নতুন বছরে অনেকেরই থাকে অনেক রকম পরিকল্পনা। স্বাস্থ্যের জন্যও পরিকল্পনা প্রয়োজন। আর প্রয়োজন সেই অনুযায়ী কাজ করে যাওয়া। কিছু ছোটো ছোটো পদক্ষেপ নিলে কিন্তু পুরো বছরজুড়েই সুস্থ থাকা যায়। পুরো বছর জুড়ে যেন ভালো থাকা যায় সেজন্য কী কী পরিকল্পনা আমাদের মাথায় রাখতে পারি ?
আমি প্রতিটি বছর শুরু করি একটি নতুন পরিকল্পনা নিয়ে, আমাকে নিয়ে এবং আমার দর্শকদের নিয়ে। ২০১৭ সালে ছিল ডিটক্সিফিকেশন রুটিন। শরীর থেকে বেশি বেশি টক্সিন [বিষাক্ত পদার্থ] কীভাবে বের করতে পারব, এ নিয়ে ছিল বছর জুড়ে পরিকল্পনা। এরপর ২০১৮ সালে আমার পরিকল্পনায় ছিল বছরজুড়ে ত্বকের যতœ। কীভাবে আমরা প্রাত্যহিক, সাপ্তাহিক ও বছরজুড়ে ত্বক ভালো রাখতে কাজ করব এগুলো ছিল পরিকল্পনায়।
এ বছর আমার পরিকল্পনা হচ্ছে দীর্ঘমেয়াদি জীবন। সেই দীর্ঘমেয়াদি জীবনে কম অসুখ থাকবে সুস্থ থাকব, আমাদের যে দীর্ঘমেয়াদি রোগ রয়েছে সেগুলো কীভাবে নিয়ন্ত্রণে রাখব যাতে ভবিষতে না হয়, তার জন্য একটি সুন্দর পরিকল্পনা।
দৈনন্দিন জীবনে যেভাবে চললে বছরজুড়ে সুস্থ থাকতে পারবেন
প্রতিদিন আমরা খাবার গ্রহণ করি। খাবার দাবার আমাদের রুটিনের মধ্যে পড়ে। সেই খাবারের বিষয়টিকে যদি আমরা দীর্ঘমেয়াদি জীবন যাপনের পরিকল্পনায় নিয়ে আসি তাহলে ভালো। মানে স্বাস্থ্যকর খাবার গ্রহণ, অস্বাস্থ্যকর খাবার বর্জন। এটি শুনে হয়ত সবাই বলবে, আমি তো আমার মতো করে খাই। হঠাৎ করে একটি খাবারের পরিকল্পনা কেমন করে করব ? তাদের জন্যই বলছি একটি সহজ খাদ্য পরিকল্পনা করুন। আমরা যদি এভাবে শুরু করি আজ থেকে যে দুধ চা ও দুধ- চিনিযুক্ত কফির পরিবর্তে শুধু বø্যাক কফি পান করব তাহলে ভালো। মানে সেখানে চিনি ও দুধ থাকবে না এবং লাল চা পান করতে পারি। অথবা ভেষজ চা বা যেকোনো ধরনের গ্রিন টি পান করা যেতে পারে। এগুলোতে রয়েছে প্রচুর পরিমাণ অ্যান্টি অক্সিডেন্ট এবং বায়োফ্লেভনয়েড। এগুলো আমাদের সারাদিন ফুরফুরে রাখবে। পাশাপাশি শরীরের বিষাক্ত পদার্থ দূর করবে, আমাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াবে।
দ্বিতীয় সপ্তাহে আমরা কী করব ? আমরা নানা ধরনের স্ন্যাকস খাই। একটু ক্ষুধা লাগলে বিস্কুট খেয়ে নিলাম। বা একটু ফ্রেন্স ফ্রাইস, চিজ এগুলো খেয়ে ফেললাম। এগুলোর পরিবর্তে আমরা স্বাস্থ্যকর স্ন্যাকস খাই। সেই ক্ষেত্রে আমরা বাদাম, নানা রকম বীজ এগুলো খেতে পারি।
