অনেক সময় আমরা বলি যে, জীবন মানেই সিনেমা। হ্যাঁ, আমাদের জীবনটা অনেক সময় সিনেমার মতো হয়। মানুষের বিনোদনের সবচেয়ে অন্যতম মাধ্যম চলচ্চিত্র। আমরা কমবেশি সিনেমা দেখেই থাকি। নিছক বিনোদনের বাইরেও সিনেমা আমাদের জীবন নিয়ে ভাবতে শেখায়। অনেক সিনেমা হতাশা ও নিরাময়ে পথ দেখায়, নতুন করে ভাবতে শেখায়। আজ হলিউড আয়োজনে থাকছে এমন কিছু সিনেমা যেগুলো দেখার পর আপনার জীবন নিয়ে চিন্তা-ভাবনায় অবশ্যই পরিবর্তন আসবে...
প্যারাস্যুট অব হ্যাপিনেস
গল্পটি পরাজয়ের বিরুদ্ধে জীবনযুদ্ধে জয়ী এক মানুষের গল্প। গল্পটি এক বাবা আর তার পুত্রের টিকে থাকার গল্প। বারবার ব্যর্থতা, চ্যালেঞ্জ আর অক্লান্ত পরিশ্রমের মধ্য দিয়ে ঘুরে দাঁড়ানো এক সেলসম্যান ও তার সন্তানকে নিয়ে এই সিনেমা। সফল হতে হলে ব্যর্থতার রাস্তায় পা ফেলতেই হবে। আমরা যদি আজকের বিশে^ও সফল মানুষদের জীবনকাহিনি দেখি, তাহলে দেখবো তারাও একসময় একটা কঠিন সংগ্রামের মধ্যে দিয়ে গেছে।
সিনেমায় আমরা দেখি সেই সেলসম্যানের স্ত্রী ছেড়ে চলে যায় তাকে, বাড়িভাড়া পরিশোধ করতে না পারায় হারান মাথা গোঁজার ঠিকানাও। কিন্তু সবকিছু ছাপিয়ে তার মাথায় একটিই চিন্তা আর সেটা হলো নিজের সন্তানের জন্য একটি নিরাপদ ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করা। তিনি বারবার হোঁচট খাওয়ার পরও উঠে দাঁড়িয়েছেন। সিনেমাটিতে অসাধারণ অভিনয়ের জন্য অস্কার এবং গোল্ডেন গ্লোব পুরস্কারের জন্য মনোনয়ন পান অভিনেতা উইল স্মিথ। উইল স্মিথের ছেলের চরিত্রে অভিনয় করেন তারই ছেলে জ্যাডেন স্মিথ। দ্য প্যারাস্যুট অব হ্যাপিনেস মুভিটি পরিচালনা করেছেন ইটালিয়ান পরিচালক গ্যাব্রিয়েল মুচিনো।
ফরেস্ট গাম্প
জীবন অনেকটা ম্যাজিকের মতো। কখন কী হয় তা ঠিক আগে থেকে বোঝা যায় না। দৃঢ় মনোবল মানুষের জীবনের একরকম শক্তি যার মাধ্যমে মানুষ বদলে দিতে পারে নিজের জীবনের মোড়। ১৯৯৪ খ্রিষ্টাব্দে আমেরিকান কমেডি ড্রামা ঘরানার চলচ্চিত্রটি মূলত উইন্সটন গ্রুমের উপন্যাস ‘ফরেস্ট গাম্প’-এর চলচ্চিত্রায়ণ করেন রবার্ট জেমেকিস। অ্যালাবামা থেকে আসা এক অতিসাধারণ মানুষ ফরেস্ট গাম্প ছিলেন একজন প্রতিবন্ধী। কিন্তু নিজের অদম্য মানসিকতা দিয়ে এই মানুষটিই একসময় হয়ে ওঠেন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসের অন্যতম একজন।
সিনেমাটি আপনাকে আরো শেখাবে সততা, মানুষের এমন এক গুণ যা সবসময়ই কাজে লাগে। অতি সাধারণ এক মানুষ ফরেস্ট গাম্প। তার আইকিউ অন্য দশজনের তুলনায় কম। নিজের মা ছাড়া অন্য কাউকে সে জানে না। মায়ের দেখানো সহজ-সরল সাজানো পথে জীবন সাজাতে চায় সে। আরেকজনকে সে পরম ও একমাত্র বন্ধু হিসেবে চেনে সে হলো জেনি। একসময় সেনাবাহিনীতে যোগ দেয় ফরেস্ট। তারপর বছরের পর বছর চলে যায়। একে একে ঘটনার জন্ম দেয় ফরেস্ট। কিন্তু কোনো কিছুই ফরেস্টকে আলোড়িত করে না। আলোড়িত করে কেবল জেনি তার ছোটোবেলার সেই বন্ধু ।
