আবৃত্তির পরম্পরা ধরে রেখেছি -আহসান উল্লাহ তমাল

25 Aug 2021, 04:02 PM আবৃত্তি শেয়ার:
আবৃত্তির পরম্পরা ধরে রেখেছি -আহসান উল্লাহ তমাল

আহসান উল্লাহ তমাল। বর্তমানে বাংলাদেশ আবৃত্তি সমন্বয় পরিষদের সাংগঠনিক সম্পাদক এবং শব্দবৃত্তি আবৃত্তি সংগঠনের সভাপতি। একসময় মঞ্চ ও টিভির অভিনয়ের সঙ্গেও যুক্ত ছিলেন তিনি। তার বেড়ে ওঠা আবৃত্তি চর্চাসহ জীবনের নানা দিক নিয়ে বলেছেন এ আয়োজনে...

আনন্দভুবন : আবৃত্তিতে আসার অনুপ্রেরণা পেলেন কোথায় ?

আহসান উল্লাহ তমাল : আমার দাদা সাদাত আলী খান ছিলেন প্রথম মুসলমান উকিল, তার নামে কলকাতা শহরে রাস্তা আছে, আমার বাবা একজন পুলিশ কর্মকর্তা ছিলেন। বাবা আলিগড় বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালে সরকারি চাকরিতে যুক্ত হন অফিসার পদে। আমরা সাত ভাই চার বোন। ভাইদের মধ্যে আমি পঞ্চম। আমার এক বড়োভাই আহকাম উল্লাহ আবৃত্তির সঙ্গে যুক্ত। তিনি বাংলাদেশ আবৃত্তি সমন্বয় পরিষদের সাধারণ সম্পাদক। আবৃত্তিতে অনুপ্রেরণা পাই পরিবার থেকে, বাবা অসাধারণ আবৃত্তি করতেন, তিনি কবিতা লিখতেন। মা গান গাইতেন।

আনন্দভুবন : আপনার বেড়ে ওঠা কোথায় ?

আহসান উল্লাহ তমাল : আমাদের বেড়ে ওঠা মতিঝিলে, বাংলাদেশ ব্যাংকের পেছনে আমাদের বাড়ি ছিল। এটাকে মতিঝিলের বুড়ার বাগিচা বলে। এমন কোনো ফুল-ফলের গাছ ছিল না, যা আমাদের বাড়িতে ছিল না। পৌনে দুই বিঘা জায়গার উপরে ছিল এই বাড়ি। ঢাকা শহরের দক্ষিণ কমলাপুরের এই দারোগা বাড়িতে আমার বেড়ে ওঠা। বাবা আমাদের শিখিয়েছেন কীভাবে মানুষকে ‘মানুষ’ বলতে হয়, বাবা আমাদের ক্রিকেট খেলা শিখিয়েছেন। আমার বাবা ছিলেন তখনকার সিআই, মানে এখনকার এসপি। ব্যস্ত মানুষ হয়েও বাবা আমাদের ধরে ধরে খেলা শেখাতেন। তখন এমসিসি কাপ খেলা হতো ঢাকা স্টেডিয়ামে, অস্ট্রেলিয়া নিউজিল্যান্ড এসব দল বাংলাদেশে খেলতে আসত। তখন ফুটবল অনেক জনপ্রিয় খেলা বাংলাদেশে। এটা গত শতকের সাতের দশকের শেষভাগ ও আটের দশকের কথা। বাড়িতে আমরা ঘুড়ি ওড়াতাম, লাট্টু ঘুরাতাম, ফুটবল খেলতাম। পাড়া-প্রতিবেশী বন্ধুরা আমাদের বাসায় আসত। বাড়ির উঠানটা মাঠের মতো বড়ো ছিল। এখন যেটা আইসিডি, তখন সেটা মাঠ ছিল। এই পাড়ে কমলাপুর ওই পাড়ে মুগদাপাড়া মাঝখানে বিশাল মাঠ, এই মাঠে আমরা ক্রিকেট খেলতাম। আমরা সব ভাইবোন এক হলে একটা টিম হয়ে যেত। আমার বাবা আমাদের ধর্মীয় অনুশাসনের মধ্যে মানুষ করেছেন। তবে, আমাদের মনুষত্ব শিখিয়েছেন। কোনোদিন বলেননি যে, তোমার ওই বন্ধুটি হিন্দু, বাবা বলতেন সে মানুষ। বাবার একটি কবিতার চরণ এমন- ‘নরক আমার নয়কো ঘৃণার, সড়ক আমার নয়কো প্রিয়, শ্রষ্টা তুমি সৃষ্টি তোমার আমায় শুধু বুঝতে দিও, বুঝতে দিও জীবন-মরণ, বুঝতে দিও দুঃখ ব্যথা, বুঝতে দিও বাকপটুতা, বুঝতে দিও নীরব গাথা’। আমার মা বলতেন কখানো মানুষকে ছোটো করে দেখবে না, কখনো মানুষকে ধর্মীয় আবরণে দেখবে না। মা বলতেন জীবনে সঞ্চয় করতে শেখ, হিসাব করতে শেখ ; কিন্তু আত্মাকে কষ্ট দিও না।

আনন্দভুবন : বড়ো হয়ে আবৃত্তি শিখেছেন কোথায় ?    

