কাঠুরে যখন কুড়াল দিয়ে কাঠ কাটে তখন ঠকঠক আওয়াজ হয়। কাঠুরেই কেবল ঠকঠক আওয়াজ তুলে কাঠ কাটে না। আরও একটি প্রাণী আছে, যারা ঠকঠক করে কাঠ কাটে। তাদের আমরা কাঠঠোকরা পাখি নামে জানি। মাথায় রঙিন পালক এবং লম্বা ঠোঁটের এই পাখি সারাদিন এক গাছ থেকে অন্য গাছের গায়ে ছুটে বেড়ায় আর লম্বা ঠোঁট দিয়ে গাছের গায়ে আঘাত করে- এমন দৃশ্য সচরাচর গ্রামবাংলায় দেখা যায়।
কাঠঠোকরার ইংরেজি নাম ডড়ড়ফঢ়বপশবৎ এরা চরপরফধব পরিবারের সদস্য। বৃক্ষবাসী এই পাখিরা খুব কম সময়েই মাটিতে নেমে আসে এবং এরা সাধারণত একাকী থাকতে পছন্দ করে। তবে, এদের কয়েকটি প্রজাতি আছে যারা এর ব্যতিক্রম, তারা দলবদ্ধভাবে থাকতে ভলোবাসে। খুব বেশি প্রয়োজন না হলে কাঠঠোকরা গাছ থেকে নামে না এবং লোকালয় এড়িয়ে চলে।
সারাপৃথিবীতে প্রায় ২০০ প্রজাতির কাঠঠোকরার অস্তিত্ব নিশ্চিত করেছে পাখিবিজ্ঞানীরা, যার মধ্যে অধিকাংশই বর্তমানে বিলুপ্ত এবং অস্তিত্ব টিকিয়ে রেখেছে এমন আরো প্রায় ২২টি প্রজাতি বিলুপ্তির পথে। বাংলাদেশে ২২টি প্রজাতির কাঠঠোকরারা দেখা মেলে, যার মধ্যে ২১টি স্থায়ী এবং ০১টি পরিযায়ী। অস্ট্রেলিয়া, নিউ গিনি, নিউজিল্যান্ড, মাদাগাস্কার ছাড়া পৃথিবীর প্রায় সব অঞ্চলেই কাঠঠোকরা দেখা যায়। গাছাপালাহীন উত্তপ্ত মরুভূমিতে এবং পাথুরে এলাকায় এদের খুব বেশি দেখা যায় না। সচরাচর তৃণভূমি, বৃক্ষবেষ্টিত অঞ্চলে এদের বিচরণ।
সবচেয়ে ছোটো আকারের কাঠঠোকরা দৈর্ঘ্যে ৭.৫ সেন্টিমিটার এবং সবচেয়ে বড়ো প্রজাতির কাঠঠোকরা দৈর্ঘ্যে ৫০ সেন্টিমিটার পর্যন্ত হতে পারে। ধারণা করা হয় অধুনা বিলুপ্ত ওসঢ়বৎরধষ প্রজাতির কাঠঠোকরারা ছিলো আকারে সবচেয়ে বড়ো। এরা দৈর্ঘ্যে প্রায় ৫৫-৬১ সেন্টিমিটার পর্যন্ত ছিলো। বর্তমানে জীবিত প্রজাতিগুলোর মধ্যে এৎবধঃ ঝষধঃু কাঠঠোকরাগুলো আকারে সবচেয়ে বড়ো। এরা দৈর্ঘ্যে প্রায় ৪৫-৫৫ সেন্টিমিটার পর্যন্ত হয়ে থাকে এবং এদের ওজন ৪৩০ গ্রাম থেকে ৫৬৩ গ্রাম পর্যন্ত হয়।
কাঠঠোকরার পালকের রং প্রজাতিভেদে ভিন্ন হয়। অনেক প্রজাতির রং কালো বা কালো-সাদার সমন্বয়ে গঠিত, কোনো কোনো প্রজাতি জলপাই রঙের। তবে, বেশিরভাগ প্রজাতিতেই দুই-তিনটা রঙের শৈলী দেখা যায়। অনেক প্রাজাতির গায়ে সাদার উপর কালো বা বাদামি ছোপছোপ দাগ থাকে যা এদের ছদ্মবেশ ধরতে সাহায্য করে। অনেক প্রজাতির মাথায় একটি রঙিন মুকুট থাকে কারো-বা আবার থাকে রঙিন পালক।
গাছের কা-ে আঁকড়ে ধরার সুবিধার জন্য কাঠঠোকরার পায়ের নখের বিন্যাস বিশেষভাবে সুগঠিত, যার ফলে গাছের কা- আঁকড়ে ধরতে এদের কোনো অসুবিধা হয় না। ঠোঁটের মতো এদের পা এবং নখও শক্তিশালী বলে খাড়া গাছের গায়েও এরা স্বাভাবিকভাবে হাঁটতে পারে।