আমরা কিন্তু ভাতের প্রতি দুর্বল। আমরা মাছে-ভাতে বাঙালি। সেই ক্ষেত্রে আমরা মাছের প্রাধান্য দিই। সেই ক্ষেত্রে আমরা ভাতের বদলে আঁশযুক্ত কার্বোহাইড্রেট খাব। যেমন : কমপেক্স কার্ব। একদিন ওটস রাখতে পারি, একদিন কাউন রাখতে পারি, একদিন বাদামি চাল রাখতে পারি, একদিন বাদামি চালের আটা দিয়ে রুটি রাখতে পারি। এভাবে তৃতীয় সপ্তাহ থেকে অভ্যাস করতে পারি।
আমরা কিন্তু বাইরে খেতে পছন্দ করি অনেকে। একটু সময় পেলে আমরা পরিবার, বন্ধু-বান্ধব বা সহকর্মীদের নিয়ে বাইরে খেতে চাই। হ্যাঁ, আমরা বাইরে খাব, তবে সপ্তাহে যদি দুদিন খাই, কমিয়ে একদিন খাব। খাবার কী বেছে নেব ? একটু সালাদ বেছে নিই, একটু ইনফিউশন ওয়াটার বেছে নিই, একটু সিদ্ধ বা বেকড করা প্রোটিন বেছে নিই। এভাবে যদি আপনি একটু গুছিয়ে পরিকল্পনা করেন, দেখবেন একমাস পরে, অনেক বদঅভ্যাস এড়িয়ে যেতে পারছেন। আপনি নিজেই বুঝতে পারছেন না এবং বছর শেষে আপনার এই রুটিনটি থাকবে এবং আপনি এই রুটিনেই অভ্যস্ত হয়ে পড়বেন।
অনেকে হয়ত পরিকল্পনা করেন হাঁটব, ব্যায়াম করব। তবে দুই একদিন করেই হাঁপিয়ে যান। একটি গবেষণায় দেখা গেছে, যারা নিয়মিত ব্যায়াম করে, তাদের গড় আয়ু বেড়েছে এবং অ্যান্টি এজিং লুক নয় বছর কমেছে। অর্থাৎ সপ্তাহে অন্তত তিন ঘণ্টা ব্যায়াম জরুরি। তাহলে গড় হিসাবে আপনার প্রতিদিন কতক্ষণ আসছে ? ৩০ মিনিট। আমরা প্রতিদিন যদি ৩০ মিনিট করে হাঁটি বা জগিং বা আমাদের পছন্দমতো যেকোনো ব্যায়াম, যোগব্যায়াম, মেডিটেশন এগুলো যদি করি, অনেক ফিট থাকব। আমরা তো ক্যালোরি গ্রহণ করছি। আর ব্যায়াম যে কেবল আমার ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখছে তা নয়, আমাদের মন ভালো রাখছে, আমাদের ঘুমের মান বাড়াচ্ছে।
আর ছয় থেকে সাত ঘণ্টার পর্যাপ্ত ঘুম বিভিন্নভাবে আপনার উপকারে আসছে। ঘুমের মাধ্যমে করটিসল লেভেল [একে আমরা স্ট্রেস হরমোন বলি] নিয়ন্ত্রণে থাকছে, ঘুমের মাধ্যমে আপনার ফিলগুড হরমোন ডোপামিন, সেরোটোনিন, এগুলোর ভারসাম্য হচ্ছে। পর্যাপ্ত পরিমাণ নিঃসরণ হচ্ছে, আরেকটি হরমোন রয়েছে ল্যাকটিন। ল্যাকটিন আমাদের ক্ষুধা নিয়ন্ত্রণ করে। এটি যদি কমে যায়, তখন আমাদের নিজেদের ওপর নিয়ন্ত্রণ থাকে না, আমরা মুটিয়ে যাই। সেই জন্য ছয় থেকে সাত ঘণ্টার গুণগত ঘুম আমাদের পুরো জীবন নিয়ন্ত্রণ করছে। আমাদের মানসিক চাপ মুক্ত রাখছে।
একটু বিশ্রাম নিতে হবে। নিজেকে সময় দিতে হবে।
সুন্দর থাকার জন্য এবং ত্বক ভালো রাখার জন্য আমরা বছরজুড়ে যা করতে পারি
