নারীশিক্ষার অগ্রদূত নবাব ফয়জুন্নেসা চৌধুরানীর বাড়ি : মোশাররফ হোসেন

02 Sep 2025, 02:29 PM অন্যান্য শেয়ার:
নারীশিক্ষার অগ্রদূত নবাব ফয়জুন্নেসা চৌধুরানীর বাড়ি : মোশাররফ হোসেন


কুমিল্লা জেলার লাকসাম উপজেলার পশ্চিমগাঁও গ্রামে ডাকাতিয়া নদীর উত্তর তীরে নবাব ফয়জুন্নেসা চৌধুরানীর বাড়িটি অবস্থিত। নবাব ফয়জুন্নেসা চৌধুরানী ১৮৩৪ খ্রিষ্টাব্দে তৎকালীন ত্রিপুরা জেলার হোমনাবাদ পরগনার [বর্তমান কুমিল্লা জেলা] লাকসামের পশ্চিমগাঁও গ্রামে জমিদার পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা জমিদার আহম্মদ আলী চৌধুরী এবং মাতা আফরান্নেছা চৌধুরানী। জমিদার আহম্মদ আলী চৌধুরীর প্রথম কন্যাসন্তান ফয়জুন্নেসা চৌধুরানী তৎকালীন রক্ষণশীল সমাজে জমিদারবাড়ির কড়া পর্দাপ্রথার মধ্যে বেড়ে ওঠেন। ফয়জুন্নেসা চৌধুরানীর কোনো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ছিল না। তিনি নিজ বাড়িতে গৃহশিক্ষক ওস্তাদ তাজউদ্দিনের নিকট শিক্ষা গ্রহণ করেন। তিনি বাংলা, আরবি, ফারসি ও সংস্কৃত ভাষায় দক্ষতা অর্জন করেছিলেন। ১৮৬০ খ্রিষ্টাব্দে কুমিল্লার বর-া উপজেলার ভাউকসারের জমিদার মোহাম্মদ হাসান গাজী চৌধুরীর সাথে ফয়জুন্নেসা চৌধুরানীর বিয়ে হয়। দুই কন্যাসন্তান জন্মগ্রহণের পর ১৮৭৭ খ্রিষ্টাব্দে স্বামীর সাথে তার বিচ্ছেদ ঘটে। এরপর তিনি দুই কন্যাসন্তানসহ পিত্রালয়ে ফিরে এসে সমাজসেবা ও সাহিত্যচর্চায় আত্মনিয়োগ করেন। এসময়ে তিনি নারীশিক্ষা প্রসারেও বিশেষ ভূমিকা রাখেন।

জনশ্রুতি রয়েছে, বিয়ের ১৭ বছর পর তিনি জানতে পারেন যে, তার স্বামী পূর্বে আরো একটি বিয়ে করেছিলেন এবং সেই স্ত্রীও বর্তমান। তখন ফয়জুন্নেসা চৌধুরানী স্বামী থেকে পৃথক থাকার সিদ্ধান্ত নেন। বিয়ের সময় স্বামী থেকে প্রাপ্ত দেনমোহরানার এক লক্ষ এক টাকা দিয়ে লাকসামের পশ্চিমগাঁও গ্রামে ডাকাতিয়া নদীর উত্তর পাড়ে পৈত্রিক ভিটায় সাড়ে তিন একর জমির ওপর দক্ষিণমুখী একটি দ্বিতল ভবন নির্মাণ করেন। দ্বিতল ভবনটির নিচ তলায় ৯টি এবং দোতলায় ৯টি করে মোট ১৮টি কক্ষ রয়েছে। ফয়জুন্নেসা চৌধুরানীর পিতা জমিদার আহম্মদ আলী চৌধুরী ১৮৭৩ খ্রিষ্টাব্দে মৃত্যুবরণ করেন। পিতার মৃত্যুর বার বছর পর উত্তরাধিকার সূত্রে ১৮৮৫ খ্রিষ্টাব্দে ফয়জুন্নেসা চৌধুরানী জমিদারী লাভ করেন। জমিদারী লাভের পর পাইক-পেয়াদা, দাস-দাসীদের থাকার জন্য দোতলা ভবনের পেছনের দিকে [উত্তর পাশে] একটি একতলা ভবন নির্মাণ করেন। পরবর্তীসময়ে ভবনটি দোতলায় রূপান্তরিত করা হয়। এছাড়া মূল প্রাসাদভবনের পূর্ব পাশে খাজনা আদায়ের জন্য একতলা কাছারি ভবন নির্মাণ করেন। এখন ভবনটি অযতেœ অবহেলায় জরাজীর্ণ হয়ে পরিত্যক্ত অবস্থায় রয়েছে। প্রাসাদ ভবনের দক্ষিণ পশ্চিম দিকে অতিথিশালা নির্মাণ করেন। একতলাবিশিষ্ট অতিথিশালার দুই পাশে তিনটি করে ছয়টি কক্ষ এবং মাঝখানে বড়ো একটি ডাইনিং হল রয়েছে। দক্ষিণমুখী বাড়িটির সামনে ডাকাতিয়া নদী এবং বাড়িটির পশ্চিমে ঘাট বাঁধানো দিঘি রয়েছে। বাড়িটির চারদিকে দেয়াল দিয়ে ঘেরা এবং দক্ষিণ দেয়ালে রয়েছে একমাত্র প্রবেশদ্বার।