সকল কাঠঠোকরার পায়ে চারটি আঙুল থাকলেও কালো-পিঠযুক্ত কাঠঠোকরা এবং আমেরিকান ও ইউরেশীয় কাঠঠোকরার পায়ে তিনটি করে আঙুল দেখা যায়।
কাঠঠোকারা পোকামাকড়, লার্ভা, নিম্প, পিপড়া এবং পিপড়ার ডিম খেয়ে জীবন ধারণ করে। এরা গাছের গায়ে লেগে থাকা কিংবা মৃত গাছের বাকলের নিচে থাকা বিভিন্ন পোকামাকড় খেয়ে থাকে। বেশিরভাগ সময় দেখা যায়, কাঠঠোকরা মৃত গাছের গায়ে গর্ত করছে। মারা যাওয়ার পরে গাছে বিভিন্ন রকম পোকামাকড় বাসা বাঁধে। বিশেষ করে উঁইপোকা, ঘুনপোকা বা উলুপোকা গাছের গায়ের বাকলের নিছে বাসা করে। কাঠঠোকরা তার ধারালো লম্বা ঠোঁট দিয়ে গাছের গায়ে আঘাত করে পঁচা বাকল ফেলে দিয়ে সেইসব পোকা খায়। মাঝে মাঝে এদের মাটিতে পড়ে থাকা মৃত গাছ ও আবর্জনা হতে পোকা ধরে খেতেও দেখা যায়।
কাঠঠোকরার ঠোঁট ধারালো ও লম্বা কিন্তু ঠেঁটের চেয়েও অনেক লম্বা এদের জিহ্বা। কাঠঠোকারার জিহ্বা লম্বায় এদের শরীরের ধৈর্ঘ্যরে চেয়ে এক তৃতীয়াংশ পর্যন্ত বড়ো হতে পারে। তবে, সব কাঠঠোকরার জিহ্বার দৈর্ঘ্য সমান বড়ো হয় না। প্রজাতিভেদে জিভের দৈর্ঘ্য কম বেশি হয়। এৎববহ ড়িড়ফঢ়বপশবৎ নামক কাঠঠোকরার জিহ্বার দৈর্ঘ্য অন্যসব কাঠঠোকরার ছেয়ে বড়ো। তবে, উত্তর আমেরিকার নর্দান ফ্লিকার [ঘড়ৎঃযবৎহ ঋষরপশবৎ] তার লম্বা জিহ্বার জন্য বিশ্বে সেরা। মূলত গর্ত থেকে পোকামাকড় বের করে আনার জন্যই এদের এত লম্বা জিহ্বার প্রয়োজন পড়ে। কাঠঠোকরার মস্তিষ্কের হাঁড় এমনভাবে গঠিত যে, এরা অনবরত গাছের গায়ে ঠোকর দিতে পারে। প্রতিনিয়ত আঘাত করার পরেও বিপরীতমুখি আঘাতে এদের মস্তিষ্কের কোনো ক্ষতি হয় না। এরা দিনে বারো হাজার বার ঠোঁট দিয়ে আঘাত করতে পারে।
কাঠঠোকরা দেখতে বেশ সুন্দর। এদের বাহারি রং যে-কারোরই নজর কাড়তে সক্ষম। এরা নিজেদের পছন্দমতো বাসা বানায়। বিভিন্ন গাছের গায়ে কিংবা একই গাছে অনেক গর্ত করে কিন্তু সব গর্তে তারা বাসা বাঁধে না। বাসার নিরাপত্তা, আকার-আকৃতি তাদের পছন্দ না হলে তারা সেই গর্তে বাস করে না। আবার একই গর্তে একবারের বেশি বাসা বানায় না। অর্থাৎ এরা প্রতিবছর বাসা বদল করে। আর এদের পরিত্যাক্ত গর্তেই টিয়া, শালিক-সহ অন্যান্য পাখি বাসা বাঁধে।
কাঠঠোকরাই একমাত্র প্রাণী যারা নিজেদের গলা দিয়ে কোনো শব্দ উচ্চারণ না-করে ঠোঁট দিয়ে শব্দ করে। কাঠঠোকরা শুধু খাবারের অন্বেষণে গাছের গায়ে আঘাত করে না, কখনো কখনো এরা শব্দ তৈরির জন্যও আঘাত করে। এই শব্দটা তারা বিভিন্ন উদ্দেশ্যে করে থাকে। তবে, মূল উদ্দেশ্য যোগাযোগ করা। অন্য পাখিরা শিস দিয় বা কণ্ঠ দিয়ে ধ্বনি উচ্চারণ করে ডাকাডাকি করে। কাঠঠোকরা তা পারে না। তাই তারা আনন্দ প্রকাশ করার জন্য, সঙ্গীদের আকৃষ্ট করার জন্য কিংবা যোগাযোগের জন্য গাছের গায়ে আঘাত করে শব্দ সৃষ্টি করে।
লেখা : শ্যামল কায়া