আজ ভ্রমর ভোলে মধু খেতে,
উড়ে বেড়ায় আলোয় মেতে,
আজ কিসের তরে নদীর চরে
চখাচখির মেলা।
-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
নদীতীর বা চরের মানুষ ছাড়া খুব কম মানুষই চখাচখিদের চিনে থাকে। অনেকটা হাঁসের মতো দেখতে। তবে, হাঁস যেমন নানা রঙের হয়, চখাচখি কিন্তু সেরকম নয় ; এদের গায়ের রং একইরকম। রংটিও বেশÑ একদম দারুচিনির মতো, না কমলা না খয়েরি ; মাঝামাঝি একটা রং। পৃথিবীর একটা বিশাল এলাকাজুড়ে এদের বসবাস। পাখি শিকারিরা এদের প্রচুর বিরক্ত করলেও এখনও আশঙ্কাজনক পর্যায়ে পৌঁছে যায়নি।
চখাচখি কিন্তু একটি পাখির নাম নয়- একজোড়া পাখির নাম। এরা জোড়ায় জোড়ায় থাকে বলে পুরুষ পাখিটিকে চখা আর স্ত্রী পাখিটিকে চখি নামে ডাকা হয়। দারুচিনি রঙের এই পাখিগুলো পানিতে সাঁতার কেটে ভেসে বেড়াতে ভালোবাসে। হাঁসের চেয়ে আকারে বড়ো চখা আর চাখির মধ্যে সামান্য কিছু পার্থক্য রয়েছে। চখা কমলা ও বাদামি থেকে দারুচিনি রঙের। মাথা ও ঘাড় হালকা বাদামি বর্ণের হয়। চখার লেজ কালো। আর গলায় থাকে সরু কালো বলয়। চখার চেয়ে চখি আকারে সামান্য ছোটো। ফিকে রংয়ের মাথাওয়ালা চখির গলায় বলয় থাকে না। চখাচখির চোখ হয় বাদামি। আর ঠোঁট, পা ও পায়ের পাতা কালো রঙের হয়।
চখাচখি পলিময় উপক‚ল, হ্রদ, বড়ো নদীর চরে বিচরণ করে। জোড়ায় জোড়ায় থাকলেও শীতকালে দল বেঁধেই চলে। এরা নিশাচর। ভোরবেলা ও সন্ধ্যাবেলায় বেশ সক্রিয় থাকে। কাদামাটি ও তৃণভূমিতেও খাবার খুঁজে বেড়ায়। সর্বভূক পাখি হিসেবে শস্যদানা, অঙ্কুরিত উদ্ভিদ, নরম পাতা, চিংড়িজাতীয় প্রাণী খেয়ে বেঁচে থাকে। শামুক, কেঁচো, ব্যাঙও এদের খাদ্য তালিকায় স্থান পায়।
এরা দেহের সামনের দিক পানিতে ডুবিয়ে চলাচল করে। মনে হয় যেন গলাপর্যন্ত পানিতে ঢোবানো। যদিও এরা পানিতেই থাকতে ভালোবাসে তবে ওড়াউড়িও কম করে না। এরা যখন আকাশে ওড়ে, তখন ‘আঙক’, ‘আঙক’ আওয়াজ তোলে। মাঝে মাঝে আবার হাঁসের মতো ‘প্যাক’, ‘প্যাক’ শব্দও করে। ডিম পাড়ার সময় একমাস এরা উড়তে পারে না।
মে-জুন মাসের দিকে ডিম পাড়ে। তারপর তা দিয়ে ছানা ফুটায়। ৬টি থেকে ১০টি পর্যন্ত ডিম পাড়ে। চখি একাই ডিমে তা দেয়। মালভূমির উঁচু এলাকা ও জলাভূমির পাশে মাটিতে গর্ত করে বাসা বানিয়ে ডিম পাড়ে। ডিমগুলো সাদা। চখা কাছাকাছি থেকে ডিম পাহারা দেয়। ২৮ থেকে ৩০ দিনেই ডিম ফুটে ছানা বের হয়। ছোটো ছানাগুলো ৫৫ দিন বয়সে উড়তে শেখে। বয়স দুই বছর হলেই এরা আবার ডিম পাড়ার উপযোগী হয়।
এশিয়া, ইউরোপ ও আফ্রিকার উত্তর ও দক্ষিণাঞ্চল এদের বিচরণ ক্ষেত্র। তবে, বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এরা পরিযায়ী পাখি হয়ে আসে। শীতের মৌসুমে বাংলাদেশের বিভিন্ন জলাশয়ে চখাচখির মেলা বসে।
লেখা : শ্যামল কায়া