মাথার চুল থেকে শুরু করে পায়ের নখ পর্যন্ত পুরো শরীরে বাহ্যিক ও অভ্যন্তরীণ অংশে যে উপাদানটির কথা অনস্বীকার্য তা হলো নারকেল তেল। এক্সট্রা ভার্জিন, আনরিফাইনড নারকেল তেল খাবারের একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। এতে আছে প্রচুর পরিমাণের এসেনশিয়াল ফ্যাট যাকে আমরা বলি স্যাচুরেটেড ফ্যাট। নারকেল তেলে আছে প্রচুর পরিমাণে স্বাস্থ্যকর ফ্যাট যা আমাদের সুস্থ রাখে এবং সেইসঙ্গে কোলেস্টেরল কমাতে সাহায্য করে। এজন্য অন্যান্য তেলের তুলনায় খাদ্য হিসেবে নারকেল তেলের অবস্থান শীর্ষে।
রূপচর্চায় নারকেল তেল
নারকেল তেল যেহেতু খুব সহজলভ্য এবং এটি হাতের খুব কাছেই পাওয়া যায়। তাই যুগ যুগ ধরে এটি রূপচর্চায় ব্যবহৃত হয়ে আসছে। বাংলাদেশ, ভারত এসব দেশে নারকেল তেল খুব সহজলভ্য বলে অনেক প্রাচীনকাল থেকে এই তেলের ব্যবহার হয়ে আসছে। ইদানীং নানা ধরনের শ্যাম্পু, কন্ডিশনার, ময়েশ্চারাইজার, শাওয়ার জেল, সাবান, লিপবাম এবং অনেক ধরনের কসমেটিক্স, মাউথ ফ্রেশনারেও নারকেল তেলের ব্যবহার করা হয়।
চুলের যত্নে
নারকেল তেলে আছে লরিক অ্যাসিড, ক্যাপরিক অ্যাসিড, মিসটেরিক অ্যাসিড যা আমাদের চুলে পুষ্টি যোগায়। সে কারণে এই তেল দিয়ে স্ক্যাল্প ম্যাসাজ করলে রক্ত সঞ্চালন বৃদ্ধি পায় এবং পুষ্টি গোড়ায় গোড়ায় পৌঁছে যায়। এই তেল ম্যাসাজের মাধ্যমে মাথার ত্বক সুস্থ ও হাইড্রেট থাকে। এর ফলে চুলের গোড়া মজবুত থাকে। চুলের জন্য এটি আদর্শ ময়েশ্চারাইজার যেটি অনেকে গোসলের আগে তেল ম্যাসাজের মাধ্যমে, গোসলের সময় শ্যাম্পু বা কন্ডিশনারের উপাদান হিসেবে এবং গোসলের পরে হেয়ার সিরামের উপাদান হিসেবে ব্যবহার করে থাকেন। যাদের মাথার গোড়ায় ফুসকুড়ি বা দানা থাকে কিংবা যাদের অতিরিক্ত তৈলাক্ত স্ক্যাল্প তারা স্ক্যাল্পে নারকেল তেল ম্যাসাজ না করে চুলে তেল লাগাতে পারেন। গোসলের কিছুক্ষণ আগে চুলে নারকেল তেল ম্যাসাজ করলে চুলের কিউটিকেল সুরক্ষিত থাকবে। যাদের মাথায় খুব খুশকি হয়, যাদের স্ক্যাল্প শুষ্ক এবং যাদের সোরিয়াসিস আছে তাদের চিকিৎসকেরা টনিক হিসেবে নারকেল তেল ব্যবহার করার পরামর্শ দিয়ে থাকেন। সাধারণত যাদের মুখে ব্রন কিংবা স্ক্যাল্পে দানা থাকে তাদের সারারাত মাথায় নারকেল তেল দিয়ে রাখতে নিষেধ করা হয়। তবে যাদের ত্বক শুষ্ক, সোরিয়াসিস আছে তাদের সারারাত নারকেল তেল ব্যবহারের পরামর্শ দেন চিকিৎসকেরা।
