ডায়াবেটিস রোগটির সম্পূর্ণ নাম হলো ‘ডায়াবেটিস মেলাইটাস’ [Diabetes Mellitus]। নামটির উৎপত্তি হয় গ্রিক শব্দ ‘ডায়াবেটিস’ বা ‘সিফন’ থেকে যা প্রতিফলিত করে প্রবাহিত তরলকে এবং মেলাইটাস যা প্রতিফলিত করে মধু বা চিনিকে। অর্থাৎ রক্তনালির মধ্য দিয়ে অতিরিক্ত চিনি প্রবাহকে তুলে ধরে এই ‘ডায়াবেটিস মেলাইটাস’ শব্দটি। বাংলায় ‘ডায়াবেটিস’-কে বলা হয় ‘বহুমূত্র রোগ’ ; অর্থাৎ এ রোগের নাম থেকেই রোগের লক্ষণ সম্পর্কে জানা যায় যে, রোগী বারবার প্রস্তাব করতে চাইবে।
প্রকৃতপক্ষে ডায়াবেটিস হলো শরীরের এমন একটি গুরুতর অবস্থা যেখানে শরীর নিজে থেকে ইনসুলিন নামক হরমোন তৈরি করতে পারে না, অথবা তৈরি হওয়া ইনসুলিন দক্ষতার সাথে শরীর ব্যবহার করতে পারে না। ইনসুলিন আমাদের রক্তে চর্বি, শর্করা, চিনির পরিমাণ নিয়ন্ত্রণ করে। এটি মানবদেহের কোষের মধ্যে ‘চাবি’ হিসেবে কাজ করে ইনসুলিন ঢোকার ক্ষেত্রে। যখন রক্তে শর্করা বা চিনির পরিমাণ বেড়ে যায় তখন এই কোষের ভিতরে এই অতিরিক্ত চিনি ঢুকিয়ে দেয়। কিন্তু এই ইনসুলিনের ঘাটতি হলে অথবা ইনসুলিন সঠিকভাবে কার্যক্ষমতায় ব্যর্থ হলে তখনই রক্তে চিনির পরিমাণ বেড়ে গিয়ে দেখা দেয় ‘ডায়াবেটিস’ নামক রোগ।
ডায়াবেটিসের প্রকারভেদ
ডায়াবেটিস মূলত ২ প্রকার। ১. টাইপ-১ ডায়াবেটিস : এটিকে বলা হয় ‘ইনসুলিন নির্ভর’ ডায়াবেটিস। এটি সাধারণত কম বয়স্ক ব্যক্তির হয়ে থাকে। এই রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিদের শরীর ইনসুলিন তৈরিতে অক্ষম। যার কারণে রক্তে চিনির পরিমাণ থাকে অতিরিক্ত। যেহেতু এটি সাধারণত কম বয়স্কদের হয়. তাই এটি চরম মাত্রায় উঠে গেলে প্রকাশ পায় এবং রোগী অজ্ঞান হয়ে যায়। তাই দেখা যায় অজ্ঞান হওয়ার পর হাসপাতালে নেওয়া হলে রোগটি সনাক্ত হয়। তখন এটিকে বলে ‘ডায়াবেটিক কিটেএসিডোসিস’।
২. টাইপ-২ ডায়াবেটিস : এটি সবচেয়ে কমন এবং সাধারণত প্রাপ্তবয়স্কদের হয়ে থাকে। এই রোগে রোগীর শরীরে ইনসুলিন তৈরি হয় তবে তা পর্যাপ্ত হয় না অথবা এটি ঠিকভাবে কোষের ওপর কাজ করতে পারে না। সেক্ষেত্রে এটিকে বলা হয় [Insulin Resistant] ‘ইনসুলিন রেজিস্ট্যান্ট’ ডায়াবেটিস।
এই দুই প্রকার ছাড়াও আরো অনেক প্রকারের ডায়াবেটিস আছে। যেমন গর্ভাবস্থায় ডায়াবেটিস ও নবজাতকের ডায়াবেটিস।
টাইপ-১ ডায়াবেটিসের লক্ষণ
* তীব্র তৃষ্ণা পাওয়া
* বারবার প্রস্রাবের চাপ অনুভূত হওয়া
* ওজন দ্রুত কমে যাওয়া
