আত্মবিশ্বাসই মহসিনার চালিকা শক্তি

28 Jul 2024, 01:18 PM রঙ্গশালা শেয়ার:
আত্মবিশ্বাসই মহসিনার চালিকা শক্তি

ঢাকার মঞ্চে মহসিনা এখন এক সুপরিচিত নাম। মহসিনা অভিনীত নাটক মানেই ভিন্ন কিছু। রিজওয়ান, জীবন ও রাজনৈতিক বাস্তবতা, মন্ত্রাস, বিস্ময়কর সবকিছু, আমি বীরাঙ্গনা বলছি- এই প্রযোজনাগুলো দিয়ে মহসিনা দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন দর্শকদের, নাট্যবন্ধুদের আড্ডায় আলোচনার বা তর্ক-বিতর্কের ঝড় তুলেছেন। অভিনয়ের পাশাপাশি মঞ্চের পেছনেও মহসিনা কাজ করেছেন বিস্তর। নির্দেশনা, মঞ্চপরিকল্পনা, আলোক পরিকল্পনা, পোশাক-পরিকল্পনা ছাড়াও নির্দেশকের সহযোগী এবং ড্রামাটারগিজ হিসেবেও তার কাজের তালিকা নিতান্ত কম নয়। ২০০৫ থেকে ২০২৪- এই সুদীর্ঘ ১৯ বছরে কাজের পরিধি ক্রমাগত বেড়েই চলেছে। আর এভাবেই ক্রমাগত নিজেকে ছাড়িয়ে মহসিনা হয়ে উঠছেন মঞ্চের গুরুত্বপুর্ণ এক ব্যক্তিত্ব।

বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালীন থেকে নানা প্রযোজনায় অভিনয় করলেও, ২০১৭-তে ‘রিজওয়ান’ প্রযোজনার মধ্য দিয়ে মহসিনার ঘটা করে প্রথম দর্শকের সামনে আসা। টানা দশদিনের প্রতিদিন দু’টি করে প্রদর্শনীর যেকোনো একটিও যারা দেখেছেন তাদের এই নাট্যাভিজ্ঞতা স্মরণীয় হয়েই থাকার কথা। মহসিনা এই নাটকের অন্যতম প্রধান অভিনেতাই শুধু নন, ছিলেন এই প্রযোজনার সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত একজন। প্রযোজনাটিকে অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছে দিতে নির্দেশকের ভাবনা-চিন্তাকে বিচার বিশ্লেষণ করে, নিজের অভিমত জানিয়ে, প্রয়োজনীয় গবেষণা, সম্পাদনা প্রভৃতি দায়িত্ব পালন করে প্রযোজনাটিকে দর্শকের কাছে উপস্থাপন করতে নির্দেশনা সহকারী হিসেবে কাজ  করেছেন। তবে আঙ্গিক ও বাচিক অভিনয় দিয়ে সমালোচকদের যে সন্তুষ্ট করতে পেরেছেন সেবার তা হয়ত বলা যাবে না। নানা সমালোচনায় মন খারাপ হয়েছিল তার ভীষণ। আবার ‘আত্মবিশ্বাসী ছিলেন না মহসিনা’- সমালোচকের এরকম কোনো অভিমতের সঙ্গে একমতও নন তিনি। দৃঢ়তার সঙ্গে একথা জানান যিনি- তার অতীতটা একটু পরিভ্রমণ করে আসা যাক এবার। 

