ঘরের পাখি চড়ই

14 Jul 2021, 12:22 PM প্রকৃতি শেয়ার:
ঘরের পাখি চড়ই

মস্ত বড়ো দালান-বাড়ির উই-লাগা ওই কড়ির ফাঁকে
ছোট্ট একটি চড়ই-ছানা কেঁদে কেঁদে ডাকছে মাকে।
‘চুঁ চা’ রবে আকুল কাঁদন যাচ্ছিল নে বসন-বায়ে,
মায়ের পরান ভাবলে বুঝি দুষ্টু ছেলে নিচ্ছে ছা-য়ে।
অমনি কাছের মাঠটি হতে ছুটল মাতা ফড়িং মুখে,
স্নেহের আকুল আশিস-জোয়ার উথলে ওঠে মা’র সে বুকে।

কাজী নজরুল ইসলাম

আমাদের দেশে চড়ই সবচেয়ে পরিচিত পাখি। ইংরেজিতে চড়ইকে ‘স্প্যারো’ বলে। চড়ই পাসেরিডে পরিবারের সদস্য। কী শহর, কী গ্রাম সবখানেই চড়ই পাখির দেখা মেলে। এরা সদাসর্বদা আমাদের চারপাশে ঘোরাফেরা করে। ঘরের কোণে, কড়িকাঠে, দালানকোঠার কার্নিশে ও বারান্দায়, ভেন্টিলেটর, মিটার, সিলিং, পাইপের ফাঁকফোকরে খড়কুটো, শুকনো ঘাসপাতা দিয়ে বাসা বেঁধে বসবাস করে। পাতি চড়ইদের কবুতরের খোপে, বিচি কলার কাঁদির ভেতর ও খড়ের পালায় বাসা বাঁধতে দেখা যায়। মানুষের গৃহকোণে বাসা বানিয়ে বসবাস করে বলে ইংরেজরা এদের ‘হাউজ স্প্যারো’ বা ‘গৃহস্থালি চড়ই’ নামে ডাকে। অনেকে এদের ‘চড়াই পাখি’ নামেও ডাকে।
চড়ই পাখি সারাদিন লাফিয়ে বেড়ায় এবং মাটি থেকে পোকামকড় ও শস্যদানা খুঁটে খায়। ঘাসের মধ্যেও পোকামাকড় খুঁজে বেড়ায় জোড়া পায়ে লাফিয়ে লাফিয়ে। গ্রামের মাঠের কাছে, ঝোপ-জঙ্গলে, নদীর ধারে, শহরের চালের গুদামের কাছে দল বেঁধে থাকে।
পৃথিবীতে মোট ৪৮ প্রজাতির চড়ই দেখতে পাওয়া যায়। চড়ই পাখির পরিবার ১১টি গণে বিভক্ত। এদের মধ্যে ‘গৃহস্থালি চড়ই’ সব থেকে বেশি সুপরিচিত। এদের আদি নিবাস ছিল ইউরেশিয়া ও আফ্রিকা মহাদেশে। তবে বর্তমানে এরা ইউরোপ, উত্তর আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া ও নিউ জিল্যান্ডেও ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়েছে। বাংলাদেশ ছাড়াও ভারত, নেপাল, পাকিস্তান, জাপান, কোরিয়া, ইরান, ভুটান, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া, চীন, ইন্দোনেশিয়া ও মিয়ানমার চড়ইয়ের চড়ইদের বিচরণক্ষেত্র।
চড়ই পাখির দেহের দৈর্ঘ্য প্রায় ১৫ সেন্টিমিটার, ওজন প্রায় ২০ গ্রাম। পুরুষ ও স্ত্রী উভয়ের মাথা, ঘাড় ও পুরো মুকুটের পালকের রং মরচে বাদামি বা চকলেট বাদামি। পুরুষ-স্ত্রী চড়ই দেখতে আলাদা। পুরুষের মাথা ধূসর ও নীল মেশানো, ঘাড় পিঠ ও পাখনা খয়েরি লাল বা পিঙ্গল। চোখের পেছন থেকে ঘাড় অবধি মোটা গাঢ় লালচে বাদামি বর্ণের। লেজ ও লেজের গোড়া ধূসর। স্ত্রী পাখির রং ওপরের দিকে ধূসর বাদামি, তার ওপরে কালচে বা পিঙ্গল দাগ, পেট সাদাটে। পুরুষ পাখিটি দেখতে বেশি সুন্দর এবং সে বেশি গান গায়। মাঝে মধ্যে পুরুষ বা স্ত্রী পাতি চড়ইদের দুঃখভরা ভাব নিয়ে নিঃসঙ্গ বসে থাকতে দেখা যায়।
প্রজনন মৌসুমে চড়ই খড়কুটো, কাঠি, শুকনো ঘাস, পালক দিয়ে বাসা বানায়। বাসা তৈরি হলে পুরুষটি সুরেলা কণ্ঠে গান গায়। স্ত্রী চড়ই পাখি ৩ থেকে ৪টি ডিম পাড়ে। ছানা ফুটতে সময় লাগে প্রায় ১৩ দিন। ছানা ফুটলে দু’জনেই তাদের লালনপালন করে। উড়তে শিখলে ছানারা বড়োদের সঙ্গে মাঠে খাবার খেতে যায়। গ্রামে চড়ইয়েরা ঝাঁকে ঝাঁকে ধান ক্ষেতে, ধান শুকানোর উঠানে ধান খেতে নামে।

বিশ্বের কোথাও চড়ইদের অবস্থা আশঙ্কাজনক নয়। পরিবর্তিত পরিবেশের সঙ্গে সঙ্গে তারা সহজেই মানিয়ে নিতে পারে। তারপরও প্রকৃতিতে এদের টিকিয়ে রাখতে ২০১৪ খ্রিষ্টাব্দ থেকে প্রতিবছর ২০ মার্চ পৃথিবীব্যাপী পালিত হয় বিশ্ব চড়ই পাখি দিবস।লেখা : শ্যামল কায়া