আহসান উল্লাহ তমাল : অসম্ভব দরাজ কণ্ঠের অধিকারী ছিলেন আমার বাবা। আমরা কখনো কর্মশালা করে বা সংগঠনে কাজ করে আবৃত্তি শিখিনি। বাবার কাছেই শিখেছি। বাবা বলতেন, তুমি তোমার ঠোঁটকে মুখগহ্বরকে ব্যবহার করো। বাবা একেক দিন একেক কবিতা আবৃত্তি করতেন, আমরা হয়ত কিছু বুঝতাম না, কিন্তু মুগ্ধ হয়ে শুনতাম। বাবা কবিতার পঙ্ক্তি বলতে বলতে ব্যাখ্যা দিতেন, আমরা সেই শিশুমনে সেসবের অনেক কিছুর মানে বুঝতাম না। কিন্তু বাবার কণ্ঠে আবৃত্তি শুনে যে ভালো লাগা সেই ভালো লাগাটা থেকে যায়। আমাদের সময় তখন আবৃত্তির তেমন চর্চাও ছিল না, প্রশিক্ষণও ছিল না। কিন্তু আমরা স্কুলে বার্ষিক যে সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতা হতো সেখানে কখনো কখনো আবৃত্তি করতাম। অথবা অনুষ্ঠানে অন্যান্য আয়োজনের ফাঁকে ফাঁকে আবৃত্তি থাকত, অনেক সময় জোর করেই আবৃত্তি করতাম। আমি মতিঝিল টিএনটি হাই স্কুলে পড়তাম। স্কাউটিং করতাম। স্কুলের বাংলা স্যার বলতেন তোর উচ্চারণ ভালো, তুই আবৃত্তি করিস। আমার বড়ো ভাইদের উচ্চারণও ভালো ছিল। এসব অনুপ্রেরণা পেয়ে কৈশোরে আবৃত্তির প্রতি ভালোবাসা জন্মায়।

আনন্দভুবন : আবৃত্তির প্রেমে পড়লেন কখন ?

আহসান উল্লাহ তমাল : স্কুলে থাকাকালীন আমি ছাত্র রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হয়ে যাই, কলেজে এসে সেটা আরো বেগবান হয়। ছাত্রলীগের সঙ্গে যুক্ত হয়ে যাই, সেখান থেকে টিএসসিতে যাতায়াত শুরু হয়। স্বৈরাচার হটাও আন্দোলন শুরু হয় ১৯৮৭ সালে। সেই সময় কবিতা ছিল আন্দোলনের বড়ো হাতিয়ার। তখন ইস্তেকবাল ভাই আবৃত্তি করতে দাঁড় করিয়ে দিলেন। আবৃত্তি করলাম রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহর কবিতা। ‘দাঁড়াও নিজেকে প্রশ্ন করো, কোন দিকে যাবে ?’। প্রেমে পড়ে গেলাম আবৃত্তির, আবৃত্তি আমার প্রেমিকা হয়ে গেল। বাংলাদেশ আবৃত্তি সমন্বয় পরিষদ গঠিত হলো ১৯৮৮ সালে (১ বৈশাখ)। ওই সময় আন্দোলন আরো জোরালো হলো। জাতীয় কবিতা পরিষদের তৃতীয় জাতীয় কবিতা উৎসবে আমাকে যুক্ত করে দেয় আহকাম ভাইয়ের এক বন্ধু। সেদিন মঞ্চে ছিলেন গোলাম মুস্তাফা, শিমুল মুস্তাফা, কবি শেখর বরণ, সেখানে আবৃত্তি করি। এর আগে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে ফুটপাতে দাঁড়িয়ে আবৃত্তি করেছি। একসময় আমি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হই, আমার যাপিত জীবনের সঙ্গী হয়ে যায় আবৃত্তি। বর্তমানে আমার আবৃত্তির একটি দল আছে। দলের নাম ‘শব্দবৃত্তি’।

আনন্দভুবন : সাংগঠনিক আবৃত্তিচর্চায় যুক্ত হলেন কখন ?

