবৎ জীবন কারাদ-’ ; গানটি লিখেছেন সৈয়দ দুলাল। সুর ও সংগীত করেছেন খাইরুল ওয়াসি। এগুলো নিয়েও ব্যস্ত সময় পার করছেন।
সংগীতে যাত্রা শুরু হয়েছিল কীভাবে জানতে চাইলে দিপা বলেন, ‘আমি ছেলেবেলা থেকেই নাচ, গান দুটোর সাথেই জড়িত ছিলাম। প্রথমে আমি নাচ শেখার জন্য ভর্তি হই। আমার মায়ের সখ ছিল আমি যেন সবসময় নাচ-গানের সঙ্গে থাকি। সেই সখ থেকেই আমাকে নাচ শেখার জন্য ভর্তি করে দেন। আমি যখন খুব ছোটো তখন থেকেই টিভিতে বা বাইরে কোথাও গান বাজলেই নাচ শুরু করে দিতাম। সেটা দেখেই মা আমাকে গাজীপুর জেলা শিল্পকলা একাডেমিতে নাচ শেখার জন্য ভর্তি করিয়ে দেন। সেখানে দুই-তিন বছর শেখার পর মা একদিন বললেন যে, আমার গানের গলা ভালো। এখানে একটা কথা না বললেই নয়, আমি নাচ করার সময় গুনগুন করে গানও গাইতাম। আমার টিচারও মাকে বলতেন ওকে গান শেখান। গানে ভালো করবে। আমার মা স্কুলের টিচার ছিলেন। তারপর মা আমাকে গান শেখার জন্য ভর্তি করিয়ে দেন শিল্পকলা একাডেমিতে। সেখানেই আমার গানের হাতেখড়ি এবং আস্তে আস্তে গানের জার্নিটা সেখান থেকেই শুরু। এরপর অনেক গুরুজির কাছে গানের তালিম নিয়েছি। ক্ষিতীশ মল্লিক স্যারের কাছে আমি ক্লাসিকাল শিখেছি। সঞ্জীব রায় স্যারের কাছেও গানের তালিম নিয়েছি। এভাবেই আমার গানের শুরু।’
দিপার মৌলিক গানের সংখ্যা অর্ধশত। সিনেমায়ও প্লেব্যাক করেছেন। লোকগানের প্রতি আগ্রহী হলেন কীভাবে জানতে চাইলে দিপা বলেন, ‘আমি একটা সময়ে সবধরনের গান করতাম। রবীন্দ্রসংগীত, আধুনিক, নজরুলসংগীতÑ সবধরনের গান গাইতাম। কিন্তু আমি বাউল গানের একটা বড়ো রিয়েলিটি শো’র প্ল্যাটফর্ম থেকে এসেছি। আমি ২০১৪ খ্রিষ্টাব্দে ‘ম্যাজিক বাউলিয়ানা’য় চতুর্থ স্থান লাভ করি। রিয়েলিটি শো’টিই ছিল লোকগানের ওপর। ওখান থেকেই মূলত আমার লোকগানের প্রতি ভালোবাসা বা লোকগান গাওয়ার ইচ্ছা জাগে। তখন আমি বুঝতে পারতাম লোকজ ধারার গানই আমার গলায় ভালো যায়। আমি ধারণ করে গাইতে পারি। সে থেকে আমার লোকগানের প্রতি ভালোবাসা, লোকগানে আসা।’
কোন ধরনের গান গাইতে বেশি স্বচ্ছন্দ্যবোধ করেন এমন প্রশ্নের জবাবে দিপা বলেন, ‘সবধরনের গানই আমি গাইতে পারি। তবে, লোকগান গাইতেই বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করি। লোকগান ভালোবাসি বলেই হয়ত লোকগান আমার গলায় যায়। যেহেতু আমি লোকগান ভালোবাসি তাই লালন সাঁইজি, শাহ আব্দুল করিম, রাধারমনের গান খুব ভালোবাসি। সেই ভালোবাসা থেকেই আমার গানগুলো গাওয়া। যে গান আমার পছন্দ না হয়, যে গান আমাকে টানে না সে গান আমি গাইতে পারি না। হয়ত-বা আমার ভালো লাগে কিন্তু আমি গাইতে পারি না সব গান। আমার গলার সাথে হয়ত-বা যায় না।’

অনেকেই মনে করেন লোকগান এখন আর আগের মতো জনপ্রিয়তা পাচ্ছে না। মাটি ও মানুষের কাছাকাছি যাচ্ছে না। আপনি কী মনে করেন ? ‘আমি বলবো এটা একধরনের গুজব, এটা ঠিক নয়। লোকগান সবসময় জনপ্রিয় ছিল এবং সবসময় জনপ্রিয়তা পেতে থাকবে। কারণ হচ্ছে লোকগান মাটি ও মানুষের গান। বাঙালির প্রাণের সাথে মিশে আছে এই গান। মাটির সাথে আমাদের অনেক গভীর সম্পর্ক। আমরা প্রাকৃতিক দিক থেকেও সমৃদ্ধ। প্রাকৃতিক দিক থেকে আমাদের দেশের সৌন্দর্য অনেক বেশি। আসলে লোকগান প্রকৃতি থেকে আসে, মাটি থেকে আসে, মানুষের জীবন থেকে আসে। মানুষের জীবনে প্রতিটি গল্প থেকে আসে তাই লোকগান জনপ্রিয়তা পাবে না এটা হতেই পারে না। আসলে এটা এক ধরনের গুজব।’
