মুন্সীগঞ্জ জেলার মিরকাদিম পৌরসভার একটি প্রাচীন জনপদ ‘নগর কসবা’। মুঘল শাসনামলে বিক্রমপুর পরগনার মিরকাদিম অঞ্চলে কাজি কসবা এবং নগর কসবা নামে দুটি প্রাচীন জনপদ গড়ে উঠেছিল। মুঘল শাসনামলে প্রশাসনিক কার্যক্রম পরিচালনার জন্য অবিভক্ত বাংলায় ৩৭টি নগর কসবা ছিল। এর একটি ছিল মুন্সীগঞ্জ জেলার মিরকাদিম পৌর এলাকায়। ইছামতী নদীর তীরে কমলাঘাট নৌবন্দরের অদূরে ৮৫০ মিটার দীর্ঘ উত্তর-দক্ষিণমুখী একটি সরু রাস্তার দুই পাশে সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে আছে প্রাচীন ইমারতগুলো।
মীর কাদিমের নগর কসবার প্রাচীন ইমারতগুলো কালের আবর্তে ধ্বংস হয়ে গেছে। তবে, পরবর্তীকালে উনিশ শতকের শেষের দিকে এবং বিশ শতকেরর প্রথম দিকে ইংরেজ শাসনামলে নির্মিত ইমারতগুলোর মধ্যে বেশ কিছু ইমারত এখনো টিকে আছে। বর্তমানে দৃশ্যমান প্রাচীন বাড়িগুলো প্রায় দেড়শ’ বছরের পুরনো।
মুন্সীগঞ্জে জেলার মিরকাদিম নগর কসবার উত্তর দিক থেকে প্রবেশ করলে প্রথমই চোখে পড়বে লক্ষ্মীবাড়ি। সম্ভুনাথ পোদ্দার নামক একজন ধনাঢ্য ব্যবসায়ী ইংরেজ শাসনামলে ক্রয়সূত্রে জমিদার হন। জমিদারি লাভের পর তিনি মিরকাদিম নগর কসবায় বিশাল একটি বাড়ি নির্মাণ করেন। বাড়িটির সম্মুখভাগে পূর্ব-পশ্চিম ও দক্ষিণ দিকে তিনটি ভবন এবং উত্তর দিকে দুর্গামন্দির রয়েছে। ভবন তিনটি প্রজাদের কাছ থেকে খাজনা আদায় ও প্রশাসনিক কাজে ব্যবহৃত হতো। পাইক, পেয়াদাসহ কর্মচারীদের থাকার ব্যবস্থাও ছিল এই ভবনগুলোতেই।
কাচারি ভবন ও উত্তর দিকে দুর্গামন্দিরের মাঝখানে আটচালা একটি টিনের ছাউনি ছিল। ভবন তিনটির বারান্দা ও আটচালা ছাউনির নিচে বসে সবাই পূজা, যাত্রাপালা এবং অনুষ্ঠান উপভোগ করতেন। কাচারি ভবনের পূর্ব পাশেই জমিদার বাড়ির মূল প্রাসাদ ভবন। পশ্চিমমুখী প্রাসাদ ভবনটি উত্তর ও দক্ষিণ দুই ভাগে বিভক্ত। ভবনটির উত্তর পাশের দোতলায় একাধিক শয়নকক্ষ, অতিথিকক্ষ, খাবারকক্ষসহ ৯টি কক্ষ এবং নীচ তলায় বৈঠকখানা, অতিথিদের জন্য শয়নকক্ষ, কর্মচারীদের থাকার কক্ষসহ ৯টি কক্ষ রয়েছে। দক্ষিণ পাশের নিচ তলার সামনের দিকে অতিথিদের জন্য একাধিক শয়নকক্ষ, বিশ্রামকক্ষ, খাবারের কক্ষ, বৈঠকখানা এবং পেছনের দিকে গৃহকর্মীদের থাকার জন্য কক্ষসহ ১৩টি কক্ষ রয়েছে। দক্ষিণ পাশের দোতলায়ও একাধিক শয়নকক্ষ, অতিথিকক্ষ, খাবারের কক্ষসহ ৯টি কক্ষ রয়েছে। দোতলায় পশ্চিমমুখী লম্বা বারান্দাটি দু’টি ভবনকে যুক্ত করেছে। নিচ তলায় পূর্ব-পশ্চিম মুখী একটি সরু পথ ভবন দু’টিকে বিভক্ত করেছে। এই সরু পথদিয়ে বাড়িটির পেছনে শৌচাগার ও দীঘিতে যাওয়ার ব্যবস্থা রয়েছে ।