এই চলচ্চিত্রটি ১৯৯৪ খ্রিষ্টাব্দে মুক্তি পাওয়ার পর আয় করে নেয় ৬৭৭ মিলিয়ন মার্কিন ডলার, যার নির্মাণ ব্যয় ছিল মাত্র ৫৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। ৬৭তম অস্কারে এই চলচ্চিত্র ১৪টি বিভাগে মনোনয়ন পেয়ে সেরা অভিনেতাসহ জিতে নেয় ৬টি বিভাগে শ্রেষ্ঠ পুরস্কার। টম হ্যাংস তার জীবনের অন্যতম মুভি হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন এই সিনেমাকে।
লাইফ ইজ বিউটিফুল
জীবন মাত্রই সুন্দর। তার আশেপাশে অসুন্দর জীবনকে সুন্দরভাবে দেখা যায়। ইতালিয়ান সিনেমা ‘লাইফ ইজ বিউটিফুল’ সিনেমাটি চলচ্চিত্র জগতে দারুণ এক সংযোজন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের উপর অনেক সিনেমা তৈরি হয়েছে তার মাঝে সেরা হচ্ছে ‘লাইফ ইজ বিউটিফুল’ সিনেমাটি একথা অনেকেই বলবেন। ২০ ডিসেম্বর ১৯৯৭ খ্রিষ্টাব্দে ইতালিতে মুক্তি পাওয়া এই সিনেমাটি দেখার পর যে কেউ বলতে বাধ্য হবেন যে, এটা একটা মাস্টারপিস মুভি। মুভিটির অরিজিনাল টাইটেল হলো ‘লা ভিটা ই বেলা’। ১৯৯৭ খ্রিষ্টাব্দে মুক্তিপ্রাপ্ত ইতালিয়ান কমেডি ড্রামা ফিল্ম। রবার্তো বেনিনি পরিচালিত ও অভিনীত চমৎকার এই ছবিটি অস্কার ছাড়াও আরো অনেক পুরস্কার জিতেছে।
রবার্তো বেনিনি অভিনয় করেছেন কেন্দ্রীয় গুইডো অরিফিস চরিত্রে। এই ছবির প্রাণ গুইডো একটা বইয়ের স্টলের মালিক। ভাগ্যের নির্মম পরিহাসে তাকে স্বপরিবারে নাজি কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পে বন্দিত্ব বরণ করতে হয়। তার ছেলে যশুয়াকে তিনি আগলে রাখেন। ছেলের বন্দিজীবনকে তিনি সুকৌশলে ছেলের কাছে এই গেইমের মতো করে তুলে ধরেন। শেষ পর্যন্ত ছেলে বুঝতে পারে না যে নির্মম এক যুদ্ধের মধ্যে থেকেও সেটা ছিল আনন্দের।
দ্য শশাঙ্ক রিডেম্পশন
মানুষ যদি চায় সে সব বাধা অতিক্রম করতে পারে। তার ভেতরের শক্তি যদি সে জাগ্রত করতে পারে সে অসাধ্য সাধন করতে পারে এমনই এক গল্প নিয়ে এই সিনেমা। গল্পের নায়ক ‘অ্যান্ডি’ সিস্টেমের অন্যায়ের শিকার ছিল, কিন্তু সে মাথা নত না করে সেই সিস্টেমকে চ্যালেঞ্জ করেছে। বারবার মার খেয়েছে, আবার উঠে দাঁড়িয়েছে। ১৯ বছর লড়াই করেছে।
অ্যান্ডি ডুফ্রেইন, একজন ব্যাংকার ১৯৪৬ খ্রিষ্টাব্দে শশাঙ্ক প্রিজনে প্রবেশ করেন স্ত্রী হত্যার দায় মাথায় নিয়ে। তার নম্র আচরণ আর পরিচ্ছন্ন চিন্তাভাবনা দেখেই বোঝা যায় স্ত্রী হত্যার দায়ও হয়ত মিথ্যা। সেখানেই তার পরিচয় আর বন্ধুত্ব হয়। কিশোর বয়সে রাগের মাথায় খুন করা অ্যাফ্রো-আমেরিকান ‘রেড’ জেলখানার প্রথম ২ বছর খুবই খারাপ কাটে অ্যান্ডির। গার্ডদের দ্বারা উত্যক্ত হওয়া, যৌন নির্যাতন, অমানুসিক নির্যাতন সব কিছুই মুখ বুঁজে সহ্য করতে হয়েছে তাকে। একপর্যায়ে তার ব্যাংকিং স্কিল কাজে লাগিয়ে তিনি গোপন টাকার পাহাড় জমাতে থাকে। কয়েক বছর পর তাকে জেলের লাইব্রেরির দায়িত্ব দেওয়া হয়। এখানেও অ্যান্ডি তার