ঢাকা শহর থেকে একটু দূরে টাঙ্গাইলের মফস্বল শহর সাবালিয়ায় সাদামাটা, সহজ-সরল ছেলেবেলা কেটেছে তার। যখন যা খুশি তাই করতে পারার ওই শৈশবে বাবা-মায়ের শাসন থাকলেও বাধা-নিষেধ তেমন ছিল না। ডাংগুলি, মাছ ধরা, গাছ বেয়ে ফল পেড়ে খাওয়াÑ যেন রবীন্দ্রনাথের মৃন্ময়ী। পাড়ার ছেলে-বুড়ো-খালাম্মাÑ সব বয়সী মানুষের সাথেই তার বিস্তর ভাব। তাদের সঙ্গে থেকে তাদের জীবনের গল্পগুলো শুনতে শুনতেই কেটে যেত বেলা। এ পাড়ায় পরোপকারী হিসেবে খ্যাতিরও কমতি ছিল না। কারো কোনো অভাবে, অভিযোগে, কিছু জুগিয়ে দিতে, পথের সঙ্গী হতে তার ডাক পড়বে কি নিজেই আগ বাড়িয়ে চলে যেতেন সহমর্মিতার হাত বাড়িয়ে। ততদিনে আঙুলের কড়ায় বয়স কিছু বাড়লেও নিজের হ্যাংলা শরীর আর সহজ-সরল মানসিকতার জন্য শিশুসুলভই থেকে গেছেন বহুদিন। আর এতে করে শৈশবটা প্রলম্বিতই হয়েছিল তার। বন-বাদাড়ে নির্মল, ছন্দোময় প্রকৃতির সঙ্গে থেকে সহজ ও সুন্দরের শিক্ষা নেওয়ার সুযোগও মিলেছে মেলাদিন। এসবের মধ্যে স্কুলে যেতে হলেও সেখানেও যতভাবে আনন্দ করে সময় পার করা যায় ! বাড়ির পরিবেশও ছিল সাংস্কৃতিক। মামারা গান করতেন, বাবা অভিনয় করতেন একসময়, শুনেছেন। মায়ের কাছে জেনেছেন যে, বাবা-মায়ের বিয়ের দিনে বাবা কোনোমতে বিয়েটা করেই শো করতে চলে গিয়েছিলেন, ফিরেছিলেন সেই মধ্যরাতে। তিনি স্কুলে ছাত্রদের ইংরেজি পড়াতেন, আইনবিদ্যা পাশ করে আইন পেশাতেই যুক্ত হয়ে পড়েছিলেন। তো এমন পরিবারে মহসিনা যখন বড়ো হচ্ছেন, কখনো হারমোনিয়াম বাজিয়ে গান গাওয়ার চেষ্টা করছেন, কখনো ছড়া-কবিতা মুখস্থ করে আবৃত্তি, কখনো-সখনো কৌতুকাভিনেতা সেজে মানুষকে হাসিয়ে পেটে খিল ধরিয়ে দিচ্ছেন। স্কুলের বাৎসরিক নাটকগুলোতেও তার অংশগ্রহণ করা চাই। বাবার পাঞ্জাবি-পাজামা পরে গোঁফ দাড়ি লাগিয়ে ছেলেদের চরিত্রে অভিনয় করতে নেমে যেতেন। মহসিনা বলেন- ‘পড়ালেখার চেয়ে এসবই করতাম বেশি।’ বাড়িতে রেডিও- টেলিভিশন চলত সারাক্ষণই। গান শোনা হতো খুব। কবীর সুমন, ভূপেন হাজারিকা, নচিকেতার গান শুনেই যেন প্রথম নাগরিক বা মানুষ হিসেবে সমাজের প্রতি দায়িত্ববোধ জেগে ওঠে মনে। বইপত্রের সঙ্গে কোনো ভাবের আদান-প্রদান ততদিনেও তেমন হয়ে উঠতে পারল না। কিন্তু একাদশ শ্রেণিতে পড়ার সময় বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের বইপড়া কর্মসূচির কল্যাণে বেশ কিছু বই পড়া হয়ে গেল তার। মোপাসাঁ, কৃষণ চন্দর, শওকত ওসমান, গোগল, তারাশঙ্কর, প্লেটোতে এতই মনোযোগ টানলো যে, বই পড়ে আর সব প্রশ্নের যথাযথ উত্তর লিখে পুরস্কার হিসেবে আরো বইও ঘরে তুলে আনলেন সেবার।

বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায় চান্স পেয়ে ভর্তি হলেন ‘সংগীত ও নাট্যকলা’ বিভাগে। সেটাও যে জেনে বুঝে তা নয়। মনে হলো ‘ওটা’র চেয়ে বরং ‘এটা’তে ভর্তি হই। তো পড়তে এসে টেক্সট বোঝার জন্যই পড়ে ফেলতে লাগলেন ইতিহাস ও দর্শন সম্পর্কিত লেখাজোখা এর ওর কাছ থেকে জোগাড় করে। দুই বিশ্বযুদ্ধ কি বাইবেল, ভাই-এর কাছ থেকে ধার করে আনলেন নিৎশে- এভাবেই টেক্সট সম্পৃক্ত বইপত্র ঘাটাঘাটি করতে করতে আবিষ্কার করলেন ‘পড়াশোনা তো আসলে জীবনের সাথে সম্পৃক্ত’। এভাবে জীবনের সাথে সম্পর্ক খুঁজে পেতে পেতে পড়াশোনা হয়ে উঠল মহসিনার জীবনসঙ্গী। স্নাতক পরীক্ষায় তার ফলাফলটাও পেলেন হাতেনাতে- ‘প্রথম শ্রেণিতে প্রথম’। এরপর স্নাতকোত্তর পর্বও শেষ হয়ে এল ২০১২-তে। মহসিনা বলেন- “নাট্যকলায় পড়তে এসে সবার আগে শিখেছি ‘এটিকেট’- আচার আচরণ, ভদ্রতা। অর্থাৎ কার কোন বিষয়ে হাসা উচিত, আর কোনটায় হাসা উচিত না।” এভাবে ধীরে ধীরে দায়িত্ববোধ জন্ম নিতে থাকল তার। আনন্দময় শৈশব-কৈশোর ছেড়ে বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে এসে যা কিছু নতুন দেখেন-শোনেন-শেখেন, সবই সাদা কাগজের মতো মনে লেখা হয়ে যেতে থাকল স্পষ্টাক্ষরে।

বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়াশোনা শেষে বছর তিনেক বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলায় ঘুরে ঘুরে বিভিন্ন নাট্যদলে নির্দেশনা ও প্রশিক্ষণ দেওয়ার কাজটাও খুব উপভোগ করতে থাকলেন। শব্দাবলি থিয়েটারে ‘ওয়েটিং ফর লেফটি’ নাটকের রূপান্তর ‘প্রতীক্ষা’, নাট্যজন-এর শেষরক্ষা নাটকগুলোর আলো ও পোশাক পরিকল্পনা আর নির্দেশনার কাজটি করেন তখন আগ্রহভরে।

২০১৫-তে নির্দেশনায় উচ্চতর পড়াশোনার জন্য পাড়ি জমান মস্কোর ‘রাশান ইনস্টিটিউট অব থিয়েটার আর্টস’ স্কুলে। তখন থেকেই মাথায় ঘুরছিল অভিষেক মজুমদারের লেখা ও ঋদ্বিবেশ ভট্টাচার্যের বাংলা অনুবাদে ‘রিজওয়ান’ নাটকটি এবং মনে-প্রাণে চাইছিলেন সৈয়দ জামিল আহমেদ যেন এই নাটকটি নির্দেশনা দেন। এবং সত্যি তাই হলো- আড়াই-তিনমাস ধরে নির্দেশকের সঙ্গে সহকারী নির্দেশক হয়ে, মহড়া করে প্রযোজনাটিকে একটি মানে পৌঁছে দিতে যথেষ্ট পরিশ্রম করলেন। অবশেষে নাটবাংলার আয়োজনে মঞ্চায়িত হলো ‘রিজওয়ান’ আর ঢাকাবাসী দেখতে পেল মঞ্চজগতে নতুন এক প্রাণ, আনকোড়া, পরিশ্রমী আর একনিষ্ঠ এক কর্মীকে যার নাট্যক্রিয়া বিস্মিত করেছিল ঢাকার দর্শক অনুভূতিকে। আর চিরপ্রথা অনুযায়ী এই ‘নতুন’ হয়ে উঠেছিল আলোচিত এবং সমালোচিতও। দর্শকের এই মিশ্র প্রতিক্রিয়ায় থিতু হতে কিছুটা সময় যে তার লাগেনি তা নয়, তবে সমালোচনার বিষয়ে মহসিনাও তৈরি এখন। বলেন, “দর্শকের সামনে এসে এই শিক্ষাই পাই যে, আলোচনা কিংবা সমালোচনায় গা ভাসিয়ে দেওয়া চলবে না। তাই ভেসেও যাই না, মনও খারাপ করি না এখন। ব্যক্তি যখন দর্শকের মুখোমুখি তখন নানা দর্শকের নানারকম প্রতিক্রিয়া থাকবেই। সব কিছু গ্রহণ করাও যাবে না, বাদও দেওয়া যাবে না। তবে নিজের বাধাগুলো পরবর্তী প্রযোজনাতে কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা করি সবসময়।” আর মহসিনা এটাই মনে করেন যে, এই আলোচনা-সমালোচনা তার চলার ক্ষিপ্র গতিকে সামনের দিকে আরো ধাবিত করতেই যেন শক্তি জোগায়।

