পিকাসো ‘কিউবিজম’-এর প্রবর্তক : আশরাফ হোসেন

02 Sep 2025, 02:33 PM অন্যান্য শেয়ার:
পিকাসো ‘কিউবিজম’-এর প্রবর্তক : আশরাফ হোসেন

মায়ের নাম ছিল মারিয়া পিকাসো। মায়ের নামের শেষে ‘রুইজ ই পিকাসো’ থাকাতে পিকাসোর নামের শেষেও ‘রুইজ ই পিকাসো’ যুক্ত হয়েছে। তবে, তিনি পিকাসো নামেই খ্যাত। বাবা হোসে রুইজ ই ব্লাস কো প্রাদেশিক চারু ও কারুকলা বিদ্যালয়ের শিক্ষক ছিলেন। আন্দালুশিয়ার ওই এলাকায় সেটাই ছিল চারুকলা শিক্ষার কেন্দ্রস্থল।

পিকাসো ১৮৮১ খ্রিষ্টাব্দের ২৫ অক্টোবর জন্ম নেন স্পেনের মালাগা শহরে। তার শৈশব কেটেছে দক্ষিণ স্পেনের মালাগাতে। পিকাসোর বয়স যখন ১০ তখনই তার বাবা হোসে রুইজ গালিশিয়ার লা করুণাতে দা গুয়ার্দা চারুকলায় শিক্ষক হিসেবে নিযুক্ত হন এবং পরিবারের সকলকে নিয়ে দক্ষিণ স্পেন ছেড়ে লা করুণার আটলান্টিক বন্দরে এসে অস্থায়ী ঘর বাঁধেন- এ পরিবেশে কিশোর পিকাসো সদা উৎসুক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতেন প্রকৃতির লিলাভূমির দিকে। আটলান্টিকের এই পার্বত্য অঞ্চল দক্ষিণ মালাগা থেকে একেবারেই ভিন্ন। পাবলো এসময়ে অনেক ড্রইং করেন, বাবা হোসে রুইজের দৃষ্টিভঙ্গির সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও তিনি বুঝতে পারেন, কিশোর পাবলো’র প্রতিভা অসামান্য তখন তিনি নিজে ছবি আঁকা বন্ধ করে মনোনিবেশ করেন সম্পূর্ণ শিক্ষকতার দিকে আর সকল রং-তুলি ছেলের হাতে তুলে দেন আনন্দে।

বাবা হোসে পেশাগত কারণে বিভিন্ন স্কুলে শিক্ষক নিযুক্ত হওয়ায় পাবলোর নানা জায়গায় যাওয়ার সুযোগ ঘটে। বাবা প্রাদেশিক চারুকলা থেকে আটলান্টিক গুয়ার্দা চারুকলা তারপর ১৮৯৫ খ্রিষ্টাব্দে বার্সিলোনার লা লোঞ্জা আর্ট স্কুলে শিক্ষক নিযুক্ত হলে পিকাসোকে এখানেই ভর্তি করান ছবি আঁকার জন্য। পিকাসো ভর্তি পরীক্ষায় ছবি এঁকে সকলকে তাক লাগিয়ে দেন, তবে এখানেও বেশিদিন থাকলেন না পিকাসো। ১৮৯৭ খ্রিষ্টাব্দে মাদ্রিদের সান ফার্নান্দো রয়্যাল একাডেমিতে ভর্তি হন। সেখানেও কৃতিত্বের সাথে নৈপুণ্যের তর্কাতীত পরিচয় দেন। একই বছর মাদ্রিদের এক প্রদর্শনীতে তার একটি চিত্রকর্ম প্রদর্শন হয় ‘সায়েন্স অ্যান্ড চ্যারেটি’, ঠিক তার পরের বছরই আরো একটি কাজ মাদ্রিদ ও মালাগার এক প্রদর্শনীতে পদক জয় করেন। এভাবেই তিনি তার কাজের মধ্য দিয়ে একের পর এক আনন্দের দুয়ার খুলতে থাকেন।


