শীত যখন আসে, আমাদের ত্বককে পরিবেশের দুটো জিনিসের সঙ্গে খাপ খাওয়াতে হয়। একটি হচ্ছে তাপমাত্রা, আরেকটি আর্দ্রতা। শীতে এ দুটোই কমে যায়। প্রকৃতির সেই প্রভাব পড়ে ত্বকের ওপর। শুষ্ক এ মৌসুমে আর্দ্রতার অভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় আমাদের ত্বক, ত্বকে আসে নিষ্প্রাণ ভাব।
শীতে ত্বকের যত্নে কী করবেন কী করবেন না
ত্বকের পরিচর্যায় প্রথমে আসে ত্বকের ধরন। আমরা সাধারণত ধরন বলতে বুঝি শুষ্ক, তৈলাক্ত বা স্পর্শকাতর ত্বক। কিন্তু এছাড়া আমাদের ডার্মাটোলজিস্টরা ত্বকের একটি ধরনের কথা বলে থাকেন। চুলের রং, চোখের আইরিশ ও ত্বকের টোনের ওপর বিষয়টি নির্ভর করে। এভাবে আমরা ছয়টি ধরন করি। টাইপ ১, ২, ৩ হলো একটু বেশি সাদা। টাইপ ৪, ৫ হলো বাদামি ত্বক। আর ৬ হলো একটু কালো ত্বক। সাধারণত এটা আফ্রিকানদের হয়ে থাকে।
টাইপ ১, ২ ও ৩-এর ক্ষেত্রে পোড়ে বেশি, তবে ট্যান কম হয়। আর আমরা যারা বাঙালি, তাদের ট্যান বেশি হয়, পোড়ে কম। শীত এলে আমাদের প্রথম ভয় হলো ত্বক সতেজতা হারাবে, একটু কালো হয়ে যাবে। আমরা তাই অনেক বেশি ব্লিচিং উপাদান বা লাইটেনিং উপাদান ব্যবহার করতে থাকি। এতে শীতের শেষে দেখা যায়, হয়ত অতিরিক্ত ময়েশ্চারাইজারের কারণে ত্বকে ব্রন বা র্যাশ হচ্ছে। অথবা পোস্ট ইনফ্লামেটরি হাইপার পিগমেন্টেশন হয়ে যাচ্ছে।
যেকোনো ত্বকের ধরনের জন্য অবশ্যই দরকার একবছর মেয়াদি এসপিএফ রুটিন। এসপিএফ রুটিন বলতে আমরা সানস্ক্রিনই বলব না, দিনে আমরা ঘরে বা বাইরে যাওয়ার জন্য যে পণ্যগুলো ব্যবহার করি, যেমন বিবি ক্রিম বা বিভিন্ন ভ্যানিশিং ক্রিম। এগুলোর সবকিছুতে এসপিএফ থাকতে হবে। শীতকাল দেখে যে আমি এসপিএফযুক্ত কিছু ব্যবহার করব না, এটি একদম ভুল। কারণ, শীতেও আলট্রাভায়োলেট রে বলিরেখা ও সানবার্ন দুটোই করে। আমরা এসপিএফ ও সানস্ক্রিনের সঙ্গে বেশি পরিচিত। আমাদের যে বাদামি ত্বক, ৪ ও ৫ নম্বর ধরনের, সেখানে এসপিএফ ৩০ ও ৫০ পর্যন্ত সানস্ক্রিন ব্যবহার করা বেশি ভালো হবে। আমরা স্বাভাবিক ত্বকের জন্য এমন একটি পণ্য ব্যবহার করব, সেটি সানস্ক্রিন হোক বা ময়েশ্চারাইজার পণ্য হোক, সেটি আমাদের বয়সের গতি রোধ করে।
আর্দ্রতা বজায় রাখার জন্য কোন কোন বিষয় মাথায় রাখা উচিত
শীতকালে ত্বকে চলে আসে বাড়তি শুষ্কতা। যাদের শুষ্ক ত্বক, তাদের ত্বক আরো বেশি শুষ্ক হয়ে যায়। প্রথমত ত্বকে যে ক্লিনজার ব্যবহার করব, যদি অয়েলসমৃদ্ধ হয়, দেখা যাবে একটি বাড়তি ময়েশ্চারাইজার ত্বকে চলে আসছে। আর এরপর যখন ময়েশ্চারাইজার ব্যবহার করব, দুটো জিনিসের প্রতি খেয়াল করতে হবে।
দ্বিতীয়ত, আমাদের ত্বকে লিপিড নামে একটি পদার্থ থাকে। সিমেন্ট যেমন ইটের ভাঁজে ভাঁজে দেওয়া হয়, সেরকমই লিপিড আমাদের ত্বকের আর্দ্রতা রক্ষা করে। শীতকাল এলে লিপিডটা নষ্ট হতে থাকে। তাই শুষ্ক ত্বকের ক্ষেত্রে পেট্রোলিয়াম জেলি, ফেসিয়াল ওয়েল, সেরামাইড, লিপিড-যুক্ত ক্রিম ব্যবহার করতে পারেন।
