“বাঙালির বড়ো প্রিয় মাছে আর ভাতে
ভালো হয় শেষে যদি দৈ পড়ে পাতে।”
বাঙালির মতো পৃথিবীর অনেক দেশের মানুষই দৈ খেতে দারুণ ভালোবাসে। মিষ্টি ও টক দুরকমের দৈ-ই দুধ থেকে তৈরি জনপ্রিয় খাবার। দুধ ও ব্যাকটেরিয়ার যুগলবন্দিতে উৎপন্ন দৈ-এর বয়স চার হাজার বছর। দুধের সাথে যে জীবাণু মিশিয়ে দৈ তৈরি হয়, তার নাম ‘ল্যাক্টোব্যাসিলাস বুলগেরিকুশ’। এই নামের থেকে দৈ-এর জন্মভূমির নামের একটি ইঙ্গিত পাওয়া যায়, আর সেটি হলো বুলগেরিয়া। চার হাজার বছর পূর্বে বুলগেরিয়ার লোকেরা প্রথম দৈ বানাতে ও খেতে শুরু করে। জন্মস্থান বুলগেরিয়ার প্রায় সব খাবারেই দৈ ব্যবহার করতে দেখা যায়। বুলগেরিয়ার পরে বিশ^দরবারে দৈ-এর জন্য খ্যাতি লাভ করে বাংলাদেশ। বাংলাদেশের ‘বগুড়ার দৈ’ নামে বিশ^ব্যাপী নন্দিত হয়েছে শেরপুরের দৈ। শোনা যায়, ‘বগুড়ার দৈ’ রাজা-রানিরও মন জয় করেছে।
বগুড়া সদর থেকে কুড়ি কিলোমিটার দূরে শেরপুর উপজেলা। শেরপুরের ঘোষেরাই বিখ্যাত বগুড়ার দৈ তৈরির আদি কারিগর। প্রবীণেরা বলেন, বগুড়ার শেরপুরের ঘোষ পরিবারের দৈ তৈরির ইতিহাস বহু প্রাচীন এবং বগুড়ার দৈ দেশের আগে সুনাম অর্জন করে বিলেতে। সবার আগে ইংল্যান্ডে ছড়িয়ে পড়ে বগুড়ার দৈ-এর খ্যাতি। ঘটনা ১৯৩৮ খ্রিষ্টাব্দের। ওই বছরের শুরুর দিকে সে-কালের বাংলার ব্রিটিশ গভর্নর স্যার জন এন্ডারসন বগুড়ার নওয়াব বাড়িতে বেড়াতে এসে দৈ-এর স্বাদ আস্বাদন করেন। তাকে কাচের পাত্রে বসানো বিশেষ দৈ খেতে দেওয়া হয়। দৈ খেয়ে গভর্নর এমন আপ্লুত হন যে, তিনি বগুড়ার দই বিলেতে নেওয়ার ব্যবস্থা করেন। জানা যায়, রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথও বগুড়ার দৈ খেয়ে ভূয়সী প্রশংসা করেন।
দেশভাগের কিছু আগে ভারত থেকে বগুড়ায় আসেন গৌর গোপাল ঘোষ নামের এক ব্যক্তি। এদেশে এসে তিনি আশ্রয় নেন বগুড়ার শেরপুরে আত্মীয়-স্বজনের কাছে। খুব স্বাভাবিকভাবেই অর্থ সংকটে পড়েন গৌর গোপাল। দৈ পাতার কৌশল জানতেন তিনি ; শুরু করেন দৈ-এর ব্যবসায়। দৈ বানিয়ে ভাঁড়ে করে হেঁটে হেঁটে বিক্রি করতে শুরু করেন গোপাল। তার তৈরি দৈ-এর স্বাদ অন্যরকম। মাটির পাত্রে দৈ পাতেন বলে তার দৈ-এর নাম ‘সরার দৈ’। আর এই ‘সরার দৈ’-ই হলো বিখ্যাত ‘বগুড়ার দৈ’। গৌর গোপালের দৈ দিনেদিনে এতই সুনাম অর্জন করে যে, নবাব বাড়িতেও সরবরাহের আদেশ আসে। পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী মোহাম্মদ আলীর বাবা বগুড়ার নবাব আলতাফ আলী চৌধুরী গৌর গোপাল ঘোষকে ডেকে বগুড়া শহরের নওয়াব প্যালেসের আম বাগানে থাকার জায়গা দেন। সেখানে গৌর গোপাল নিজের বাড়ি ও দৈ-এর কারখানা স্থাপন করেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের আগ পর্যন্ত গৌর গোপাল সেই আম বাগানেই বসবাস করেতেন।