পিকাসোর বুদ্ধিদীপ্তি ও মানসিকতার পরিবর্তন

মাদ্রিদ থেকে বার্সিলোনায় ফিরে গেলে সেখানে একদল বোহেমিয়ান শিল্পী ও বুদ্ধিজীবীর সাথে ধীরে ধীরে সখ্য গড়ে ওঠে। পিকাসো তাদের ছবি আঁকেন বেশ, এ সময়ে সকলের সাথে নানা আলাপ আলোচনায় নিজেকে সমৃদ্ধ করেন। যাদের প্রতিকৃতি করেছিলেন তাদের সেইসব ছবি দিয়ে প্রথম একক চিত্র প্রদর্শনী করেন। এ প্রদর্শনীটি হয় একটি ক্যাফেতে। ক্যাফটি হলো ‘এল কোয়ার্টার গ্যাটস’। বন্ধুদের সাথে এখানেই চলত নানা ধরনের আলোচনা। ‘লাভ্যান গার্দিয়া’ পত্রিকায় প্রদর্শনীটি নিয়ে একটি আলোচনা প্রকাশিত হয়। যেসব শিল্পী, বুদ্ধিজীবী, সাহিত্যিকেরা তরুণ পিকাসোর দৃষ্টি মন ও মনন এবং বুদ্ধিবৃত্তিকে উজ্জ্বল নক্ষত্রের মতো দীপ্ত করেছেন। তাদের মধ্যে সমালোচক, প্রাবন্ধিক ইউজেনিও, ডি’ওরস, শিল্পকলার ঐতিহাসিক মিগুয়েল উত্রিলো, কবি জেইমি, সার্বাতেস, চিত্রশিল্পী কার্লোস কাসাগেমাস এবং গোনজালেজ। ক্যাটালোন স্কুলের শিল্প ও জীবন দর্শন সম্বন্ধে এরাই পিকাসোকে পরিচয় করিয়ে দেন।

ক্যাটালোন স্কুলের শিল্পীরা বিলেতের ‘ডেকাডেন্ট’ স্টাইল দ্বারা প্রভাবিত, সে সময়ের প্রগতিশীল সামাজিক আদর্শও তাদের প্রেরণা যোগাতো, এইসব শিল্পীদের ছবি বেশ কতক পত্রপত্রিকায় ছাপা হতো এবং শিল্পের এ আলোচনা সমালোচনায় অনেক জ্ঞানগর্ভ বিশ্লেষণাত্মক বিষয় পিকাসোকে সমৃদ্ধ করে। এই সকল শিল্পীরাই পিকাসোকে স্টাইনলেন ও বিখ্যাত তুলুয লত্রেক-এর সাথে পরিচয় করিয়ে দেন।

১৯০০ খ্রিষ্টাব্দে প্যারিসে চলে আসেন। পিকাসোর সঙ্গী হলেন কাসামেগাস। তিনি বাসা বাঁধলেন স্প্যানিশ চিত্রশিল্পী ইসিদ্রে নলেনের সঙ্গে। এসময়ে তার কাজের তেমন কোনো হদিস পাওয়া যায়নি। তবে এর মধ্যে তার তিনটি স্কেচ বিক্রি করতে সমর্থ হয় আর্ট ডিলার বার্থা ভিলার কাছে। প্যারিসে বসে আঁকা তুলুয লত্রেক-এর ভঙ্গিতে একটি ছবির কথা জানা যায়, যার নাম ‘Le Moulin de la Galette’।

১৯০৬-’৭-এর দিকেই বোঝা যাচ্ছিল তিনি চলেছেন নতুন কোনো পথে। খুব অবাক বিষয় ছিল সে সময়ে তিনি দু’টি আত্মপ্রতিকৃতি করেন, যা খুব উল্লেখযোগ্য যে, প্রথম ছবিটিতে তিনি প্রায় রং দেননি বললেই চলে, শুধু ধূসর, সাদা, ফিকে হলুদ আর খুব হালকা লাল ব্যবহার করেছেন। আলো-ছায়ার প্রশ্নই ওঠে না, সেখানে শিল্পীর বাঁহাতে ধরা রঙের প্লেটে শুধু চড়া রঙের আদর রয়েছে, আশেপাশে প্রয়োজন ছাড়াই স্পেস করেছে, এখানে মনস্তত্ত্বকে একপাশে রেখে ফর্মের নানা বিষয় তুলে ধরার ইচ্ছাই ছিল প্রবল। এ শুধু আত্মপ্রতিকৃতি নয়, এতে তার জীবনের সকল অর্জন যেন ঢেলে দিয়েছেন। মাতিস, আঁদ্রে দেরা, জর্জ ব্রাকের নাম না বললেই নয়। পিকাসো’র সাথে মাতিসের পরিচয় ১৯০৬ খ্রিষ্টাব্দে, মাতিসের মাধ্যমেই বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে দেরা ও ব্রাকের সঙ্গে। চিত্রকলার জগতে আভাঁগার্দ শিল্পগোষ্ঠী ফভ্-এর অবিসংবাদিত নেতা ছিলেন মাতিস। পিকাসো এদের সাথে যুক্ত হয়ে তার নতুন শৈলী’র দিকে এগিয়ে যান।

