ত্বকের গাঢ় দাগ মেছতা বা মেলাজমা একদিকে যেমন সৌন্দর্য হানিকর ঠিক তেমনি মন খারাপের কারণও হয়ে দাঁড়ায়। আমাদের ত্বকে মেলানিন নামক এক ধরনের রঞ্জকপদার্থ থাকে। কোনো কারণে ত্বকের কোনো স্থানে এই মেলানিন যদি স্বাভাবিকের তুলনায় বেশি মাত্রায় তৈরি হয় তখন ত্বকের সেই স্থানটি একটু গাঢ় বর্ণ ধারণ করে এবং দেখা দেয় এই অনাকাক্সিক্ষত মেছতা বা মেলাজমা। কপালে, নাকে, গালে, চিবুকে, থুতনিতে, গলায়, ঘাড়ে, বাহুতে মেছতা বা মেলাজমা হতে পারে।
ছেলে এবং মেয়ে উভয়েরই মেছতা দেখা দেয়, তবে মেয়েদের একটু বেশি হয়। মেয়েদের মেছতার কারণগুলো হলো প্রেগন্যান্সি, জন্মনিয়ন্ত্রণ বড়ি, অনেক সময় ধরে হরমোন রিপ্লেসমেন্ট থেরাপি নেওয়া এবং ভুল প্রসাধনী ব্যবহার। ছেলে এবং মেয়ে উভয়েরই যে-সকল কারণে মেছতা হয়ে থাকে তার মধ্যে প্রধান কারণ হচ্ছে অতি বেগুনি রশ্মিÑ যা আসে সূর্য থেকে, আমাদের দৈনন্দিন জীবনে ব্যবহৃত ল্যাপটপ, গ্যাজেট, মোবাইল থেকে, চুলার আগুন থেকে। এছাড়াও যারা মিডিয়ায় কাজ করেন, দীর্ঘক্ষণ ধরে হাই এনার্জি ভিজিবল লাইটে কাজ করতে হয়, এখান থেকেও কিন্তু অতি বেগুনি রশ্মি আসে যা থেকে মেছতার উদ্রেক হতে পারে। দীর্ঘদিন ধরে থাইরয়েড ডিজঅর্ডার, লিভার ডিজঅর্ডারে ভুগছেন বা এন্টি-এপিলেপ্টিক ড্রাগ খাচ্ছেন তাদেরও কিন্তু মেছতা হতে পারে। এছাড়া লাইফস্টাইল তো একটা বিষয় আছেই, যেখানে ইমোশনাল স্ট্রেস এবং নানা ধরনের ভুল প্রোডাক্ট ত্বকের জন্য ব্যবহারও আমাদের মেছতার কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
মেছতা যখন হবে, দর্শকদের কাছে আমার অনুরোধ থাকবে নিজে নিজে কখনো এর চিকিৎসা করবেন না। কারণ অধিকাংশ ক্ষেত্রে দেখা যায় যে ড্রাগ স্টোর, ফার্মেসি বা ওভার দ্য কাউন্টার থেকে কোনো একটা ক্রিম ব্যবহার করে এ মেছতাকে হয়ত সাময়িকভাবে কমিয়ে আনে কিন্তু পরবর্তীসময়ে ত্বকে নানা ধরনের উপসর্গ দেখা দেয়। যেমনÑ ব্রণ, অবাঞ্ছিত লোম, ত্বকের চামড়া পাতলা হয়ে যাওয়া। এছাড়াও মেছতা কিন্তু আরো দীর্ঘস্থায়ী হয়, আরো গাঢ় হয়।
মেছতা যখন হয়, আমরা ডার্মাটোলজিস্টরা যেভাবে চিকিৎসা দিয়ে থাকিÑ প্রথমত আমরা হিস্ট্রি নিয়ে এবং ত্বক পর্যবেক্ষণ করে ত্বকের ধরন অনুযায়ী একটি বেসিক স্কিন কেয়ার দিয়ে থাকি, যেখানে সানস্ক্রিন, ময়েশ্চারাইজার, ক্লিনজার থাকে। যেগুলো আমাদের লক্ষ্য থাকে যে, ত্বককে যেন উজ্জ্বল করে। আর যে সকল জায়গায় ত্বকের রং