বাড়িটির পেছনে রয়েছে পাঁচটি ঘাট বাঁধানো বিশাল দীঘি। দীঘির পশ্চিম দিকে রয়েছে প্রাসাদভবনসংলগ্ন পুরুষ ও নারীদের জন্য আলাদা আলাদা দশটি শৌচাগার। জমিদার সম্ভুনাথ পোদ্দারের মৃত্যুর পর তার ছেলে চরণ পোদ্দার জমিদার হন। ১৯৪৭ সালে ভারতবর্ষ বিভক্ত হলে চরণ পোদ্দার বাড়িটি সেরালি ব্যাপারি ও লেবু ব্যাপারির নিকট বিক্রি করে দিয়ে সপরিবারে ভারতের পশ্চিমবঙ্গে চলে যান।
জমিদার সম্ভুনাথ পোদ্দারের এই বিশাল বাড়িটি এলাকার সবার কাছে লক্ষ্মীবাড়ি নামে পরিচিত। দেড়শ’ বছর পূর্বে নির্মিত বাড়িটি ইন্দো-ইউরোপীয় রীতিতে ইট, চুন ও সুরকি দিয়ে বানানো। বাড়িটির নকশা করা লোহার খাম ও বারান্দার রেলিং অত্যন্ত দৃষ্টিনন্দন। বর্তমানে বাড়িটিতে সম্ভুনাথ পোদ্দারের এক আত্মীয়-সহ তিনটি পরিবার ভাড়ায় বসবাস করছে।
লক্ষ্মীবাড়ির দক্ষিণ পাশে রাম পোদ্দারের বাড়ি। রাম পোদ্দার ছিল সম্ভুনাথ পোদ্দারের পরবর্তী বংশধর। ইংরেজি এল আকৃতির এই শতবর্ষী দোতলা বাড়িটিকে এলাকার সবাই কালিবাড়ি হিসেবে চেনেন। বাডিটির সম্মুখভাগ নান্দনিক নকশাখচিত। বাড়িটির পেছনে অনেক বড়ো বাগান ছিল। বাগানের জায়গাটি বিক্রি করে দেওয়া হয়েছে। সেখানে যাতায়াতের জন্য পথ তৈরি করতে বাড়িটির ভবনের মাঝ বরাবর কিছু অংশ ভেঙে ফেলা হয়েছে। ফলে বাড়িটি দুইভাগে বিভক্ত হয়ে দুটি বাড়িতে রূপ নেয়।
এরপরই রয়েছে বাঘাবাড়ি নামে আরো একটি প্রাচীন বাড়ি। বাঘা বাড়িটির দুটি অংশ। বাড়িতে ঢুকলেই সামনের অংশের দক্ষিণ পাশে দ্বিতল ভবন এবং উত্তর পাশে একতলা ভবন। এই ভবনগুলোর পূর্ব পাশেই রয়েছে অন্দরমহল। অন্দরমহলের চারদিকে চারটি দ্বিতল ভবন বর্তমান। প্রতিটি ভবনে চারটি করে কক্ষ রয়েছে। মাটি থেকে তিন ফুট উঁচু প্ল্যাটফর্মের ওপর এই বাড়িটির ভবনগুলো প্রায় দেড়শ’ বছর আগে নির্মিত।
বাঘাবাড়ির পাশেই কুড়িবাড়ি। উনিশ শতকের শেষ দিকে জমিদার চরণ পোদ্দার বাড়িটি নির্মাণ করেন। এর প্রবেশমুখে শত বছর প্রাচীন কাঠের তৈরি বিশাল দরজাটি এখনো সেকালের আভিজাত্যের সাক্ষ্য বহন করে চলেছে। বাড়িটিতে ঢোকার পর পূর্ব পাশে দোতলা ভবনের উপর একটি প্রাচীন ঘড়ি স্থাপিত। বাড়িটির দক্ষিণ-পশ্চিম পাশে একতলা ভবন। এ বাড়িতে এক সময় বিশাল আয়োজনে দুর্গা পূজা অনুষ্ঠিত হতো। ১৯৪৭ সালের পর জমিদার চরণ পোদ্দার সপরিবারে ভারতের পশ্চিমবঙ্গে চলে যান। অনেকদিন পরিত্যাক্ত অবস্থায় থাকার পর পাকিস্তানের শাসনামলে ১৯৫৫ সাল থেকে হাজি মধু দেওয়ান নামে জনৈক ব্যক্তি বাড়িটির দখল নিয়ে বসবাস করছেন।