সামনের দিনে কী ইচ্ছা মহসিনার ? এরকম প্রশ্নে মহসিনা জানানÑ “নাটকের মাধ্যমে ব্যক্তির সঙ্গে যোগাযোগ ঘটাতে চাই। প্রত্যেকটা দর্শকের ভিতরে যেন বোঝাপড়া তৈরি হয়।” যেমন ‘৪.৪৮ মন্ত্রাস’ নাটকটি দেখে একজন দর্শক জানিয়েছেনÑ ওই মুহূর্তে তিনি প্রচ- ডিপ্রেশনে ভুগছিলেন এবং জীবনের প্রতি সমস্ত মায়া হারিয়েও ফেলেছিলেন। নাটকটা তাকে জীবনের দিকে আবার ফিরিয়ে আনতে সাহায্য করে। কেউ কেউ মনে সাহস পেতে ‘বিস্ময়কর সবকিছু’ নাটকের সবগুলো প্রদর্শনীই দেখেছেন। মহসিনা মনে করেন, এটাই তার সবচেয়ে বড়ো পুরস্কার। “ব্যক্তির জীবনে পজিটিভ পরিবর্তনটা আনতে পারছে নাটক- থিয়েটার করার পেছনে আগ্রহের এটাই এখন আমার সবচেয়ে বড়ো কারণ।” এই বলে থামলেন মহসিনা আক্তার। শেষ বিকেলের আলোয় তখন মহসিনার চোখে মুখে আত্মবিশ্বাস খেলে যায়। 

লেখা : ইভা আফরোজ খান


অভিনীত নাটক


ওল্ড টাইমস [২০০৫] লেখা : হ্যারল্ড পিন্টার, নির্দেশনা : ফরহাদ হাসান

ফেইড্রা [২০০৬] লেখা : জঁ বাতিস্ত রাসিন, নির্দেশনা : কোয়েলা শারমিন

দ্য ম্যারিজ প্রপোজাল [২০০৬] লেখা : আন্তন চেখভ, নির্দেশনা : মানব সরকার

সাহাজাহান [২০০৮] লেখা : দিজেন্দ্রলাল রায়, নির্দেশনা : সুদীপ চক্রবর্তী

বুনোহাঁস [২০০৯] লেখা : হেনরিক ইবসেন, নির্দেশনা : আহমেদুল কবির

কমলা রানি সাগর দীঘি [২০১১] সম্পাদনা : ক্ষিতীশ চন্দ্র মৌলিক, নির্দেশনা : সাইদুর রহমান

দ্য কোরাস গাল [২০১৬] লেখা : আন্তন চেখভ, নির্দেশনা মহসিনা আক্তার

রিজওয়ান [২০১৭] লেখা অভিষেক মজুমদার, অনুবাদ : ঋদ্বিবেশ ভট্টাচার্য, নির্দেশনা : সৈয়দ জামিল আহমেদ

জীবন ও রাজনৈতিক বাস্তবতা [ ২০১৯] লেখা : শহীদুল জহির, নির্দেশনা : সৈয়দ জামিল আহমেদ

৪.৪৮ মন্ত্রাস [২০২০] লেখা : সারা কেইন, অনুবাদ : শাহমান মৈশান ও শরীফ সিরাজ, নির্দেশনা : সৈয়দ জামিল আহমেদ

বিস্ময়কর সবকিছু [২০২১] লেখা : ডানকান ম্যাকমিলান, অনুবাদ ও রূপান্তর : সৈয়দ জামিল আহমেদ

আমি বীরাঙ্গনা বলছি [২০২৩] লেখা : ড. নীলিমা ইব্রাহিম, মঞ্চসজ্জা, আলো, সংগীত ও নির্দেশনা : সৈয়দ জামিল আহমেদ


চলচ্চিত্র

জয়া ও শারমিন [২০২০]

পরিচালনা : পিপলু আর খান [মুক্তির প্রতীক্ষায়]

অন্যান্য

নির্দেশিত নাটক : ৪টি ॥ সহযোগী নির্দেশক : ৩টি ॥ মঞ্চপরিকল্পনা : ৬টি নাটক ॥ পোশাক পরিকল্পনা : ১৬টি নাটক ॥ আলোক পরিকল্পনা : ৪টি নাটক ॥ ড্রামাটার্গ : ৩টি নাটক।