স্পিন জাদুকর শেন ওয়ার্ন

27 Apr 2022, 12:22 PM ক্রীড়াভুবন শেয়ার:
স্পিন জাদুকর শেন ওয়ার্ন

পৃথিবীর অন্যতম সেরা লেগ স্পিনার অস্ট্রেলীয় ক্রিকেটার শেন ওয়ার্ন। যিনি একদিনের আন্তর্জাতিক ম্যাচে অস্ট্রেলিয়ার জাতীয় দলের অধিনায়কত্ব করেছিলেন। শেন ওয়ার্ন ১৯৯৪ খ্রিষ্টাব্দে উইজডেন ক্রিকেটার্স অ্যালম্যানাক-এ বর্ষসেরা উইজডেন ক্রিকেটার নির্বাচিত হয়েছিলেন। শেন ওয়ার্ন আন্তর্জাতিকভাবে খেলার পাশাপাশি তার নিজ রাজ্য ভিক্টোরিয়ার হয়ে ঘরোয়া ক্রিকেট এবং হ্যাম্পশায়ারের হয়ে ইংলিশ ঘরোয়া ক্রিকেট খেলেছেন। তিনি ২০০৫ থেকে ২০০৭ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত তিন মৌসুমে হ্যাম্পশায়ারের অধিনায়ক ছিলেন। শেন ওয়ার্ন ১৯৯২ খ্রিষ্টাব্দে তার প্রথম টেস্ট ম্যাচ খেলেন এবং ১০০০-এর বেশি আন্তর্জাতিক উইকেট [টেস্ট এবং একদিনের আন্তর্জাতিক] নিয়েছিলেন।
শেন ওয়ার্ন মূলত লেগ স্পিনার ছিলেন তবে লোয়ার অর্ডারে কার্যকর ব্যাটিংও করতেন। তাছাড়া ২০১৩ খ্রিষ্টাব্দে শেন ওয়ার্নকে আইসিসি ক্রিকেট হল অব ফেমে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল।

শেন ওয়ার্ন চল্লিশ হাজারেরও বেশি বল করেছিলেন টেস্ট ক্রিকেটে। সে হিসেবে প্রথম শ্রেণির ক্রিকেট-সহ তাঁর বলের সংখ্যা প্রায় পঁচাত্তর হাজার। একটিমাত্র বল তাকে এনে দিয়েছিল সেরার তকমা। সেটি ছিল মাইক গ্যাটিং-কে বোল্ড-আউট করা স্পিন জাদুর এক আশ্চর্য বল। এমন ঘুর্ণি পাকিয়ে বলটি করেছিলেন, যেটা দেখে ক্রিকেটপ্রেমীরা হতবাক হয়ে গিয়েছিল। সেই বল নিয়ে আলোচনাও হয়েছে বহুদিন। মাথায় সোনালি চুল এবং ঠোঁটে ঝিংক অক্সসাইড লাগিয়ে এমনভাবে হাঁটতেন, দেখে মনে হতো তিনি দৌড়াচ্ছেন। হেলেদুলে হাঁটতে হাঁটতে বোলিং মার্কের কাছাকাছি এসেই বল ডেলিভারির সময় হঠাৎই পাল্টে যেত সবকিছু। অসাধ্য এবং দুর্বোধ্য কিছু বেরিয়ে আসত তার হাতের বোলিং থেকে। তার বোলিং জাদুতে ক্রিকেট বিশ্ব চমকে যেত বারবার। শেন ওয়ার্ন অল্প বয়সেই প্রতিভার স্বাক্ষর রেখেছেন, মেন্টন গ্রামারে পড়ার জন্য একটি ক্রীড়া বৃত্তি অর্জন করেন। তিনি প্রথম ভিক্টোরিয়া ক্রিকেট অ্যাসোসিয়েশন অনূর্ধ্ব-১৬ ডাউলিং শিল্ড প্রতিযোগিতায় মেলবর্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিনিধিত্ব করেন। কিশোর বয়সে ফুটবলও খেলেছেন তিনি।
অভিষেক
১৯৯২ খ্রিষ্টাব্দের ২ জানুয়ারি সিডনিতে ভারতের বিপক্ষে একটি টেস্ট ম্যাচে তার আন্তর্জাতিক অভিষেক হয়। ড্যাবু ম্যচে ১৫০ রানের বিনিময়ে মাত্র একটি উইকেট নিয়েছিলেন তিনি। তাই কারো নজর কাড়তে পারেনি তিনি।