মানুষ ইন্দ্রিয় দ্বারা যা অনুভব করে তার বাইরেও আরেকটা অনুভব থাকে, মূলত সেটা নৈর্ব্যক্তিক। ধ্রুপদিয় ঐতিহ্যের যে সৌন্দর্য সেই মৌলিকত্ব বা আদর্শগত বিষয়কে বর্জন করে মানুষ ও প্রাণী বা কোনো বস্তুর কাঠামোকে ভেঙেচুরে উদ্ভট আকৃতি যা নতুন এবং হার্মনি আছে তবে ঐতিহ্যকে বর্জন করেও এক নান্দনিক রূপ রেখে যে শিল্প নিয়ে এলো কিউবিস্টরা তা এ জগতে এক নতুন ধারণার প্রবর্তন করেন। যা সমালোচক ও দর্শকদের কাছে সমাদৃত হতে লাগল। এরকম ধারায় প্রথম বৈপ্লবিক কাজ করলেন পিকাসো ১৯০৭ খ্রিষ্টাব্দে। তৈলচিত্রটির আখ্যা ছিল ‘দাভিন-র তরুণীরা’। এটা শুধু তার শিল্পীজীবনের বিস্ময়কর নতুন বাঁকই নয়, গোটা ইউরোপীয় চিত্রকলার ক্ষেত্রে এই ছবিটি বিপ্লবের সূচনা করে। দাভিন-এর ছবিতে পাঁচটি নারীমূর্তি রয়েছে দাঁড়ানো এবং বসা অবস্থায়। আর সামনে স্টিল লাইফ রয়েছে, এখানে তার কাঠামো বিন্যাস দেখলে সেজানের কিছু নুড-এর কথা মনে পড়ে। সেজান সেখানে স্থাপত্যর ভঙ্গিতে এঁকেছিল তার নিরাভরণ নারীদেহ বিন্যস্ত করেছিলেন ক্যানভাসের জমিতে। পিকাসো সেজান থেকে একটু দূরে এগিয়ে গিয়ে এক ভিন্নরকম নতুন পথে হাঁটলেন। ডানদিকে দুই নরীর অবয়ব সচেতনভাবেই বিকৃত করলেন বাঁদিকের মুখগুলোতেও তার রেশ বয়ে চলল। মাপের দিক থেকে সুসামঞ্জস্য এবং স্বাভাবিক তবে মুখোশের একটা আবহ রয়েছে বলে মনে হয়। গোটা ছবি ঘিরে একটা ভাষ্কর্যের অনুভূতি রয়েছে কাঠামোগত বিন্যাসের কারণে। এ ছবির মাধ্যমে পিকাসো শুরু করলেন নতুন পথ ধরে হেঁটে চলা। প্রচ- সাহস, একাগ্রতা নিয়ে গেছে তাকে শিল্পের এক উৎকর্ষে। পিকাসো এ ছবিগুলোতে স্পেস, বায়বীয় কিছু নেই, একটা ঘনবস্তু, ফিগার, পোশাকে ভারি একটা বিষয় পরিলক্ষিত হয়।

১৯১৩ খ্রিষ্টাব্দে কিউবিস্ট রীতিকে আরো এগিয়ে নিলেন শিল্পী পিকাসো। তিনি দেহজ বাহ্যিক বিষয়গুলো নয়, বরং সে বিষয়টি সম্পর্কে মনের যে ইমেজ, আইডিয়া তার উপর বেশি গুরুত্ব দিতে লাগলেন। মানে বিষয়টা এমন হলো দর্শকদের আবেগনির্ভর দৃষ্টি এবং মানসিক প্রতিক্রিয়াকে সম্পূর্ণ মুছে দিলেন। তিনি এটাকে বাস্তবতাই মনে করেন আর তাই আঁকতে গিয়ে বিষয়বস্তুর বাহ্যিক রূপকে আড়াল করলেন। ভেতর থেকে দেখতে থাকেন। দৃষ্ট বস্তুর ভাব, ইমেজকে তুলে আনেন, শিল্পী নানা কোন্ থেকে একই সাথে উপরে, সামনে, পাশে দেখলেন, দেখেন আরো, আরো ভেতরে, গভীরে, গহীনে, যা শুধু রূপদক্ষরাই দেখেন, অনুভব করেন আর তা তার মতো করে দর্শকের সামনে, নিজের সামনে উপস্থাপন করেন মহানন্দে। শিল্পসমালোচকেরা পিকাসোর এই নতুন ধারার শিল্পকর্মকে ‘এনালেটিক কিউবিজম’-এর চাইতে আলাদা করে ‘সিনথেটিক কিউবিজম’ বলে আখ্যা দেন। কিউবিজমের অগ্রজ শিল্পী পিকাসো বিষয়বস্তু, স্পেস, সারফেস ও মাধ্যমের এ সকল ঐক্যকে বিলুপ্ত করে নতুন এক বৈপ্লবিক ধারণার জন্ম দেন। এ যেন এক নতুন বস্তুনিষ্ঠ স্বাক্ষর। এবং একেই চিত্রকলার একটি নতুন ভাষা রূপে গড়ে তোলেন পিকাসো, যে কারণে তিনি বিশ্বের দরবারে নতুন ধারার ‘কিউবিজম’-এর প্রবর্তক হয়ে রইলেন।

লেখক : ভাস্কর ও চিত্রশিল্পী