নবাব ফয়জুন্নেসা চৌধুরানী ১৯০৩ খ্রিষ্টাব্দে তার বাড়িটির সীমানা দেয়ালের পশ্চিম পাশে পাঁচ গম্বুজ বিশিষ্ট একটি মসজিদ নির্মাণ করেন। পরবর্তীসময়ে মসজিদটির বারান্দা নির্মাণ করে আরো পাঁচটি গম্বুজ স্থাপন করা হয়। গম্বুজগুলোর চার পাশে ছোটো ছোটো মিনার আকৃতির স্থাপনা লক্ষ্য করা যায়। মসজিদটির ভেতরে পশ্চিম পাশের দেয়ালে ৩টি মেহরাব, পূর্ব পাশের দেয়ালে ৩টি প্রবেশ পথ এবং উত্তর দক্ষিণে একটি করে দরজা বা প্রবেশপথ রয়েছে। মসজিদটিতে পুরুষের পাশাপাশি নারীদের নামাজের ব্যবস্থা রয়েছে। মসজিদটির পূর্বদিকে মূল প্রবেশদ্বার রয়েছে। মসজিদটির চারদিকে অনুচ্চ সীমানা দেয়াল এখনো অক্ষত রয়েছে। মোঘল স্থাপত্যরীতিতে নির্মিত মসজিদটির নকশা খুবই নান্দনিক।

মসজিদটির দক্ষিণ পাশে সারিবদ্ধভাবে ১১টি প্রাচীন কবর রয়েছে। সর্ব পশ্চিমের কবরটি নবাব ফয়জুন্নেসা চৌধুরানীর।

বাংলাদেশের কুমিল্লা ও নোয়াখালি জেলার বিভিন্ন এলাকায় নবাব ফয়জুন্নেসা চৌধুরানীর জমিদারী প্রতিষ্ঠিত ছিল। এর মধ্যে লাকসামের সদরের পশ্চিমগাঁও, কৃষ্ণপুর, ভাটার, মোহাম্মদগঞ্জ। নাঙ্গলকোট উপজেলার ষাড়ঘর, বক্সগঞ্জ, সিজিরিয়া বাঙ্গড্ডা। মনোহরগঞ্জ উপজেলার ফোমগাও। বর-া উপজেলার ভাউকসার, কুমিল্লা শহরের উনিয়া, মানিকমুড়া এবং নোয়াখালি জেলায় বেগমগঞ্জ উপজেলার ছাতার পাইয়া অঞ্চলে তার জমিদারী বিস্তৃত ছিল।

নারীশিক্ষা ও জাগরণের অন্যতম অগ্রদূত নবাব ফয়জুন্নেসা চৌধুরানী নিজের জীবন উৎসর্গ করেছেন মানুষের সেবায়। তার জমিদারির প্রভাব প্রতিপত্তি কাজে লাগিয়েছেন জনহিতকর কাজে। তিনি জনস্বার্থে আঠারো শতকে গড়ে তুলেছিলেন মসজিদ, মক্তব, মুসাফিরখানা, হাসপাতাল, দাতব্য চিকিৎসাকেন্দ্র। এছাড়াও তিনি কয়েকটি পুল বা সেতু নির্মাণ করেছিলেন। প্রজাদের পানীয় জলের অভাব দূর করতে খনন করেছিলেন দিঘি। তিনি ১৮৭৪ খ্রিষ্টাব্দে কুমিল্লায় ফয়জুন্নেসা ইংরেজি উচ্চবিদ্যালয় ও ছাত্রীনিবাস নির্মাণ করেন। বর্তমানে এর নামকরণ করা হয়েছে নবাব ফয়জুন্নেসা সরকারি বালিকা উচ্চবিদ্যালয়। নবাব ফয়জুন্নেসা চৌধুরানী নিজ গ্রামে একটি প্রাথমিক বিদ্যালয় স্থাপন করেন। এছাড়াও তিনি ১৮৮৯ খ্রিষ্টাব্দে কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজ প্রতিষ্ঠাকালে ১০ হাজার টাকা অনুদান প্রদান করেন। ১৯০১ খ্রিষ্টাব্দে লাকসামের পশ্চিমগাঁয়ে নবাব ফয়জুন্নেসা ও বদরুন্নেসা যুক্ত উচ্চবিদ্যালয় স্থাপন করেন। ধর্মীয় শিক্ষা প্রদানের জন্য তিনি ফয়েজিয়া মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯৪০ খ্রিষ্টাব্দে নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় নওয়াব ফয়জুন্নেসা সরকারি কলেজ। কুমিল্লা শহরের শৈলরানী দেবী উচ্চবালিকা বিদ্যালয় স্থাপনসহ তিনি তার জমিদারী অঞ্চলে ১৪টি মৌজায় ১১টি বিদ্যালয় স্থাপন করেন। ভারতের নদীয়া জেলার কৃষ্ণনগরে বিদ্যালয় নির্মাণের যাবতীয় ব্যয় বহন করেন। এছাড়াও সৌদি আরবের মক্কায় একটি মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠায় তিনি আর্থিক অনুদান প্রদান করেন। 

লেখক : গবেষক, লেখক ও টেলিভিশন অনুষ্ঠান নির্মাতা