লেগে থাকার পরিচয় দেয় ৬ বছর প্রতিসপ্তাহে কর্তৃপক্ষের কাছে বই চেয়ে একটি করে চিঠি লেখে। শেষ পর্যন্ত সে বই আদায় করেই ছাড়ে। শুধু তাই না, ১৯৬৩ খ্রিষ্টাব্দে সে ওই লাইব্রেরিকে পুরো নিউ ইংল্যান্ডের সেরা প্রিজন লাইব্রেরিতে পরিণত করে। ‘দ্য শশাঙ্ক রিডেম্পশন’ মুভিটি পরিচালনা করেছেন ফ্রান্সের মুভি ডিরেক্টর ফ্র্যাংক ড্যারাবন্ট। ‘দ্য শশাঙ্ক রিডেম্পশন’-এর প্রযোজনা করেছে নিকি মারভিন। এই গল্পের লেখক ছিলেন স্টিফেন কিং। ‘দ্য শশাঙ্ক রিডেম্পশন’ মুভিটি নির্মাণ করা হয়েছে স্টিফেন কিং-এর লেখা রিতা হাইওর্থ অ্যান্ড শশাঙ্ক রিডেম্পশন-এর ওপর ভিত্তি করে। ২ ঘণ্টা ২২ মিনিটের এই মুভিটি প্রথম মুক্তি পায় ১৪ অক্টোবর ১৯৯৩ খ্রিষ্টাব্দে। ২৫ মিলিয়ন বাজেটের দ্য শশাঙ্ক রিডেম্পশন মুভিটি বক্স অফিসে ৫৮.৩ মিলিয়ন আয় করে।
দ্য পিয়ানিস্ট
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে এক ইহুদি পিয়ানোবাদকের চোখে দেখা যুদ্ধের বিভীষিকা দ্য পিয়ানিস্ট চলচ্চিত্রে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। এই ছবিটি খুব স্পষ্ট করে দেখিয়েছে অপরিবর্তনীয় বিশ্ববাস্তবতা। যুদ্ধেও বিভিষীকায় সে একজায়গা থেকে ঘুরে বেড়ায় অন্য জায়গায়। কখনো খাবারের জন্য হাহাকার আবার কখনো অল্প কিছু খাবার সবাই ভাগ করে খাওয়া। এই ভয়ংকর সময়ে পরিবারের মানুষগুলো যেন আরো আপন হয়ে যায়। কিন্তু এই যুদ্ধে সে একে একে হারিয়ে ফেলে তার পরিবারের সব সদস্যকে। এত কিছুর মাঝেও তার পিয়ানো বাজানোর আকাক্সক্ষা বেঁচে থাকে। যুদ্ধবাজদের সব দম্ভ-অপমান-নির্যাতনের মাঝেও সে শিল্পীসত্তাটিকে বাঁচিয়ে রাখে। পরিবার-পরিজন-প্রতিবেশীরা একে একে হারিয়ে যেতে থাকলেও সে বেঁচে থাকার লড়াই চালিয়ে যেতে থাকে। সাধ্যমতো সবাইকে সাহায্য করতেও চেষ্টা করে। দ্য পিয়ানিস্ট ছবির প্রথম দৃশ্যে পিয়ানিস্টকে একটি রেডিও স্টেশনে পিয়ানো বাজাতে দেখা যায়। ছবির শেষ দৃশ্যেও সে রেডিও স্টেশনে পিয়ানো বাজাতে থাকে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে নাৎসি গণহত্যায় ইহুদিরা মারা যায় ; উচ্ছেদ হয়ে যায় ; আবার ইঙ্গ-মার্কিন-ফ্রান্স যৌথ বাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধে নাৎসিরা হেরে যায় ; কিন্তু পিয়ানিস্ট তার শিল্পীসত্তা নিয়ে বেঁচে থাকে এই যুদ্ধে। সে আবারো পিয়ানো বাজিয়ে শান্তির সুর ছড়িয়ে দেয় বিদ্ধস্ত এই পৃথিবীতে।
দ্য পিয়নিস্ট রোমান পোলানস্কি পরিচালিত একাডেমি পুরস্কার বিজয়ী চলচ্চিত্র। পোল্যান্ড, ফ্রান্স, জার্মানি ও ব্রিটেনের যৌথ প্রযোজনায় নির্মিত এই ছবিটি ২০০২ খ্রিষ্টাব্দে মুক্তি পেয়েছিল। ছবির প্রধান চরিত্রে অভিনয় করেছেন অ্যাড্রিয়েন ব্রডি। ১৫০ মিনিটের এই সিনেমাটিতে প্রায় ছয়টি ভাষার ব্যবহার করা হয়েছে। দেশ-বিদেশের অসংখ্য পুরস্কারের সাথে এই সিনেমাটি ৭৫তম একাডেমি অ্যাওয়ার্ড জিতেছে।
লেখা : ফাতেমা ইয়াসমিন