বিশ্বের সবচেয়ে বড়ো ক্রীড়া আয়োজন অলিম্পিক শুরু হয় ২৬ জুলাই, ২০২৪ ফ্রান্সের প্যারিসে। সেদিন জমকালো আয়োজনের মধ্যে দিয়ে পর্দা ওঠে কাক্সিক্ষত এই ক্রীড়া যজ্ঞের। অলিম্পিকের পর্দা ওঠার সঙ্গে সঙ্গে বিশ্বের ক্রীড়াপ্রেমীদের মধ্য ব্যাপক আগ্রহ-উদ্দীপনা লক্ষ্য করা যায়।
অলিম্পিকের ইতিহাস থেকে জানা যায়, খ্রিষ্টপূর্ব ৭৭৬ অব্দের দিকে শুরু হলেও আধুনিক অলিম্পিকের আসর শুরু হয় গ্রিসে ১৮৯৬ খ্রিষ্টাব্দে। এরমধ্যে দু’টি বিশ্বযুদ্ধের কারণে অলিম্পিক আয়োজন ব্যাহত হয় তিনবার [১৯১৬, ১৯৪০ ও ১৯৪৪]।
এর বাইরে এখন পর্যন্ত নিয়মিতভাবেই আয়োজন করে আসছে অলিম্পিক। প্রাচীন অলিম্পিক গেমসের প্রায় একহাজার পাঁচশত বছর পর অলিম্পিক গেমস আয়োজন করার জন্য এগিয়ে আসেন একজন তরুণ ফরাসি যুবক। তার নাম ব্যারন পিয়েরে দ্য কুবার্তিন। তাকেই আধুনিক অলিম্পিকের জনক বলা হয়। পিয়েরে মাত্র সাত বছর বয়সেই যুদ্ধের নির্মম ভয়াবহতা দেখেছিলেন। যুদ্ধের সেই নির্মম ভয়াবহ অভিজ্ঞতা দেখা থেকেই পিয়েরে সারাবিশ্বে শান্তির অবারিত বারতা ছড়িয়ে দিতে ক্রীড়াকে বেছে নেন। অলিম্পিক গেমসকে পুনরুজ্জীবিত করার প্রয়াসে বিশেষ পদক্ষেপ নেন তিনি। সৌহার্দ্য, বন্ধুত্ব, সহমর্মিতা এবং একটি শান্তির বিশ্বকে দেখার জন্য তার এই প্রচেষ্টা। কিন্তু তার এই প্রচেষ্টা কাউকে সেরকমভাবে আগ্রহী করে তুলতে পারেনি। এর কারণ হলো কুবার্তিনের আগেও বহু মানুষ অলিম্পিক গেমস করার কথা বলেছিলেন। সেটা ছিল ১৮৯২ খ্রিষ্টাব্দের কথা। তারপরও তিনি হাল ছেড়ে দেননি। কুবার্তিন আবার দুই বছর পর ৯টি দেশের ৭৯ প্রতিনিধিকে নিয়ে এক জরুরি সভা করেন। সেখানে তিনি তার অনেক দিনের লালিত স্বপ্নের কথা জানান। তার কথাগুলো মনোযোগ দিয়ে সবাই শোনার পর আর কেউ অলিম্পিকের ব্যাপারে দ্বিমত পোষণ করেননি। এরপর দ্রুত গঠন করা হয় অলিম্পিক আয়োজন করার জন্য একটি আন্তর্জাতিক কমিটি। পরে এর নাম দেওয়া হয় আন্তর্জাতিক অলিম্পিক কমিটি [আইওসি]।
