নকল ও ভেজাল প্রসাধনসামগ্রী : ডা. তৌহিদা রহমান ইরিন

25 May 2025, 02:30 PM অভোগ শেয়ার:
নকল ও ভেজাল প্রসাধনসামগ্রী : ডা. তৌহিদা রহমান ইরিন

আমাদের মাঝে অনেকেই আছেন যারা না-বুঝে না-জেনে অন্যের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে ভেজাল ও নকল প্রসাধন-সামগ্রী ব্যবহার করেন। অনেক সময় প্রিয়জনকে উপহার হিসেবেও দেওয়া হয় এ-সব ভেজাল সামগ্রী। গবেষণায় দেখা গেছে, নিম্নমানের সামগ্রী দিয়ে বানানো এ-সব পণ্যে থাকে প্রচুর পরিমাণে টক্সিন। টক্সিন মানেই কিন্তু বিষ। সুতরাং আপনি এক অর্থে বিষ কিনছেন, ব্যবহার করছেন এবং অন্যকে উপহার হিসেবেও দিচ্ছেন। যার প্রভাবে শুধু আপনার ত্বকই নয়, শরীরের অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গগুলোও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। আর এ-সব পণ্যের মাঝে থাকে দৈনন্দিন জীবনে ব্যবহৃত স্কিন, হেয়ার কেয়ার প্রসাধনী।

প্রথমে আসি রং ফর্সাকারী ক্রিম প্রসঙ্গে। এ-সব রং ফর্সাকারী ক্রিমে থাকে স্টেরয়েড, মার্কারি এবং হাইড্রোকুইনোন। দীর্ঘদিন স্টেরয়েডযুক্ত পণ্য ব্যবহারে দেখা দেয় স্টেরয়েড ইনডিউসড একনি অর্থাৎ ব্রন। ত্বক পাতলা ও সেনসিটিভ হয়ে যায়। অনেক সময় ত্বকে দেখা দেয় অবাঞ্ছিত লোম। মার্কারি কিন্তু পেইন্ট স্ট্রিপার হিসেবে কাজ করে। আমরা সাধারণত দেয়ালের রং দূর করার জন্য যে-পেইন্ট রিমুভার ব্যবহার করি সেগুলোতে থাকে মার্কারি। সেক্ষেত্রে আমরা যখন মার্কারিযুক্ত রং ফর্সাকারী ক্রিম ব্যবহার করি তা আমাদের ত্বকের উপরিভাগের লেয়ারটাকে ধ্বংস করে দেয় এবং রক্তসঞ্চালনের মাধ্যমে কিডনি, লিভারের মতো গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গগুলোকেও ধ্বংস করতে থাকে। এর ফলে দেখা দেয় রেনাল ফেইলিওর। মার্কারিকে কার্সিনোজেনিক উপাদানও বলা হয়, যা ব্যবহারে ত্বকে ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়ে। হাইড্রোকুনোন একটি ব্লিচিং এজেন্ট। আমরা চিকিৎসকেরা একটি নির্দিষ্ট মাত্রায় হাইড্রোকুইনোন ত্বকে কোনো ধরনের পিগমেন্টরি ডিজঅর্ডার হলে ব্যবহার করতে বলি কিন্তু সবধরনের রং ফর্সাকারী ক্রিমে অধিক মাত্রায় হাইড্রোকুইনোন থাকে, যা ব্যবহারে আনইভেন স্কিন টোন, মিসম্যাচ স্কিন এবং অক্রোনোসিস নামে একধরনের রোগ দেখা দেয়।

আমরা যে হ্যান্ডওয়াশ, ক্লিনজার, ডিটারজেন্ট ব্যবহার করি সেগুলোতে অনেক সময় ট্রাইক্লোসান থাকে। কেনার আগে দেখতে হবে যে, এগুলো ট্রাইক্লোসানমুক্ত কি না। ট্রাইক্লোসান থাইরয়েড হরমোন মেটাবলিজমে বাধা দেয়। দীর্ঘদিন ধরে ট্রাইক্লোসানযুক্ত পণ্য ব্যবহারে শিশুদের এলার্জি, এজমা এবং একজিমা রোগের আশঙ্কা দেখা দেয়। 

আমরা যে হ্যান্ড স্যানিটাইজার ব্যবহার করি সেটিতে যদি আইসোপ্রোপাইল ইথানল ৬০%-৭০% থাকে সেটি ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়ার মতো জীবাণু ধ্বংস করে। কিন্তু অনেক সময় ভেজাল বা নকল হ্যান্ড স্যানিটাইজারে মিথানল ব্যবহার করা হয় যা টক্সিক। মিথানলযুক্ত প্রোডাক্ট ব্যবহারে ত্বকের প্রদাহ থেকে শুরু করে মৃত্যু ঝুঁকিও হতে পারে।

