ঋতুর বৈচিত্র্যের অপূর্ব লীলেক্ষেত্র বাংলাদেশ মূলত নাতিশীতোষ্ণ এক দেশ। এ দেশে শীতকালে শীতের তীব্রতা তেমন থাকে না। তাই শীতের সঙ্গী হয়ে পৃথিবীর শীতপ্রধান অনেক দেশ থেকে অতিথি বা পরিযায়ী পাখিরা একটু আশ্রয় ও খাদ্যের সন্ধানে আমাদের এখানে আসে। হাঁস, রাজহাঁস, কালেম, ডাহুক, ছোটো সরালি, খঞ্জনা, চটক, মাঠ চড়াই, কসাই পাখি, গাঙচিল, নীলশির, লালশির, কালো হাঁস, লেঞ্জা হাঁস, ক্ষুদে গাঙচিল, কুস্তিহাঁস, জিরিয়া, চখাচখি, বালিহাঁস, বড়ো সরালি, কালিবক, জলময়ূর, ডুবরি, কোপাডুবুরি, ছোটো পানকৌড়ি, বড়ো পানকৌড়ি, কালো কুট, কাদা খোঁচা বা চ্যাগা, জালের কাদাখোঁচা, ছোটো জিরিয়া, বাটান, গঙ্গা কবুতর, রাজ সরালি, পিন্টেল, পাতি সরালি, সাদা বক, দলপিপি, পানমুরগি, কাস্তেচড়া, বেগুনি কালেম, পানকৌড়ি, পিয়াং হাঁস, ভূতিহাঁস, ধুল এইসব পরিযায়ী পাখির সমাবেশ ঘটে আমাদের জলাশয়গুলোতে। ওদের রং-বেরঙের সৌন্দর্যে রঙিন হয়ে ওঠে জলাশয়গুলো। সুনামগঞ্জের টাংগুয়ার হাওড়, মৌলভীবাজারের হাকালুকি হাওড়, বাইক্কার বিল, বরিশালের দুর্গাসাগর, ভোলার চরগুলো, পাবনার চলনবিল, সুন্দরবনের নদনদী ও খাল, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের লেক পরিযায়ী পাখিদের প্রিয় আশ্রয়স্থল।
যে-সব দেশে শীতের তীব্রতা প্রচন্ড, খুব ঠান্ডায় পাখিদের যেখানে টিকে থাকা কঠিন হয়ে পড়ে, খাবার থাকে না, বাসা বাঁধার জায়গা পায় না- সে-সব দেশ থেকে হাজার হাজার মাইল পথ পাড়ি দিয়ে তারা আমাদের দেশে আসে। কখনো কখনো এমন দূর দেশ থেকে ওরা আসে যে, সেখান থেকে উড়ে আসতে প্রায় তিন মাস সময় লেগে যায়। কিছু দিন আমাদের দেশে থেকে আবার তারা ফিরে যায় নিজ নিজ গন্তব্যে। ফিরে যেতেও আবার তিন মাস উড়তে হয়। পাখিদের শরীরে এক ধরনের সংবেদ ও সাড়া প্রদান কৌশল থাকে প্রাকৃতিকভাবে, যা দিয়ে ওরা হাজার হাজার মাইল পথ পাড়ি দিয়ে ঠিকই আগের জায়গায় ফিরে যেতে পারে। যাত্রাপথের আকাশ, নক্ষত্র, পাহাড়, নদনদী, জলাভূমি, অরণ্য ইত্যাদি চিনে রাখে এবং এসবের সাহায্যে ঠিকই নিজের দেশে, আপন ঠিকানায় ফিরে যায়।
পৃথিবীতে প্রায় ১০ হাজার প্রজাতির পাখি আছে। গবেষকেরা এদের মধ্যে এক হাজার ৮৫৫ প্রজাতির পাখিকে পরিযায়ী পাখি হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। এর মধ্যে প্রতিবছর বাংলাদেশে প্রায় ৩১৬ প্রজাতির পরিযায়ী পাখি আসে। এর বেশিরভাগই আসে শীতে। অক্টোবরের শেষ বা নভেম্বরের শুরু থেকে ওরা অসতে শুরু করে। শীত কমে গেলে ফিরে যায় মার্চে। বাংলাদেশে পরিযায়ী পাখিগুলো প্রধানত আসে আমাদের উত্তরের দেশগুলো থেকে। বিশেষ করে হিমালয়, নেপাল, সাইবেরিয়া, মঙ্গোলিয়া, চীনের জিনজিয়ান, ইউরোপ ইত্যাদি অঞ্চল যখন শীতের দাপটে বরফে ঢেকে যায়, তখন সেখান থেকে পাখিগুলো উড়ে আসে। প্রাকৃতিক নিয়মেই ওরা জানে যে, কখন ওদের কোন দেশে আশ্রয় নিতে হবে। এজন্য আসার আগে ওরা পাখার নিচে চর্বি জমিয়ে রাখে। মাইলের পর মাইল ওরা উড়ে চলে সেই সঞ্চিত চর্বির শক্তিতে। ওরা সাধারণত দলবেঁধে চলে। যেখানে ওরা একবার আশ্রয় পায়, সেখানেই পরের বার আসার চেষ্টা করে।
দুঃখের কথা, কিছু কিছু লোভী মানুষ এই পরিযায়ী পাখিদের শিকার করে। এটি ঘোরতর অন্যায়। আমাদের অতিথি পাখিদের নিরাপত্তা দেওয়া আমাদেরই কর্তব্য।
লেখা : শ্যামল কায়া