এরপর এথেন্সের প্যানাথেসিয়াস স্টেডিয়ামে ১৮৯৬ খ্রিষ্টাব্দে উদ্বোধন হয় প্রথম আধুনিক অলিম্পিক গেমসের। দ্বিতীয় আসরটি হয় প্যারিসের পিয়েরে কুবার্তিনের শহরে। ওই সময় প্রথমবারের মতো মহিলা ক্রীড়াবিদেরা অলিম্পিক গেমসে অংশগ্রহণ করেন। ১৯০৪ খ্রিষ্টাব্দের অলিম্পিক অনুষ্ঠিত হয় যুক্তরাষ্ট্রের সেন্ট লুইসে। ১৯০৮ খ্রিষ্টাব্দে প্রথমবারের মতো লন্ডন অলিম্পিকে অন্তর্ভুক্ত করা হয় ম্যারাথন দৌড় ইভেন্ট। ১৯১২ খ্রিষ্টাব্দের স্টকহোম অলিম্পিকে অংশ নেয় ২,৫০৪ জন প্রতিযোগী, যা আগের ছয়টি আসরের চেয়ে বেশি। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের কারণে ১৯১৬ খ্রিষ্টাব্দের বার্লিন অলিম্পিক অনুষ্ঠিত হতে পারেনি। ১৯২০ খ্রিষ্টাব্দের অ্যান্টিয়ার্প অলিম্পিকে ফিনল্যান্ডের খেলোয়াড় পাভো নুর্মি অসাধারণ ক্রীড়াশৈলী প্রদর্শন করেন। ১৯২৮ খ্রিষ্টাব্দের আমস্টারডাম অলিম্পিকে প্রথমবারের মতো নারী ক্রীড়াবিদরা অনুমতি পান ট্র্যাক অ্যান্ড ফিল্ডে অংশ নেওয়ার। সেইসঙ্গে প্রথমবারের মতো অলিম্পিক আসরকে পৃষ্ঠপোষকতা করার প্রথা চালু হয়। স্পন্সর করেন বিশ্বখ্যাত কোমল পানীয় প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠান ‘কোকো-কোলা।’ এরপর বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক মন্দার মুখে ১৯৩২ খ্রিষ্টাব্দের লস অ্যাঞ্জেলস অলিম্পিক অনুষ্ঠিত হয়। ১৯৩৬ খ্রিষ্টাব্দের বার্লিন অলিম্পিকে স্বাগতিক জার্মানির শ্রেষ্ঠত্ব সবার নজরে আসে। ওই আসরে মার্কিন কৃষ্ণাঙ্গ জেসি ওয়েন্সের বিস্ময়কর সাফল্য মুগ্ধ করে বিশ্ববাসীকে। সেইসময় থেকেই অলিম্পিকে মশাল প্রজ্বালনের প্রথা চালু হয়।
১৯৪০ খ্রিষ্টাব্দের টোকিও [পরবর্তীসময়ে হেলসিঙ্কি] এবং ১৯৪৪ খ্রিষ্টাব্দের লন্ডন অলিম্পিক আয়োজন করতে পারেনি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ভয়াবহতার কারণে। ১৯৪৮ খ্রিষ্টাব্দে লন্ডনে দ্বিতীয়বার বসে অলিম্পিকের আসর। ১৯৫২ খ্রিষ্টাব্দে বসে হেলসিঙ্কিতে। সেবারই সোভিয়েত ইউনিয়ন প্রথমবারের মতো অংশ নেয়। ১৯৫৬ খ্রিষ্টাব্দের অলিম্পিক প্রথমবারের মতো বসে ওশানিয়া মহাদেশের মেলবোর্নে। ১৯৬০ খ্রিষ্টাব্দের রোম অলিম্পিকে প্রবাদপ্রতিম বক্সার যুক্তরাষ্ট্রের মোহাম্মদ আলী স্বর্ণ জিতে নিজের আগমনী বার্তা জানান দেন।