আমাদের ইংরেজি বছরের শুরু এবং বছরের শেষ কিন্তু শীতে। মাঝখানে থাকে গ্রীষ্ম, বর্ষা, শরৎ এই ঋতুগুলো। শীত বছরে শুরু ও শেষে হলেও কিন্তু স্থায়িত্ব খুব কম। তিন থেকে চার মাস বলা যেতে পারে। সেই ক্ষেত্রে বছরের এই সময় পালন করতে হবে শীতকালীন ত্বকের যতœ এবং বছরের অন্যান্য সময় পালন করতে হবে গ্রীষ্মকালীন ত্বকের যতœ। এই দুটো ভাগে ভাগ করলেই কিন্তু আমাদের ত্বক বছরজুড়ে সুস্থ থাকবে। এখন শীত ও গরমকালের ত্বকের যতেœর পণ্যগুলো একটু ভিন্ন হবে। আমি যদি মূল ত্বকের যতেœর রুটিন মেনে চলি তাহলে চলবে। যেমন : পরিচ্ছন্নতা, একটু ময়েশ্চারাইজেশন, একটু সুরক্ষা মেনে চলতে হবে। সবকিছুই থাকবে। কিন্তু পণ্যের বেলায় কী হবে ? আমি যে ময়েশ্চারাইজার ব্যবহার করছি, গরমে হয়ত একটু হালকা করব, শীতে একটু ভারি করব। আমি যে ক্লিনজার ব্যবহার করছি, গরমে একটু ভারি হবে, ফোমিং হবে, কিন্তু শীতে সেটি আরেকটু হালকা হবে।
পণ্য কেনার আগে কোন বিষয়গুলো আমরা দেখে নেব
পণ্যের ক্ষেত্রে আমরা প্রথমে দেখে নেব, এটি আমার বায়োলজিক্যাল ভারসাম্যকে বজায় রাখবে কি না। একে আমরা পিএইচ ব্যালেন্স বলি। পিএইচ সাধারণত এক থেকে চৌদ্দের মধ্যে থাকে। এক হলো বেশি এসিডিক, ১৪ হলো বেশি এলকালাইন। আমাদের ত্বক ও চুলের জন্য ভালো হলো পাঁচ দশমিক পাঁচ। এটি আমাদের ত্বকের সুরক্ষাকারী লেয়ারের যতœ নেয়। যেকোনো পণ্যে পাঁচ দশমিক পাঁচ রয়েছে কি না দেখে নেবে। এর পর পণ্যটি যত রাসায়নিক দ্রব্যহীন, বিষাক্ত দ্রব্যহীন, প্রিজারভেটিভহীন হবে, আমার ত্বকের জন্য তত ভালো। নতুন বছরে কিন্তু সাজগোজের একটি বিষয় থাকে। লিপস্টিক যখন কিনব লেডহীন কি না, দেখে কিনব। নেলপলিস তো আমরা দিই। এখন নেইলপলিশ রিমুভারের ক্ষেত্রে এসিটোন ফ্রি নেইলপলিস রিমুভার ব্যবহার করব। আর আমরা তো পরিচ্ছন্নতার জন্য চুলে শ্যাম্পু করি, সেই শ্যাম্পু যেন সালফেট ও সল্টহীন হয়। এই সালফেট ও সল্ট চুল থেকে স্বাভাবিক ময়েশ্চারাইজার শুষে নেয়। এটি চুলকে করে আরো রুক্ষ, আরো ক্ষতিগ্রস্ত। এই ছোটো বিষয়গুলো খেয়াল রাখলে অনেক বড়ো সমস্যা থেকে নিজেদের দূরে রাখতে পারব।
যেহেতু শীত, গোসলের সময় খুব হালকা কোনো সাবান বা ক্লিনজার দিয়ে গোসল করা উচিত। সাধারণত আমরা ওটমিল বাথ বা সল্ট বাথ বলি। চুলের জন্য সল্ট এড়াতে বলি, তবে গোসলের সময় যদি সিসল্ট বা এপসিম সল্ট কুসুম গরম পানিতে মিশিয়ে নেন তাহলে ত্বকের জন্য উপযোগী।
লেখক : কনসালটেন্ট, ডারমাটোলজিস্ট, সিওরসেল মেডিকেল বাংলাদেশ লিমিটেড, গুলশান-১, ঢাকা-১২১২