গৌরবের উত্থানশেন ওয়ার্ন প্রথম চোখে পড়েন অস্ট্রেলিয়া বি স্কোয়াডে খেলার সময় প্রথম নজরে আসেন। জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে তিনি তার প্রথম পাঁচ উইকেট শিকার করেন। ১৯৯৪-এর ২ জানুয়ারি ওয়ার্ন দক্ষিণ আফ্রিকার বিরুদ্ধে দ্বিতীয় টেস্ট ম্যাচে ১২ উইকেট নিয়েছিলেন, ৫ রানে ম্যাচ হেরে গেলেও অস্ট্রেলিয়ান বোলিংয়ে নিজেকে গুরুত্বপূর্ণ প্রমাণ করেন।
একদিনের আন্তর্জাতিকে ওয়ার্ন নিজেকে ঠিক ততটাই কার্যকর প্রমাণ করেন, তিনি ১৯৯৬ খ্রিষ্টাব্দে উইলস বিশ্বকাপে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে সেমিফাইনালে ৪/৩৬ ম্যাচ জয়ী পারফরম্যান্সের মাধ্যমে ১২ উইকেট নিয়েছিলেন। তবে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে ফাইনালে হেরে যায় অস্ট্রেলিয়ায়। তার অন্যতম সেরা পারফরম্যান্স ১৯৯৪ খ্রিষ্টাব্দে ব্রিসবেনে ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে ৮/৭১ নিয়েছিল। কারণ, ইংলিশদের ৫০৮ রান তাড়া করতে হয়েছিল কিন্তু ওয়ার্নের শোষণের কারণে ১৮৪ রানে পিছিয়ে পড়েছিল।

ব্যক্তিজীবনশেন ওয়ার্ন ১৩ সেপ্টেম্বর ১৯৬৯ খ্রিষ্টাব্দে অস্ট্রেলিয়ার ভিক্টোরিয়ায় ফার্নট্রি গুল্লি এলাকায় জন্মগ্রহণ করেন। শেন ওয়ার্নের বাবা ছিলেন জার্মান বংশোদ্ভূত। কিথ ওয়ার্ন এবং মা ব্রিজেট ওয়ার্নের ঘরে দুই সন্তান শেন ওয়ার্ন এবং তার ভাই জেসন ওয়ার্ন। শেন ওয়ার্ন ১৯৯৫ খ্রিষ্টাব্দে সিমোন ক্যালাহানকে বিয়ে করেন। এই দম্পতির জ্যাকসন ওয়ার্ন এবং সামার ওয়ার্ন নামে তার দুই ছেলে এবং ব্রুক ওয়ার্ন নামে তার এক মেয়েও রয়েছে। শেন ওয়ার্ন ২০০৫ খ্রিষ্টাব্দে তার স্ত্রীর থেকে আলাদা হয়ে যান। শেন ওয়ার্ন হ্যাম্পটন হাইস্কুলে গ্রেড সেভেন থেকে নাইন অবধি পড়াশোনা করেন। এরপর মেনটোন গ্রামারে চলে যান স্পোর্টস স্কলারশিপ পেয়ে। স্কুলজীবনে শেষ তিন বছর কাটিয়েছেন মেনটোনে।