‘বগুড়ার দৈ’ কয়েক রকমের হয়ে থাকে। টক দৈ, সাদা দৈ, চিনিপাতা দৈ। সাধারণত মাটির পাত্রে দৈ বাজারজাত করা হয়। পাত্রগুলোর নামও বেশ আকর্ষণীয়- সরা, পাতিল, বারকি, কাপ, বাটি। কারিগরেরা জানান, এক কেজি দৈ তৈরি করতে দুই কেজি গাভীর দুধ, ২৫০ গ্রাম চিনি, সামান্য পরিমাণে পুরোনো দই ও মাটির একটি হাঁড়ির প্রয়োজন হয়। একটি পরিষ্কার কড়াই বা পাতিলে দুধ ছেঁকে ঢেলে দিতে হয়। এরপর চুলায় বসাতে হয়। আগুন যত ধীরে জ্বলবে দৈ ততই সুস্বাদু হবে।
সাদা দৈ তৈরি করতে হলে দুই ঘণ্টা পর কড়াই নামিয়ে ফেলতে হয়। আর ঘিয়ে রঙের দৈ-এর জন্য প্রায় চার ঘণ্টা চুলায় কড়াই রাখতে হয়। দুধ ফুটে দুই কেজি থেকে এক কেজি হলে চিনি দিতে হয়। চিনি গলে গেলে কড়াই নামিয়ে ফেলতে হয়। কড়াই নামানোর পরে ঠান্ডা না-হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়। এরপর সরায় ঠান্ডা দুধ ঢেলে দিতে হয়। পুরনো এক চিমটি দৈ দুধের সঙ্গে মেশাতে হয়। ঝাঁপি দিয়ে সরা ঢেকে রাখতে হয়। পরে ছাইচাপা আগুনে সরা বসিয়ে রাখতে হয়। প্রয়োজন অনুযায়ী ছয় ঘণ্টা পর্যন্ত এভাবে রাখতে হয় দৈ-এর সরা।
প্রথমদিকে শুধু বগুড়ার নবাব পরিবারের জন্যই দৈ তৈরি করতেন গৌর গোপাল। পরে ভাই সুরেন ঘোষের সাথে ব্যবসা বাড়িয়ে বগুড়ার দৈ-এর এক নতুন যুগের সূচনা করেন তিনি। কালক্রমে বগুড়ার দৈ-এর ব্যবসা গৌর গোপালের হাত থেকে অন্যদের হাতে চলে যায়। বর্তমানে বগুড়া অঞ্চলে প্রায় চারশো কারখানায় দৈ তৈরি হয়।
বগুড়ার দৈ-এর কারখানাগুলোতে সনাতন পদ্ধতিতে দৈ প্রস্তুত করা হয়। বিশালাকারের কড়াইয়ে উচ্চতাপে দুধ জ্বাল দেওয়া হয়। দুপুর ১২টার আগেই চুলা জ্বালানো হয়। পালাক্রমে ঘণ্টাদুয়েক চলে দুধ জ্বাল দেওয়ার কাজ। সেইসঙ্গে চিনি এবং প্রয়োজনীয় উপাদান যোগ করা হয়। এরপর ঠান্ডা করার জন্য পাশের ঘরে নেওয়া হয়। সেখানে স্বাভাবিক তাপমাত্রায় রাখা হয়। ঘণ্টাখানেক পরই মাটির পাত্রে ঢালা হয় দুধ। যাকে বলা হয় দৈ পাতানো। এবার তাতে পরিমাণমতো বীজ-দৈ যুক্ত করেন কারিগরেরা। এর পরিমাণ সামান্য কমবেশি হলেই ভেস্তে যাবে সব আয়োজন। তবে, বছরের পর বছর দৈ পাতানোতে অভিজ্ঞ কারিগরদের দেখে কাজটা মোটেই কঠিন বলে মনে হয় না। একে একে সব পাত্রে বীজ যুক্ত করার পর বিশাল ছাউনির মতো ঢাকনা দিয়ে ঢেকে রাখা হয়। মাটির পাত্রের শোষণ ক্ষমতার কারণে দুধের স্তর নিচে নেমে যায়। তাই ভোর পর্যন্ত দু-তিন দফায় ঢাকনা তুলে দুধ দিয়ে আবারও পাত্রগুলো পূর্ণ করে দেওয়া হয়। নির্দিষ্ট তাপমাত্রায় রাখা পাত্রে দৈ জমতে থাকে। ভোরের আলো ফোটার আগেই তৈরি হয়ে যায় সুস্বাদু দৈ।
বর্তমানে বগুড়া জেলায় ছোটো-বড়ো মিলিয়ে ৪০০ কারখানায় প্রতিদিন গড়ে ৫০টন দৈ তৈরি হয়। জেলায় বিভিন্ন এলাকায় গড়ে ওঠা দৈ-এর কারখানায় কমবেশি পনের হাজার শ্রমিক কাজ করেন। স্থানীয় দৈ ব্যবসায়ীরা মনে করেন, সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা পেলে ‘বগুড়ার দৈ’ বিদেশে রপ্তানি করা সম্ভব হবে। এতে দেশ অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হবে, বাড়বে কর্মসংস্থান।
লেখা : শ্যামল কায়া