এরপরই রয়েছে হারান সাহা পোদ্দারের দ্বিতল বাড়ি। বর্তমানে এই বাড়িটিতে একটি মাত্র দ্বিতল ভবন বর্তমান। বাকি ভবনগুলো ধ্বংস হয়ে গেছে। এরপরই রয়েছে রাম পোদ্দারের দ্বিতল বাড়ি। রামদত্ত পোদ্দারের বাড়ির সামনের অংশ প্রায় ধ্বংসপ্রাপ্ত। পূর্ব দিকের দোতলা ভবন এবং উত্তর দিকের একতলা ভবন এখনো টিকে আছে। ১৯৬৪ সালে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার সময়ে রাম পোদ্দার কোলকাতা চলে যান। এই বাড়িটিতে এখন সপরিবারে হক সাহেব বসবাস করেন। এর পরেই রয়েছে রাধা মাধব পোদ্দারের বাড়ি। এই বাড়িটিরও দুটি অংশ। সামনের অংশ অনেকটাই ধ্বংসপ্রাপ্ত। পেছনের দ্বিতল ভবনটি তুলনামূলক ভালো অবস্থায় রয়েছে। বাড়ির পেছনের অংশে নীচ তলা ও দোতলায় কয়েকটি কক্ষ রয়েছে। রাধা মাধব পোদ্দারের বাড়ির পাশে আরো একটি প্রাচীন বাড়ি রয়েছে। ১৯৪৭ সালে ভারতবর্ষের বিভক্তির পর পাকিস্তান শাসনামলে মিরকাদিমের নগর কসবার বেশিরভাগ বাড়ি দীর্ঘদিন পরিত্যক্ত অবস্থায় ছিল। পরিত্যক্ত বেশকিছু বাড়ি দুর্বৃত্তরা দখল দখল করে নেয়। দখলে নিয়ে অনেকেই বাড়ির নাম ও সম্মুখভাগের নকশা পরিবর্তন করে ফেলেছে। কেউ আবার জরাজীর্ণ ভবন ভেঙে ফেলে সেখানে নতুন ভবন নির্মাণ করেছে। এই ধারা এখনো অব্যাহত আছে।
১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময়ে পাকিস্তান হানাদার বাহিনী নগর কসবা ও পার্শ্ববর্তী আবদুল্লাহপুরে হত্যাযজ্ঞ চালায়। ভীতসন্ত্রস্ত নগর কসবার হিন্দু পরিবারগুলো তখন বাড়ির বাইরের ফটকে আল্লাহ ও কলেমা লিখে রাখে। কয়েকটি বাড়ির ফটকে এখনো সেই লেখাগুলো আছে। উল্লিখিত বাড়িগুলো ছাড়াও মিরকাদিম নগর কসবার ৮৫০ মিটার দীর্ঘ পথের দু’পাশ জুড়েই ছিল শতবর্ষী অর্ধশতাধিক বাড়ি। কালের আবর্তে বেশিরভাগ বাড়িই ধ্বংস হয়ে গেছে ।
মুন্সীগঞ্জ জেলার মিরকাদিম অঞ্চলের নগর কসবার প্রাচীন বাড়িগুলো ইন্দো-ইউরোপীয় রীতিতে নির্মাণ করা হয়েছে। নির্মাণ উপকরণ হিসেবে ইট, চুন, সুরকি, গাব ও সুপারির কষ ব্যবহার করা হয়েছে। মিরকাদিম নগর কসবায় প্রাচীন বাড়িগুলো দেশের গুরুত্বপূর্ণ প্রত্মতাত্ত্বিক নিদর্শন।
লেখক : গবেষক, লেখক ও টেলিভিশন অনুষ্ঠান নির্মাতা