এরপর আসি ট্রায়োটক্সিন নিয়ে। সাধারণত আমাদের দৈনন্দিন জীবনে ব্যবহৃত ময়েশ্চারাইজার এবং প্রসাধনীগুলোতে Phthalate, Formaldehyde এবং Toluene থাকে। এই তিনটিকে একত্রে ট্রায়োটক্সিন বলে। এই ট্রায়োটক্সিন হরমোনাল ইমব্যালেন্স করে। কোনো গর্ভবতী নারী যদি ট্রায়োটক্সিনযুক্ত পণ্য ব্যবহার করে সেটি কিন্তু তাদের গর্ভের শিশুটির ওপর ক্ষতিকর প্রভাব ফেলতে পারে। সুতরাং ট্রায়োটক্সিনমুক্ত পণ্য কিনবেন, ট্রায়োটক্সিনযুক্ত পণ্য নয়।

এবার আসছি মেয়েদের খুব পছন্দের কিছু প্রসাধনীসামগ্রীর কথায়। প্রথমেই বলছি মেকআপ প্রোডাক্টগুলো নিয়ে। ফাউন্ডেশন, ফেস পাউডার, প্রাইমার- এগুলো ব্যবহারের পরে অনেক সময় ত্বকে নানাধরনের র‌্যাশ বা ব্রন দেখা দেয়। সে-কারণেই ত্বকের ধরন অনুযায়ী প্রসাধনীগুলো কিনতে হবে। যেকোনো মেকআপ সামগ্রী কেনার আগে দেখবেন সেটা যেন নন কমেডোজেনিক হয়। 

এবারে আসছি মেয়েদের খুব পছন্দের লিপস্টিকের বয়ানে। লিপস্টিকে সাধারণত মার্কারি, ক্যাডমিয়াম, লেড এ-ধরনের কেমিক্যাল ও টক্সিন থাকে। দীর্ঘদিন ধরে এই উপাদানযুক্ত লিপস্টিক ব্যবহারে লিপ এলার্জি, ইরিটেশন, চ্যাপড লিপ, ডিসকালারেশন- এ-সব সমস্যা দেখা দেয়। শুধু তাই নয়, দীর্ঘদিন ব্যবহারে আমাদের ডাইজেস্টিভ সিস্টেম, রেনাল সিস্টেম এগুলোতে ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে। অনেক সময় লিপস্টিকে রেট্রো কেমিক্যাল ব্যবহার করা হয়, যেগুলো সাধারণত ন্যাচারাল অয়েল এবং গ্যাসের বাই প্রোডাক্ট। এই রেট্রোকেমিক্যালগুলো নার্ভ এবং ব্রেইন ডেভেলপমেন্টে বাধা দেয়। এ-সকল সমস্যা সাধারণত মেয়েদেরই হয়। কারণ, মেয়েরা বেশি প্রোডাক্ট ব্যবহার করে। গবেষণায় দেখা গেছে যে, একটি ছেলে যদি ছয়টি প্রসাধনী-সামগ্রী ব্যবহার করে দিনে, সেক্ষেত্রে একটি মেয়ে তার দ্বিগুণ অর্থাৎ কমপক্ষে বারটি সামগ্রী ব্যবহার করে। 

সুতরাং পাঠক, আপনারা নকল ও ভেজাল পণ্যে নিজেকে হারিয়ে যেতে দেবেন না। অনেক সময় পুরনো কন্টেইনার বা বোতলে এ-সব ভেজাল সামগ্রী রিফিল করে পুনরায় বিক্রি করা হয়। অতএব, আপনারা যেকোনো অথেনটিক পণ্য ব্যবহারের পরে সেই বোতলগুলো ডিসপোজ করবেন যেন এটি পুনরায় ব্যবহারযোগ্য  না-থাকে। আপনার ত্বকের ধরন বুঝে প্রসাধান-সামগ্রী ব্যবহার করুন। যেকোনো সামগ্রী কেনার আগে মেয়াদ উত্তীর্ণের তারিখ চেক করে নেবেন। আরও দেখবেন এটি পিএইচ ব্যালেন্সড কি না এবং ডার্মাটোলজিস্ট টেস্টেড কি না। 

লেখক : চর্মরোগ বিশেষজ্ঞ