গাঢ় হয়েছে অর্থাৎ মেছতা হয়েছে সে সকল স্থানে আমরা স্কিন লাইটেনিং কোনো ক্রিম, লোশন বা ইমালশন দিয়ে থাকি। এ সকল স্কিন লাইটেনিং প্রোডাক্টে সাধারণত লিকোরাইশ, আরবুটিন, কজিক অ্যাসিড, ল্যাকটিক অ্যাসিড, হাইড্রোকুইনোন এবং নানা ধরনের গøাইকোলিক অ্যাসিড থাকে। আর আমরা ডার্মাটোলজিস্টরা সব থেকে যে বিষয়টিকে গুরুত্ব আরোপ করি, সেটি হচ্ছে সানস্ক্রিন। সানস্ক্রিন এমনভাবে আমরা চুজ করে থাকি সেটি যেন অবশ্যই ত্বকের ধরন অনুযায়ী হয় এবং ব্রড স্পেকট্রাম অর্থাৎ এসপিএফ ৫০ পিএ+++ এবং এন্টি-অক্সিডেন্ট যুক্ত হয়। কারণ, যে-সকল ক্ষতিকর রশ্মি আমাদের ত্বকে মেছতা তৈরি করে থাকে সেগুলো থেকে রক্ষা পেতে কিন্তু এন্টি-অক্সিডেন্ট যুক্ত সানস্ক্রিন ব্যবহার করতে হবে।
এছাড়া নানা ধরনের ওরাল সাপ্লিমেন্ট দেওয়া হয়ে থাকে এদের মধ্যে এন্টি-অক্সিডেন্টকে আমরা বেশি প্রাধান্য দিয়ে থাকি। লাইকোপেন, গ্রিন টি এক্সট্রাক্ট, ভিটামিন এ, ভিটামিন সি, ভিটামিন ই এন্টি-অক্সিডেন্টযুক্ত সানস্ক্রিন দিয়ে থাকি। এই এন্টি-অক্সিডেন্টগুলো একদিকে যেমন ত্বককে উজ্জ্বল করে, তেমনি মেলানিন প্রোডাকশন অতিমাত্রা থেকে সাধারণ মাত্রায় নিয়ে আসে। এগুলোকে আমরা ওরাল সানস্ক্রিনও বলে থাকি। কেউ যদি ত্বকে সানস্ক্রিন ব্যবহার করে এবং সঙ্গে এই এন্টি-অক্সিডেন্টগুলো সাপ্লিমেন্ট হিসেবে নিয়ে থাকে বা এন্টি-অক্সিডেন্টযুক্ত খাবার খেয়ে থাকে তাহলে কিন্তু সানস্ক্রিনের কার্যকারিতা আরো বেড়ে যায় এটা রিসেন্ট একটি ডাটাতে দেখা গেছে। এছাড়াও কিছু আধুনিক চিকিৎসা যেমন মাইক্রোনিডলিং, পিআরপি, ফটোফেসিয়াল, লেজার, নানারকম পিলিং যেমন, কেমিক্যাল পিলও আমরা করে থাকি আর এন্টি-অক্সিডেন্ট ইন্ট্রাভেনাস থেরাপিও আমরা দিয়ে থাকি। তবে মেছতা হলে আপনারা অবশ্যই কোনো চিকিৎসকের পরামর্শ নেবেন এবং চিকিৎসক আপনার ত্বক দেখে ত্বকের ধরন অনুযায়ী আপনার মেছতার ধরন অনুযায়ী আপনাকে চিকিৎসা করবেন।
বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, যে-সকল পেশেন্টকে মেছতার অন্যান্য চিকিৎসার পাশাপাশি ওরাল ট্রানেক্সামিক অ্যাসিড ব্যবহার করতে দেওয়া হয়েছে তাদের মেছতা পুর্বের চেয়ে অনেকাংশেই কমে গিয়েছে বা অনেক ক্ষেত্রে একেবারেই চলে গেছে। তাই এখন ডার্মাটোলজিস্টরা মেছতার চিকিৎসায় ওরাল ট্রানেক্সামিক এসিড ব্যবহার করছেন।
লেখক : কনসালটেন্ট, ডারমাটোলজিস্ট
সিওরসেল মেডিকেল বাংলাদেশ লিমিটেড, গুলশান-১, ঢাকা-১২১২