শেন ওয়ার্নের সেরা রেকর্ডশেন ওয়ার্ন দ্বিতীয় সর্বোচ্চ উইকেট শিকারি। তিনি তার আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ৩৩৯টি ম্যাচে মোট ১০০১টি উইকেট নিয়েছেন।
আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারে শেন ওয়ার্ন একটিও সেঞ্চুরি না হাঁকিয়ে সর্বাধিক ৪১৭২ রান করেছেন। তার সর্বোচ্চ ব্যক্তিগত স্কোর হলো ৯৯ রান।
বিশ্বের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ খেলোয়াড় হিসেবে অনন্যসাধারণ লেগ স্পিনার শেন ওয়ার্ন টেস্ট ম্যাচে ১০ বার ১০ উইকেট নেওয়ার কৃতিত্ব অর্জন করেছেন।
২০০৬ খ্রিষ্টাব্দে টেস্ট ক্রিকেটে সর্বপ্রথম ৭০০ উইকেট নেওয়ার কৃতিত্ব অর্জন করেন শেন ওয়ার্ন। দ্বিতীয় দ্রুততম খেলোয়াড় হিসেবে তিনি ১৪৪ টেস্টে এই মাইলফলক স্পর্শ করেছিলেন।
শেন ওয়ার্ন একটি ক্যালেন্ডার বর্ষে সর্বোচ্চ ৯৬টি টেস্ট উইকেট নেওয়ার বিশ্বরেকর্ড গড়েন। ২০০৫ খ্রিষ্টাব্দে তিনি মাত্র ১৫টি টেস্টে এই কৃতিত্ব অর্জন করেছিলেন। এই সময় ৬ বার একটি ইনিংসে ৫ বার তারও বেশি উইকেট নেন।
আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে সর্বোচ্চ বল করার তালিকায় শেন ওয়ার্ন তৃতীয় স্থানে রয়েছেন। তিনি তার ক্রিকেট ক্যারিয়ারে মোট ৫১,৩৪৭টি বল ডেলিভারি করেছেন।
আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে এক ইনিংসে সর্বোচ্চ পাঁচ উইকেট নেওয়ার ক্ষেত্রে শেন ওয়ার্ন তৃতীয় স্থানে রয়েছেন। তিনি ৪৬৪ ইনিংসে মোট ৩৮ বার এই কৃতিত্ব অর্জন করেন।
আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে শেন ওয়ার্ন মোট ২৯ বার ‘ম্যান অব দ্য ম্যাচ’-এর পুরস্কার পেয়েছেন। এছাড়া ৯ বার ‘ম্যান অব দ্য সিরিজ’ নির্বাচিত হয়েছিলেন।
শেন ওয়ার্ন বিশ্বের একমাত্র ক্রিকেটার যিনি ১৯৯৯ খ্রিষ্টাব্দের বিশ্বকাপের সেমিফাইনাল ও ফাইনালে দুর্দান্ত পারফরমেন্স করে উভয় ম্যাচেই সেরা হয়েছিলেন। এই কৃতিত্ব আর কোনো খেলোয়াড়ের নেই।
এছাড়া শেন ওয়ার্নের ক্যারিয়ারের বিশেষ দিক হলো, ১৯৯৩ খ্রিষ্টাব্দে মাইক গ্যাটিংকে আউট করা ডেলিভারিটি হয় ‘শতাব্দীর সেরা বল’। তিনি ১৯৯৩ থেকে ২০০৫ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে পাঁচবার অ্যাশেজ জয়ী ও ১৯৯৯ বিশ্বকাপ জয়ী দলের সদস্য ছিলেন। এরপর ২০০৮ খ্রিষ্টাব্দের আইপিএল উদ্বোধনীতে মরসুমে তার নেতৃত্বে রাজস্থান রয়্যালস চ্যাম্পিয়ন হয়।
টেস্ট ক্যারিয়ার
ভারতের বিপক্ষে টেস্ট ম্যাচ দিয়ে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে তার অভিষেক হয় ১৯৯২ খ্রিষ্টাব্দের ২ জানুয়ারি। ১৪৫টি টেস্ট ম্যাচের ২৭৩টি ইনিংসে তিনি ৭০৮টি উইকেট নিয়েছেন। এছাড়াও, লোয়ার অর্ডারে ১৯৯ ইনিংসে ব্যাট করে তুলেছেন ১২টি হাফ সেঞ্চুরি। তার ইনিংস সেরা বোলিং ফিগার ছিল ৮-৭১। নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে তিনি টেস্ট ক্যারিয়ারে সর্বোচ্চ ৯৯ রান করেন। ২০০৭ খ্রিষ্টাব্দে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে তিনি শেষ টেস্ট ম্যাচ খেলে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট থেকে অবসর নেন। ৩ ডিসেম্বর ২০০৭ খ্রিষ্টাব্দে ? মুরালিধরন তাকে টপকে যাওয়ার আগ পর্যন্ত তিনিই ছিলেন টেস্ট ইতিহাসের সর্বোচ্চ উইকেট শিকারি।