এরপর উন্নত তথ্য-প্রযুক্তির কারণে ১৯৬৪ খ্রিষ্টাব্দের টোকিও অলিম্পিক স্মরণীয় হয়ে আছে। তখন টেলিভিশনে ব্যাপকভাবে অলিম্পিক গেমস সম্প্রচার করা হয়। ‘ব্ল্যাক পাওয়ার স্যালুট’-এর জন্য ১৯৬৮ খ্রিষ্টাব্দের মেক্সিকো অলিম্পিক স্মরণীয় হয়ে আছে। ১৯৭২ খ্রিষ্টাব্দের মিউনিখ অলিম্পিক স্মরণীয় হয়ে আছে ১১জন ইসরাইলি অ্যাথলেট মর্মান্তিকভাবে নিহত হওয়ার ঘটনায়। ১৯৭৬ খ্রিষ্টাব্দের মন্ট্রিল অলিম্পিক সমালোচনার মুখে পড়ে অতিরিক্ত অর্থ ব্যয়ের কারণে। ১৯৮০ খ্রিষ্টাব্দের মস্কো অলিম্পিকে অংশ নেয়নি যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রপক্ষের ৬৬ দেশ । ১৯৮৮ খ্রিষ্টাব্দের সিউল অলিম্পিক প্রথমবারের মতো এশিয়ায় অনুষ্ঠিত হয়। ওই খেলায় পুরুষদের ১০০ মিটার দৌড়ে ৯.৭৯ সেকেন্ড সময় নিয়ে বিশ্বরেকর্ড গড়ে আলোচনায় আসেন কানাডার স্প্রিন্টার বেন জনসন। কিছুদিন পরে জানা যায় তিনি শক্তিবর্ধক নিষিদ্ধ মাদক সেবন করে শক্তি বাড়িয়েছিলেন। ফলে তার স্বর্ণপদক নিয়ে নেওয়া হয় এবং তাকে নিষিদ্ধ করা হয়। ১৯৯৬ খ্রিষ্টাব্দের আটলান্টা অলিম্পিক শুরুর আগে যুক্তরাষ্ট্রের একটি পার্কে সন্ত্রাসীদের বোমা হামলায় কিছু ব্যক্তির প্রাণহানি ঘটলে আয়োজন নিয়ে অনিশ্চয়তার সৃষ্টি হয়।
২০০০ খ্রিষ্টাব্দের সিডনি অলিম্পিক ছিল বিংশ শতাব্দীর শেষ অলিম্পিক। ২০০৪ খ্রিষ্টাব্দের অলিম্পিক আবারও আয়োজন করা হয় গ্রিসে। ২০০৮ খ্রিষ্টাব্দের অলিম্পিক চীনের বেজিংয়ে প্রথমবারের মতো অনুষ্ঠিত হয়। স্বর্ণপদক পেয়ে সবাইকে চমকে দিয়ে এক নম্বরে চলে যান চীন। এরপর ২০১২ খ্রিষ্টাব্দের ৩০তম অলিম্পিকের আয়োজন করা হয় লন্ডনে। ২০১৬ খ্রিষ্টাব্দে ৩১তম আসরের আয়োজক ছিল ব্রাজিলের রিও শহর। ২০২০ খ্রিষ্টাব্দে ৩২তম অলিম্পিক করোনার কারণে ২০২১ খ্রিষ্টাব্দে আয়োজন করা হয়। আয়োজক ছিল জাপানের টোকিও। এবার ৩৩তম অলিম্পিক আবারও ফিরে আসে অলিম্পিকের আতুরঘর প্যারিসে।
প্যারিস অলিম্পিকে বিভিন্ন পদক পেলেন যারা
১১ আগস্ট, ২০২৪ রবিবার রাতে ‘স্তাদ দ্য ফ্রান্স’ স্টেডিয়ামে জমকালো সমাপনী অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে প্যারিসে ৩৩তম গ্রীষ্মকালীন অলিম্পিক শেষ হয়। এবারের অলিম্পিকে ৩২টি ইভেন্টে ৩২৯টি স্বর্ণপদক জেতার জন্য লড়াই করেছেন ১০ হাজারেরও বেশি অ্যাথলেট। দুই অলিম্পিক পরাশক্তি যুক্তরাষ্ট্র ও চীন ৪০টি করে স্বর্ণপদক জেতে। এদিকে স্বর্ণপদকসহ মোট পদকের হিসাবে যুক্তরাষ্ট্রই এগিয়ে। তারা স্বর্ণ, রৌপ্য