ঠোঁটের ত্বক কিন্তু একটু পাতলা। শীতকালে কিন্তু ঠোঁট অনেকটা কালো হয়ে যায়। কারণ, অক্সিজেনেশনের অভাব, এরপরও আবার ঠোঁটের চামড়া উঠে যায়। ছেলেদের ক্ষেত্রে এ সমস্যাগুলো বেশি হয়। কেননা, মেয়েরা যাই হোক, কিছু একটা ব্যবহার করছে। ঠোঁটের ময়েশ্চারাইজারটা কিন্তু কিছুটা হলেও বজায় থাকে। ছেলেদের ক্ষেত্রে সেটা হচ্ছে না। ঠোঁটে আমাদের লিপবাম ব্যবহার করতে হবে। ঠোঁট কোনোভাবে শুষ্ক রাখা যাবে না। আর যখন আমরা ১০টা থেকে ৫টার মধ্যে বাইরে যাব, এসপিএফ ১৫ যুক্ত কোনো লিপবাম, চ্যাপস্টিক বা লিপস্টিক ব্যবহার করব। এগুলো ঠোঁটের জন্য উপযোগী হবে।
লিপস্টিক যারা ব্যবহার করেন, তাদের প্রতি পরামর্শ হলো সুন্দর একটি রং দেখে, এর প্রতি আকৃষ্ট হয়ে ঠোঁট রাঙিয়ে নিলাম সেটি ঠিক হবে না। ভালো পণ্য ব্যবহার করতে হবে। যেন এটি লেড, ক্যাডমিয়াম, এলার্জেনমুক্ত হয়।
শীতে চুলের যত্নে কী করতে হবে
চুলে কিন্তু এ সময় একটি বাড়তি শুষ্কতা, রুক্ষতা আসে। সবাই অভিযোগ করে, আমার চুলের আগা ফেটে যাচ্ছে অথবা চুল ভেঙে যাচ্ছে। এগুলো এ সময় বেশি হয়। আমি বলব, শীতের আগেই আপনারা চুল ট্রিম করবেন। এতে শীতে একটা নতুন লুক আসবে আবার চুল স্বাস্থ্যকরও থাকবে। বাইরে বের হলে একটি হালকা কাপড় দিয়ে মাথা স্কার্ফ করেন, আর ছেলেরা যদি গেঞ্জি কাপড়ের হুডি ব্যবহার করেন, তাহলে কিন্তু চুল সুরক্ষিত থাকবে।
এরপর আসি চুল পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার বিষয় নিয়ে। শীতে গোসলের প্রতি একটি ভীতি থাকে। এগুলো থেকে চুলে খুশকি, উকুন হয়। সপ্তাহে তিনদিন তো শ্যাম্পু করতেই হবে চুলের ধরন অনুযায়ী। ত্বকের মতো চুলেও ময়েশ্চারাইজার প্রয়োজন। এখানে আমরা একে বলি কন্ডিশনার। চুল ধোয়ার আগে ২০ মিনিট কোনো প্রাকৃতিক তেল দিয়ে শ্যাম্পু করলে, এটি মাথার ত্বকের আর্দ্রতা বজায় রাখবে। চুল ধোয়ার পর আমরা যদি একটি কন্ডিশনার বা হেয়ার মাস্ক ব্যবহার করি এবং সেটি চুলের গোড়ায় না দিয়ে এক সেন্টিমিটার দূরে ব্যবহার করে তিন-চার মিনিট পরে ধুয়ে ফেলি, এটি ভালো কাজ করে। খুশকি যাদের আগে থেকেই আছে, তাদের এই সময়টায় বেশি বেড়ে যায়। খুশকি পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার অভাবে হয়। শীতের সময় অনেকে আলসেমি করে চুল ধুতে চান না। এতে চুলের ক্ষতি হয়, খুশকি বাড়ে। অনেক সময় কন্ডিশনার মাথায় থেকে গেলে খুশকি হয়। কিছু রোগের ক্ষেত্রেও খুশকি বেড়ে যায়। আর যাদের ত্বক শুষ্ক, তাদের ক্ষেত্রে খুশকি আরো বেড়ে যায়। খুশকির ক্ষেত্রে সপ্তাহে তিনদিন যে শ্যাম্পু ব্যবহার করতে হবে, সেটি একটু ভিন্ন রকম হবে। মেডিকেটেড শ্যাম্পু। কিটোকোনাজল বা জিংকা বা স্যালেনিয়াম সালফাইডযুক্ত কোনো শ্যাম্পু ব্যবহার করতে হবে। সেটি অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী। আর যদি খুশকির প্রবণতা আগে থেকেই থাকে, কিন্তু খুশকি তেমন হচ্ছে না, সে ক্ষেত্রে প্রতিসপ্তাহে একদিন করে অ্যান্টিডেনড্রাফ শ্যাম্পু ব্যবহার করার পরামর্শ দেব।
শীতে ত্বক সজীব রাখতে যা খাবেন
কিছু খাবার আছে, যা খেলে শীতেও আপনার ত্বক থাকবে উজ্জ্বল। মাছ, ডিম, মিষ্টি আলু, মিষ্টি কুমড়া, গাজর, অলিভ ওয়েল, বাদাম, ফুলকপি, বাঁধাকপি, টমেটো খাদ্যতালিকায় রাখুন। ভিটামিন সি-যুক্ত খাবার যেমন কমলা, মালটা, বাতাবি লেবু খেলে ত্বক কোমল রাখে।
লেখক : কনসালটেন্ট, ডারমাটোলজিস্ট সিওরসেল মেডিকেল বাংলাদেশ লিমিটেড, গুলশান-১, ঢাকা-১২১২
মডেল : অমিয়া অমানিতা