* স্বাস্থ্য খারাপ হতে থাকা
* মেজাজ খিটখিটে হওয়া
* চোখে ঝাপসা দেখা
* হঠাৎ অজ্ঞান হয়ে যাওয়া
* দুর্বল লাগা
* প্রচ- ক্ষুধা
টাইপ-২ ডায়াবেটিসের লক্ষণ
ডায়াবেটিসের সবচেয়ে সাধারণ রূপটিকে বলা হয় টাইপ-২ ডায়াবেটিস। যদিও এটি সাধারণত ৩৫ বছরের পর হয়ে থাকে, তবুও আজকাল ক্রমবর্ধমান তুলনামূলক কম বয়স্কদেরও টাইপ-২ ডায়াবেটিস হচ্ছে। টাইপ-১ ও টাইপ-২ ডায়াবেটিসের লক্ষণগুলো অনেকটা কাছাকাছি কিন্তু টাইপ-২-এর লক্ষণগুলো ধীরগতিতে প্রকাশ পায় ; একারণে এক্ষেত্রে রোগ নির্ণয় হতে দেরি হয়ে যায়। লক্ষণগুলো হলো :
* ক্ষতস্থান শুকাতে দেরি হওয়া
* তীব্র তৃষ্ণা পাওয়া
* বারবার প্রস্রাব হওয়া
* তীব্র ক্ষুধা
* ওজন কমে যাওয়া
* প্রস্রাবে ইনফেকশন
* বগল ও ঘাড়ে কালো দাগ হতে থাকা
ডায়াবেটিস রোগের প্রতিকার
কথায় বলে ‘Prevention is better than cure’ অর্থাৎ প্রতিকারের চেয়ে প্রতিরোধই উত্তম’।
ডায়াবেটিস প্রতিকার বা প্রতিরোধের আগে জানতে হবে এটি কেন হচ্ছে। ডায়াবেটিস হওয়ার কারণগুলো হলো : বংশগত, অস্বাস্থ্যকর জীবনযাপন, হাঁটাচলা না করা, দীর্ঘক্ষণ বসে বসে কাজ করা, ধূমপান, অতিরিক্ত ফাস্টফুড-জাতীয় খাবার গ্রহণ।
উপর্যুক্ত কারণগুলোর মধ্যে একমাত্র বংশগত কারণ ছাড়া বাকি সবগুলো কারণই প্রতিরোধ করা সম্ভব। আর এসব করতে হবে প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার আগে থেকেই।
ডায়াবেটিস রোগের চিকিৎসা
ডায়াবেটিসের ধরন অনুযায়ী এর চিকিৎসা দিতে হবে। টাইপ-১ অর্থাৎ ইনসুলিন নির্ভর ডায়াবেটিসে অবশ্যই ইনসুলিন দিতে হবে। ইনসুলিনের সঠিক ডোজ নির্ধারণ খুব জিরুরি এজন্য অবশ্যই বিশেষজ্ঞ ডাক্তার দেখিয়ে ইনসুলিনের ডোজ নির্ধারণ করতে হবে।
টাইপ-২ ডায়াবেটিসের চিকিৎসা নির্ভর করবে এর তীব্রতার ওপর। টাইপ-২ ডায়াবেটিসের চিকিৎসা শুধুমাত্র হাঁটাচলা থেকে শুরু করে মুখে খাওয়ার ওষুধ বা ইনসুলিন এমনকি উভয়ই হতে পারে।
এখনকার যুগে প্রায় প্রতি ১০ জনে একজন ব্যক্তির ডায়াবেটিস ধরা পড়ছে। ডায়াবেটিস প্রতিকারের চেয়ে প্রতিরোধ অবশ্যই উত্তম। তবে, হয়ে গেলেও ভয় না পেয়ে নিয়মিত ডাক্তারের পরামর্শে চিকিৎসা নিয়ে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে। ডায়াবেটিস শুধুমাত্র নিয়ন্ত্রণে থাকলেই এর সকল রকম ক্ষয়ক্ষতি অঙ্গের ক্ষতিসাধন থেকে রক্ষা পাওয়া সম্ভব। অথচ অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিস