যেমন মিডিয়া প্রীতি তেমনি মিডিয়া ভীতিও ছিল প্রবল -ফারজানা রফিক বাবলী

20 Oct 2024, 02:36 PM অন্যান্য শেয়ার:
যেমন মিডিয়া প্রীতি তেমনি মিডিয়া ভীতিও ছিল প্রবল -ফারজানা রফিক বাবলী


টিভি-সংবাদ উপস্থাপনার ক্ষেত্রে সুন্দর কণ্ঠ, স্পষ্ট উচ্চারণ, সুন্দর বাচনভঙ্গি এবং দর্শকপ্রিয়তা বা জনপ্রিয়তার মাপকাঠিতে হাতে গোনা যে-ক’জন সংবাদ উপস্থাপক এগিয়ে আছেন বাংলাদেশ টেলিভিশনের জ্যেষ্ঠ সংবাদ উপস্থাপক ফারজানা রফিক বাবলী তাদের মধ্যে অন্যতম। বাংলাদেশ বেতারেও তিনি তালিকাভুক্ত সংবাদ উপস্থাপক এবং নাট্যশিল্পী। দর্শকনন্দিত এই সংবাদ উপস্থাপককে নিয়ে বিস্তারিত লিখেছেন শহিদুল ইসলাম এমেল...



বাংলাদেশ টেলিভিশনের সংবাদ উপস্থাপক ফারজানা রফিক বাবলীর জন্ম ও বেড়ে ওঠা নোয়াখালিতে। স্কুল-কলেজের পড়াশোনা শেষ করেছেন নোয়াখালির মাইজদী শহরে। পরবর্তীসময়ে ঢাকার বেসরকারি একটি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমবিএ পাশ করেই যোগ দেন গ্রামীণ টেলিকমে। প্রতিষ্ঠানটিতে তিনি দীর্ঘ ১৮ বছর চাকরি করেছিলেন এবং সর্বশেষ সিনিয়র ম্যানেজার [এডমিন অ্যান্ড এইচআর] পদে কাজ করেন।

ছেলেবেলায় খেলাধুলার পাশাপাশি তার ভীষণ টিভি দেখার নেশা ছিল। সে-সময়ে একমাত্র চ্যানেল হিসেবে বিটিভির নাটক, বিজ্ঞাপন আর সংবাদ ছিল খুব জনপ্রিয়। বিপাশা হায়াত, শমী কায়সার, আফসানা মিমিদের নাটক আর আফজাল হোসেনের তৈরি মৌ-তানিয়াদের বিজ্ঞাপন দেখে মনে হতো মিডিয়ায় গেলে তিনিও ভালো কাজ করতে পারবেন। নোয়াখালির মতো একটি রক্ষণশীল এলাকায় বড়ো হলেও মফঃস্বল শহর হিসেবে তিনি মাইজদীতে উদার পারিবারিক আবহে খেলাধুলা এবং সাংস্কৃতিক চর্চায় জড়িত ছিলেন। তবে, মনে পুষে রেখেছিলেন কোনো একসময় তিনি ঢাকায় এসে মিডিয়ায় কাজ করবেন। কিন্তু মিডিয়াতে কাজ করার আগ্রহ থাকলেও মিডিয়ার পরিবেশ নিয়ে মানুষের মধ্যে যে নেতিবাচক ধারণা ছড়িয়ে আছে তার কারণে তার মধ্যে কিছুটা ভয়ও কাজ করত। এ প্রসঙ্গে তিনি মজা করে বলেন, ‘আমার একদিকে যেমন মিডিয়া প্রীতি ছিল তেমনি মিডিয়া ভীতিও ছিল প্রবল’।

সে কারণে বয়সকালে আর মিডিয়াতে আসা হয়নি। যে বয়সে মানুষ মিডিয়া ছেড়ে যায় সেই বয়সে তিনি মিডিয়ায় প্রবেশ করেন। নাটক-বিজ্ঞাপনে প্রধান চরিত্রে কাজ করার বয়স না থাকায় মনে হলো এই বয়সে অন্তত খবর পাঠের কাজ তো করা যাবে।

গ্রামীণ টেলিকমে চাকরি করার সময়ই পরিচিত এক রিপোর্টারের মাধ্যমে জানতে পারেন বিটিভিতে সংবাদ উপস্থাপক নেওয়া হচ্ছে। এটা ২০১০-১১ খ্রিষ্টাব্দের কথা। সেই রিপোর্টার জানান সেদিনই আবেদনপত্র জমা দেওয়ার শেষ তারিখ। তাই কল পাওয়ার সাথে সাথেই দেরি না করে তার একজন পরিচিত লোককে দিয়ে আবেদনপত্রটি পাঠিয়ে দেন। কিছুদিন পর তাকে বিটিভি থেকে ডাকা হয় এবং একে একে সরাসরি সাক্ষাৎকার, ভয়েস টেস্ট ও স্ক্রিন টেস্টে উত্তীর্ণ হয়ে অবশেষে তিনি বিটিভিতে সংবাদ উপস্থাপক হিসেবে এনলিস্টেড হওয়ার যোগ্যতা অর্জন করেন।