আহসান উল্লাহ তমাল : সাংগঠনিক আবৃত্তিচর্চায় যুক্ত হই অনেক পরে। তখন শ্রোত আবৃত্তি সংসদে আমার বন্ধু স্ট্যালিন, আনজাম মাসুদ, ফয়সাল হাসানসহ অনেকে কালচারাল অঙ্গনে যুক্ত ছিল। আমি তাদের সঙ্গে কালচারাল অঙ্গনে যুক্ত হলাম। আমি তখন বিশ্ববিদ্যালয়ে রাজনীতি করতাম না। কারণ, আমি তখন মতিঝিল থানা ছাত্রলীগের কালচারাল সেক্রেটারি ছিলাম। বন্ধুদের সঙ্গে বিভিন্ন সংগঠনের আবৃত্তির ক্লাসে ঢুকে পড়তাম। তখন টিএসসিতে থাকা, টিএসসিতে আড্ডা, আর রাজনীতি করা এভাবেই কাটছিল সময়। এর মধ্যে রাজনীতির হয়রানির শিকার হই আমি। ’৯৩ সালে এসে আবৃত্তি থেকে একটু দূরে সরে আসি। কারণ, আজকে স্বরশ্রুতির যিনি সাধারণ সম্পাদক মীর মাসরুর জামান রনি তার একটি নাটক ‘মৃত্তিকার ক্যাম্পাস’ পরিবেশ থিয়েটারের ব্যানারে আশিস খন্দকারের নির্দেশনায় তৈরি হয়। এই নাটকে আমি নবাব সলিমুল্লাহ্র ভুমিকায় অভিনয় করি। এরপর শিল্পকলা একাডেমিতে কর্মশালাভিত্তিক একটি নাটক হয় ‘মধুমালা মদন কুমার’ নামে। নির্দেশনায় ছিলেন কামাল উদ্দিন নীলু । এই নাটকে এসে আনেকের সঙ্গে পরিচয় হয়। আমরা সবাই মিলে সিদ্ধান্ত নিই, নাটকের দল তৈরি করব। দলের নাম দিই ‘কালিক’ এই দলের ব্যানারে ’৯৭ সাল পর্যন্ত আমরা কাজ করি। আবার মনে হলো আমার আবৃত্তি করা দরকার। ততদিনে রাজনৈতিক  পটপরিবর্তন হয়ে গেছে। আমরা তিন ভাই রাজনৈতিক প্রতিহিংসার শিকার হলাম। ২০০৪ সালে বিশ্বকলাকেন্দ্রের ব্যানারে ‘জালাও আলো আপন আলো’ স্লোগানে কাজ শুরু হয়। আমি এতে যুক্ত হই। এটি কোনো সংগঠনের ব্যানারে আমার আবৃত্তিতে প্রথম কাজ। বিশ্বকলা কেন্দ্রে তখন আমি কর্মশালা সমন্বয়কারী হিসেবে কাজ করি। কিছুদিন পর আমার সঙ্গে তাদের মতপার্থক্য তৈরি হয়। তখন আবৃত্তিকার ও কবি, বিটিভির মহাপরিচালক কাজী আবু জাফর সিদ্দিকীকে আহ্বায়ক করে আমি সদস্য সচিব হয়ে আরো ক’জন সহযোদ্ধা মিলে ০৬-০৬-০৬ তারিখে 'শব্দবৃত্তি' গঠন করি। ০৭-০৭-০৭ তারিখে আমরা আত্মপ্রকাশ করি। পরবর্তীসময়ে পূর্ণাঙ্গ কমিটি হয়, জাফর ভাই যতদিন বেঁচে ছিলেন সভাপতি ছিলেন, বর্তমানে আমি সভাপতির দায়িত্ব পালন করছি। 


আনন্দভুবন : আবৃত্তি সমন্বয় পরিষদে যুক্ত হলেন কবে ?

আহ্সান উল্লাহ্ তমাল : বাংলাদেশ আবৃত্তি সমন্বয় পরিষদের সদস্য হই ২০১১ সালে। সেখানে কিছুদিন প্রশিক্ষণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করি। তখন বাংলাদেশের প্রিতিটি অঞ্চলে প্রশিক্ষণ দিতে গিয়েছি। বর্তমানে আবৃত্তি সমন্বয় পরিষদের সাংগঠনিক সম্পাদক পদে আছি, আমি ঢাকা অঞ্চলের দায়িত্ব পালন করছি। আমার স্বপ্ন বাংলাদেশে আবৃত্তি একদিন পেশা হিসেবে দাঁড়াবে। আমি আবৃত্তির পরম্পরা ধরে রেখেছি। আমার স্ত্রী ফারিয়া আহাদ অন্তরা শব্দবৃত্তিকে ভালোবেসে আবৃত্তি করে। তবে, সে গানের মানুষ, আমার ছেলেমেয়েরাও আবৃত্তি করছে। 

সাক্ষাৎকার : নিথর মাহবুব