সবশেষে সংগীত জীবনে একটি বিশেষ স্মৃতির কথা জানতে চাই, ‘সংগীত জীবনে অনেক ভালো স্মৃতি যেমন আছে তেমন অনেক খারাপ স্মৃতিও আছে। আমি একেবারে শুরুর একটা গল্প বলি। তখন ২০১৩ বা ১৪ খ্রিষ্টাব্দ হবে। আমাদের গাজীপুরের রাজবাড়ির ‘শহীদ বরকত স্টেডিয়াম’ মাঠে অনেক বড়ো করে একটা কনসার্টের আয়োজন করা হয়। সেখানে অনেক বড়ো বড়ো শিল্পীরা এসেছেন সংগীত পরিবেশন করতে। আয়োজক কমিটির কয়েকজন আমার বাবা-মাকে বলেছে আমাকে নিয়ে আসতে। আমাকে দিয়ে ওনারা দুটো গান গাওয়াবে। আমি খুব সাজুগুজু করে এক্সাইটেড হয়ে মাঠে গেলাম। আমি বসে আছি। একজনের পর একজন গান গেয়ে যাচ্ছে। এদিকে সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত হলো। একসময় প্রোগ্রামও শেষ হয়ে গেল। কিন্তু আমাকে আর গান গাওয়ার সুযোগ দেওয়া হলো না। আয়োজনটা খুব বড়ো ছিল। প্রচুর দর্শক ছিল। তাই আমার বাবা আয়োজক কমিটিকে খুব রিকোয়েস্ট করেছিল একটা গান গাওয়ার সুযোগ দেওয়ার জন্য। কিন্তু আমাকে সুযোগ দেওয়া হয়নি। আমি সেদিন স্টেডিয়াম থেকে বের হচ্ছিলাম আর খুব কষ্ট পাচ্ছিলাম। কষ্টে আমার চোখ ভিজে যাচ্ছিল বারবার। আমার পরিচিতজনেরা অনেকেই আমার সাথে কথা বলছিলেন। আমি এতই কষ্ট পাচ্ছিলাম যে, আমি কারো সাথে কথা বলতে পারছিলাম না। সেদিন মাথা নিচু করে আমার বাবা-মা-ভাই স্টেডিয়াম থেকে বের হয়ে এসেছি। এটা আমার শুরুর দিকের একটা বাজে স্মৃতি। এখন অনেক ভালো লাগে সেই আয়োজকেরাই যখন আমাকে ফোন করে প্রোগ্রামে গান গাওয়ার জন্য অনুরোধ করেন। এখন অবশ্য আমিই অনেক সময় ওনাদের সময় দিতে পারি না ব্যস্ততার জন্য। এটা ভেবে খুবই ভালো লাগে। এর বাইরেও অনেক ভালো স্মৃতি আছে। আমি যখন দেশের বাইরে যাই গান গাইতে তখন দেখি অনেক মানুষ বাঙালি যারা আমার গান টিভিতে শোনে, মোবাইলে শোনে, তারা যখন আমাকে সামনাসামনি দেখে অনেকেই একসাথে ছবি তুলতে আসে, আমাকে বলে আপনার গান খুব পছন্দ করি। আপনি খুব ভালো গান করেন। এগুলো আসলে খুব সুন্দর স্মৃতি। আরেকটা মজার স্মৃতি শেয়ার করতে চাই সেটা হচ্ছে, আমি তো গাজীপুরে থাকি। একদিন আমি রিকশায় বাসায় যাচ্ছিলাম। বাসায় নেমে যখন রিকশাওয়ালা চাচাকে ভাড়া দিতে যাব, তিনি আমার কাছ থেকে কোনোমতেই ভাড়া নেবেন না। কেন নেবেন না। কারণ উনি আমার গান শোনেন টিভিতে, আমার গানের ভক্ত। আমি ওনার রিকশায় উঠেছি এটাই তার কাছে অনেক সৌভাগ্যের। সেদিন উনি আমাকে কেঁদে কেঁদে বলছিলেন, আমি আপনার গান শুনি। আসলে আমি লোকসংগীতের মানুষ দেখে হয়ত-বা ওনার সেই ভালোবাসা আমি পেয়েছি বা ওনাকে টাচ করেছে আমার গান। ওনার সঙ্গে অনেকক্ষণ গল্প করেছি এবং আমি অনেকক্ষণ ওনার দিকে তাকিয়ে ছিলাম তার অনুভূতি বোঝার জন্য। তার চোখে মুখে আমার প্রতি যে ভালোবাসা, আমার গানের প্রতি যে ভালোবাসা, গানের প্রতি যে শ্রদ্ধা, যে সম্মান আমি ওনার কাছে সেদিন পেয়েছি এটা আমার কাছে নিঃসন্দেহে একটা বিশাল পাওয়া।’