ওয়ানডে ক্যারিয়ার
ওয়ানডেতে অস্ট্রেলিয়ার হয়ে ২৯৩টি উইকেট নেন ওয়ার্ন। তার অসাধারণ পারফর্মেন্সে অস্ট্রেলিয়া ১৯৯৯ ক্রিকেট বিশ্বকাপ জেতে, যেখানে তিনি সেমিফাইনাল ও ফাইনালের সেরা খেলোয়াড় নির্বাচিত হন। ১৯৯৬ বিশ্বকাপের রানার্সআপ দলের অন্যতম সদস্য ছিলেন তিনি।
টি২০ ক্যারিয়ার
আন্তর্জাতিক ক্রিকেট থেকে অবসরের পরে ওয়ার্ন আইপিএল ও বিগ ব্যাশে টি-২০ লিগ খেলতে থাকেন। তার নেতৃত্বেই রাজস্থান রয়েলস প্রথম আইপিএল চ্যাম্পিয়ন হয়। যেখানে তার অধিনায়কত্ব প্রশংসিত হয়েছিল। বিগ ব্যাশে তিনি মেলবোর্ন স্টার্সের অধিনায়ক ছিলেন। ২০১৩ খ্রিষ্টাব্দে তিনি বিগ ব্যাশ খেলে সব ধরনের ক্রিকেট থেকে অবসর নেন।

বিতর্ক
শেন ওয়ার্ন ২০০০ খ্রিষ্টাব্দে বিবাহিত অবস্থায় একজন ব্রিটিশ নার্সকে কামোত্তেজক টেক্সট বার্তা পাঠিয়েছিলেন। সেজন্য তাকে শাস্তিও পেতে হয়েছিল। যার খেশারত দেন তার অস্ট্রেলিয়ান সহ-অধিনায়কত্ব হারিয়ে। কিছু কিশোর ছেলেপেলে তার ধূমপানের ছবি তোলায় তাদের সঙ্গে ঝগড়াতেও জড়িয়ে ছিলেন তিনি। তারপর শেন ওয়ার্ন ধূমপান ছেড়ে দিয়ে একটি নিকোটিন প্যাচ কোম্পানির স্পনসরশিপ গ্রহণ করেছিলেন। তাছাড়া ২০০৩ খ্রিষ্টাব্দের বিশ্বকাপের আগে ডোপ টেস্টের ফলাফল পজিটিভ আসায় তার ক্রিকেট খেলার ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি হয়।
স্ত্রী সিমোনের সঙ্গে বিচ্ছেদের পর শেন ওয়ার্ন একজন ইংরেজ অভিনেত্রী এলিজাবেথ হার্লির সঙ্গে ডেট করেন। যদিও প্রথমদিকে হার্লির সঙ্গে সম্পর্কটি বেশিদিন টিকবে না বলে মনে হয়েছিল। হার্লির সঙ্গে সম্পর্ক থাকাকালীন শেন ওয়ার্ন একজন বিবাহিত মেলবোর্ন ব্যবসায়ীকে শ্লীলতাহানিমূলক মেসেজ টেক্সট করেন। তারপর ওই দম্পতি একটি মিডিয়া উন্মাদনা তৈরি করেছিলেন এবং যার ফল, হার্লি শেন ওয়ার্নের ব্রাইটন ম্যানশনে এসে ওঠেন। ২০১১ খ্রিষ্টাব্দের শেষের দিকে হার্লি এবং শেন ওয়ার্নের বাগদান নিশ্চিত করা হয়েছিল।

মৃত্যু
হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে ২০২২-এর ৪ মার্চ থাইল্যান্ডে নিজ বাড়িতে ৫২ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন তিনি। সেখানে ছুটি কাটাতে গিয়েছিলেন বিশ্বের অন্যতম লেগ স্পিনার শেন ওয়ার্ন।

শেষকৃত্য
৩০ মার্চ রাষ্ট্রীয়ভাবে অনুষ্ঠিত হয় ক্রিকেটের স্পিন জাদুকর শেন ওয়ার্নের শেষকৃত্য। একটি বিবৃতিতে ভিক্টোরিয়া সরকার জানান, ওয়ার্ন শুধু একটি ক্রিকেট প্রজন্মকে অনুপ্রাণিত করেননি, তিনি এটিকে সংজ্ঞায়িত করেছেন।

লেখা : শহীদুল ইসলাম এমেল
তথ্যসূত্র ও ছবি : ইন্টারনেট