প্রথম সংবাদ পাঠের অভিজ্ঞতা জানতে চাইলে বাবলী বলেন, “প্রথম সংবাদ পাঠের অভিজ্ঞতা বলতে বিকেল ৫টায় একটা সংবাদ প্রচারিত হতো যার ব্যাপ্তি ছিল ৫ মিনিট। সেটাই প্রথম পড়তে দেওয়া হয়। প্রথম দিন তো, তাই একটু ভয় ছিল, ক্যামেরার ভয়। জীবনে প্রথম ক্যামেরার সামনে পারফর্ম করা তাও আবার রেকর্ড করা নয়, একেবারে লাইভ নিউজ যাচ্ছে। ওই মুহূর্তে আমি যা পড়ছি বা করছি তাই দর্শক শুনবে-দেখবে। ভুল করা বা ফাঁকি দেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। ছোটোবেলা থেকেই আমি রিডিং পড়তে খুব পছন্দ করতাম। যার জন্য প্রথমবার নিউজ পড়তে আমার খুব একটা সমস্যা হয়নি। আমার নিজের কাছে মনে হয়েছে বাংলাতেই তো পড়বো এত ভয় পাওয়ার কী আছে- তবে, এখানে বিশেষভাবে বলতে হবে যে, খবর পড়া বা উপস্থাপনার বিষয়ে আমার কোনো প্রশিক্ষণ ছিল না। আমি কোথাও কোনো প্রতিষ্ঠানে কখনো ট্রেনিং নিইনি। যেদিন খবর থাকতো আমার ছোটোবোনকে বলতাম ক্যামেরা দিয়ে একটু রেকর্ড করে রাখো। ও রেকর্ড করে রাখতো। আমি বাসায় গিয়ে দেখতাম। ওইটা দেখে দেখেই আমি ইমপ্রুভ করেছি। আমার মনে হয়, আমিই আমার সবচেয়ে বড়ো সমালোচক। এছাড়া, আমার পরিবারের সদস্যরাও।

একজন ভালো সংবাদ উপস্থাপক হওয়ার জন্য কী কী গুণ থাকা দরকার বলে আপনি মনে করেন ? উত্তরে বাবলী বলেন, “আমি বলব সবার আগে ভয়েস ভালো হতে হবে। তারপর স্পষ্ট উচ্চারণ। এরপর প্রেজেন্টেশন অর্থাৎ আপনি খবর কীভাবে উপস্থাপন করবেন, বাচনভঙ্গি। আরো আছে ড্রেসআপ, মেকআপ, খেলাধুলা-রাজনীতি, সমসাময়িক বিষয় সম্পর্কে ধারণা। তবে, আমার কাছে ফার্স্ট প্রায়োরিটি হচ্ছে কণ্ঠ। কারণ, বাদবাকি বৈশিষ্ট্যগুলো আপনি রপ্ত করে নিতে পারবেন সময়-প্রশিক্ষণের মাধ্যমে।

প্রথম সংবাদ উপস্থাপন করতে গিয়ে কোনো বিব্রতকর পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়েছেন কি না এমন প্রশ্নের জবাবে বলেন, ‘না প্রথম দিন এরকম কোনো সমস্যা হয়নি। তবে, রাত ৮টার সংবাদ যেদিন প্রথম পড়ি সেদিন সমস্যা হয়েছিল। কারণ, রাত ৮টা এবং ১১.৩০ মিনিটের খবর তখন দুজন উপস্থাপক পড়তো। দু’জন উপস্থাপক হলে মেকআপ নিতে গিয়ে যেমন বিড়ম্বনায় পড়তে হয় তেমনি ক্যামেরা পরিবর্তন, স্ক্রিপ্ট এসব নিয়েও সমস্যা দেখা দেয়। আমি প্রথম যেদিন রাত ৮টার খবর পড়ি তখন টকব্যাক দুইটার মধ্যে একটা নষ্ট ছিল। তাই, স্বাভাবিকভাবেই একমাত্র ভালো টকব্যাকটি সেদিন আমার সাথে যে সিনিয়র উপস্থাপক ছিলেন তাকে দেওয়া হয়েছিল। আমাকে কোনো টকব্যাক দেওয়া হয়নি। যে কারণে কন্ট্রোল রুমের সাথে আমার কোনো যোগাযোগ ছিল না। খবরের এক পর্যায়ে আমার খবর বলা শেষ হয়ে গেলেও ক্যামেরা আমাকে ধরে রেখেছে। অর্থাৎ টেলিভিশনের পর্দায় আমাকে দেখা যাচ্ছিল অথচ তখন সিনিয়র উপস্থাপক পর্দায় আসবেন কিন্তু ক্যামেরাম্যান তাকে না এনে আমাকে ধরে রেখেছে। ফলে আমরা দুজনই চুপ করে আছি। এদিকে আমার টকব্যাক না থাকলেও গ্লাসের ওপাশে কন্ট্রোল রুম থেকে এত জোরে ‘পড়েন পড়েন’ বলছিল যে সেটা আমার কানেও আসছিল। তাই, আমি ভেবেছিলাম যান্ত্রিক কোনো সমস্যার কারণে হয়ত সিনিয়র উপস্থাপককে দেখানো যাচ্ছে না তাই আমাকে খবর পড়ে যেত বলা হচ্ছে, তখন আমি আমার হাতে থাকা বাকি খবরগুলো পড়তে শুরু করি। আর তখনই সিনিয়র উপস্থাপক ভাইয়া আমাকে ইশারা করে থামতে বলেন। আমার খুব লজ্জা লাগছিল। আসলে ভুলটা তাদের টেকনিক্যাল ছিল কিন্তু মানুষ তো আমাকে দেখেছে। আসলে দু’জন উপস্থাপক হলে সিনক্রোনাইজেশনে সমস্যা হয়। তবে, এখন বিটিভিতে একজন করে খবর পড়ে বিধায় এ ধরনের সমস্যাগুলো এখন আর হয় না।