ও ব্রোঞ্জপদক মিলে মোট ১২৬টি পদক জিতেছে। ফরাসি ২২ বছরের তরুণ লিওঁ মারশাঁ সাঁতারের পুল থেকে চারটি স্বর্ণ ও একটি ব্রোঞ্জ জিতেছেন। ইতিহাসের ষষ্ঠ সাঁতারু হিসেবে একই আসরে চারটি স্বর্ণ জিতেছেন মারশাঁ। ভাবুন তো একবার। তেমনি আমেরিকান টরি হাস্কে নামের এক সাঁতারু তিনটি স্বর্ণ ও দু’টি রৌপ্যপদক জিতেছেন। অস্ট্রেলিয়ার সাঁতারু মলি ও কালাহান জিতেছেন পাঁচ পদক। তিনটি স্বর্ণ, একটি রৌপ্য ও একটি ব্রোঞ্জপদক লাভ করেন তিনি। প্যারিস অলিম্পিকে তিনটি স্বর্ণ ও একটি রৌপ্য জিতেছেন আমেরিকান জিমন্যাস্ট সিমোন বাইলস। আরেক আমেরিকান সাঁতারু গ্রেট কেটি লেডেকি দু’টি স্বর্ণসহ মোট চারটি পদক জিতে ইতিহাস গড়েছেন। তিনিই হচ্ছেন এবারের অলিম্পিকের সর্বোচ্চ স্বর্ণজয়ী নারী সাঁতারু।
এছাড়া প্যারিসে স্বর্ণ জয়ের আনন্দে মেতেছিলেন সিডনি ম্যাকলফলিন-লেভরন, গ্যাব্রিয়েল টমাস, জুলিয়েন আলফ্র্রেড, শা’কারি রিচার্ডসন, নোয়াহ লাইলস, নোভাক জোকোভিচ, আরশাদ নাদিম, সারাহ সোয়েস্ট্রম, কিনওয়েন ঝেং, আরমান্ড ডুপ্লান্টিস, সিফান হাসানসহ আরো অনেকেই। এছাড়া দলগতভাবে ফুটবল, ভলিবল, হকি, বাস্কেটবল, বিচ ভলিবলসহ বিভিন্ন ইভেন্ট থেকে পদক প্রাপ্তি উদ্যাপন করেছে অনেক দেশ।
প্যারিস অলিম্পিকের প্রত্যেকটি পদকে আছে আইফেল টাওয়ারের টুকরো। সংস্কারের সময় আইফেল টাওয়ারের কিছু পুরাতন লোহা বাদ দিয়ে প্রতিস্থাপন করা হয় নতুন লোহা। সেই বাদ দেওয়া লোহাগুলোকেই এবার পদক তৈরি করতে কাজে লাগানো হয়েছে !
প্যারিস অলিম্পিকের সেরা খেলোয়াড়ের পুরস্কার স্বর্ণপদকের ওজন ৫২৯ গ্রাম। এর মধ্যে ৫০৫ গ্রামই রুপা। সঙ্গে ১৮ গ্রাম লোহা, আর বাকি ৬ গ্রাম স্বর্ণ। ওজনের দিক থেকে সবচেয়ে হালকা ব্রোঞ্জ পদক। প্রত্যেকটি ব্রোঞ্জপদকের ওজন ৪৫৫ গ্রাম করে। এর মধ্যে ৪১৫ গ্রাম কপার, ২২ গ্রাম জিঙ্ক ও ১৮ গ্রাম লোহা। রৌপ্যপদকের ওজন ৫২৫ গ্রাম। এর মধ্যে ৫০৭ গ্রাম রুপা, বাকি ১৮ গ্রাম লোহা। প্রত্যেকটি পদকেই ১৮ গ্রাম লোহা আছে।
প্যারিস অলিম্পিকের স্বর্ণপদকের মূল্য প্রায় ৯৫০ ডলার বা ১ লাখ ১১ হাজার ৬৫৩ টাকা। এছাড়া রৌপ্যপদকের মূল্য প্রায় ৪৮৬ ডলার বা ৫৭ হাজার টাকা এবং ব্রোঞ্জ পদকের মূল্য প্রায় ১৩ ডলার বা ১ হাজার ৬০০ টাকার মতো।
তথ্যসূত্র : ইন্টারনেট