ত্বকের যত্নে
লিপবাম হিসেবে নারকেল তেলের জুড়ি নেই। শীতকালে ভার্জিন নারকেল তেল পেট্রোলিয়াম জেলির মতো ঘন থাকে। সুতরাং এটি সুন্দরভাবে ঠোঁটে ব্যবহার করা যায়। যাদের সারাবছর ঠোঁট শুষ্ক থাকে তারা সবসময় ঠোঁটে নারকেল তেল ব্যবহার করতে পারেন। নারকেল তেলের সঙ্গে চিনি, মধু ও কফি মিশিয়ে ঠোঁটে স্ক্রাব করলে ঠোঁট সতেজ থাকবে। নখের যত্নেও এই তেলের জুড়ি নেই। করোনার জন্য আমরা এখন বেশি বেশি হাত ধুই। সেক্ষেত্রে হাত ধোয়ার আগে, রান্নার আগে কিংবা কোনো কিছু কাটার আগে হাতের সুরক্ষায় নারকেল তেল ব্যবহার করতে পারেন। আর হাত ধোয়ার পরেও ময়েশ্চারাইজার হিসেবে নারকেল তেল ব্যবহার করতে পারেন। নখে নারকেল তেল ব্যবহার করলে নখের কিউটিক্যাল ভালো থাকবে। নখ সহজেই ভেঙে যাবে না। শীতকালে পায়ের গোড়ালি ফাটা সাধারণ একটি সমস্যা। অনেকে সারাবছর এ সমস্যায় ভোগেন। সেক্ষেত্রে কুসুম গরম পানিতে সোপ ফ্রি ক্লিনজার ও কয়েক ফোঁটা নারকেল তেল মিশিয়ে পা ভিজিয়ে কিছুক্ষণ রেখে ধুয়ে নিন। পা মুছে নারকেল তেল ব্যবহার করুন। এরপর শীতকালে নরম সুতার মোজা পরে থাকতে পারেন। অন্যান্য সময়ে শুধু নারকেল তেল ম্যাসাজ করে ঘুমালে পা ফাটার সমস্যা থাকবে না।
নারকেল তেলের অ্যান্টিব্যাকটেরিয়াল ও অ্যান্টি-ইনফ্লেমেটরি উপাদান আছে। আর তাই ইদানীং ওরাল মাউথওয়াশে নারকেল তেল ব্যবহার করা হচ্ছে। বডি ময়েশ্চারাইজার হিসেবেও এটি নিরাপদ। যাদের শরীরে অ্যাকজিমা ও সোরিয়াসিস আছে তাদের শীতকালে চিকিৎসকেরা নারকেল তেল ব্যবহারের পরামর্শ দেন। গলার ভাঁজ, হাঁটুর ভাঁজ এসব ভাঁজে ভাঁজে নারকেল তেল ব্যবহার করলে ঘেমে গিয়ে ফাঙাল ইনফেকশন হতে পারে।
সাবধানতা
যদিও নারকেল তেল খুব উপকারী, তবুও এই তেল ব্যবহারে কিছু নিয়ম মানতে হবে। যদিও নারকেল তেল সব ত্বকের জন্য নিরাপদ, তবুও এর ব্যবহারে কারও কারও ত্বকে অ্যালার্জি দেখা দিতে পারে। যাদের ত্বক তৈলাক্ত, যাদের ব্রন হয় তারা মুখে নারকেল তেল ব্যবহার করবেন না। এতে পোর বন্ধ হয়ে যায়। ত্বকের তেল নিঃসরণ বেড়ে গিয়ে ব্রন হয়। পরে ক্ষত দেখা দেয়। যাদের ত্বক খুব শুষ্ক তারা মেকআপ রিমুভার হিসেবে নারকেল তেল ম্যাসাজ করতে পারেন। এখন বাজারে নারকেল তেলযুক্ত মেকআপ রিমুভার পাওয়া যায়।
লেখক : ডার্মাটোলজিস্ট, শিওর সেল মেডিকেল বাংলাদেশ, ওউনার অ্যান্ড ফাউন্ডার রিজুভা কসমেসিউটিক্যালস লিমিটেড