মানুষকে ধীরে ধীরে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেয়। ‘মিষ্টি খেলে ডায়াবেটিস হয়’- এ কথাটি সত্য নয়। ডায়াবেটিস হওয়ার পর মিষ্টি খাওয়া যাবে না। তবে, ডায়াবেটিস হওয়ার আগে অতিরক্তি মিষ্টি খাওয়া থেকে শরীরের স্থূলতা বাড়তে থাকে যা ইনসুলিনের প্রতি শরীরের কোষকে রেজিস্ট্যান্ট করে দেয়। অর্থাৎ মিষ্টি অতিরিক্ত পরিমাণে খেলেও সেটি একঅর্থে ডায়াবেটিসের দিকে ধাবিত করে। তাই মনে রাখতে হবে পরিমিত স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস ও ব্যায়াম এই দুটো জিনিসই পারে ডায়াবেটিসের মতো ‘Deadly Diease’ থেকে আমাদের রক্ষা করতে।
ডায়াবেটিস কেন ভয়ের
ডায়াবেটিসকে বলা হয় সকল রোগের দরজা। অর্থাৎ এ রোগটি অন্যান্য সকল রোগকে আমন্ত্রণ করে। ডায়াবেটিস শুধুমাত্র নিয়ন্ত্রণে রাখলে অন্যান্য অনেক রোগকে প্রতিহত করা যায়। অথচ অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিস মানুষকে ধীরে ধীরে প্রচ- অসুস্থতার দিকে ঠেলে দেয়। ডায়াবেটিস ধীরে ধীরে শরীরের বিভিন্ন অঙ্গপ্রত্যঙ্গের ক্ষতি করতে থাকে। এর মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য অঙ্গগুলো হলো :
* কিডনি [Diabetic Nephropathy]
* চোখ [Diabetic Retionpathy]
* স্নায়ুতন্ত্র [Diabetic Neuropathy]
* মস্তিষ্ক [Brain stroke]
* হৃৎপি- [Heart Attack]
* শরীরের নিচের অংশ [Diabetic Foot]
অর্থাৎ বলতে গেলে ডায়াবেটিসে ক্ষতিগ্রস্ত হয় না এমন কোনো অঙ্গ নেই। ডায়াবেটিসের কারণে শরীরের মূল অঙ্গপ্রত্যঙ্গগুলো ধীরে ধীরে ড্যামেজ হয়ে যায়, ফলে আক্রান্ত ব্যক্তি মৃত্যুর দিকে ধাবিত হয় অথবা তার জীবনধারণ কষ্টকর হয়ে পড়ে।
ডায়াবেটিসে কী কী খাওয়া যাবে
ক. বিভিন্ন ফল। যেমন : আপেল, আভোকেডো, বেরি, কমলা, নাশপাতি। তবে এ রোগে মিষ্টিজাতীয় ফল যেমন আম, কাঁঠাল, পাকা পেঁপে, লিচু এসব খুবই পরিমিত পরিমাণে খাওয়া যেতে পারে। অতিরিক্ত খাওয়া যাবে না। খ. পরিমিত ভাত, গ. শাকসবজি, ঘ. পরিমিত মাছ-মাংস।
ডায়াবেটিসে কী কী খাওয়া যাবে না
ক. অতিরিক্ত শর্করা বা চিনিজাতীয় খাবার, খ. মিষ্টি, গ. কাঁচা লবণ বা অতিরিক্ত লবণ, ঘ. অতিরিক্ত চা বা কফি, ঙ. ফ্যাট বা দুগ্ধজাত খাবার, চ. ভাত, আলু, গাজর এসবে অতিরিক্ত শর্করা থাকে তাই এই খাবারগুলো খাওয়া নিয়ন্ত্রণ করতে হবে।
লেখক : এমবিবিএস, এমএম ফেইজ-বি, চক্ষুবিজ্ঞান বিভাগ, বারডেম জেনারেল হাসপাতাল