আবৃত্তি আর অভিনয় এক নয় ; সূক্ষ্ম একটা পার্থক্য আছে -মেহেদী হাসান

09 Feb 2021, 02:06 PM আবৃত্তি শেয়ার:
আবৃত্তি আর অভিনয় এক নয় ; সূক্ষ্ম একটা পার্থক্য আছে -মেহেদী হাসান

কণ্ঠের মাধুর্যে যিনি জয় করেছেন হাজার হাজার মানুষের হৃদয়। এক সময় তিনি ছিলেন বিটিভি অনুষ্ঠানের ঘোষক। নব্বইয়ের দশকে তার আবৃত্তির অ্যালবাম ‘মিথিলা’ বিক্রি হয় ঝড়ের গতিতে, ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায় তার ‘তৃষিত তিমির’, ‘নীলখাম’সহ বেশ কিছু আবৃত্তির অ্যালবাম। জনপ্রিয় এই আবৃত্তি শিল্পী এবার আনন্দভুবনের সঙ্গে আড্ডায় মেতেছিলেন ...


আনন্দভুবন : আপনার বর্তমান কাজ নিয়ে বলুন-

মেহেদী হাসান : সারাপৃথিবীর মানুষ এখন করোনা পরিস্থিতির কাছে বন্দি। তবে এই সময়টাতে আবৃত্তি শিল্পে একটা বিপ্লব ঘটে গেছে। সেটা হচ্ছে, অনলাইন প্লাটফর্মের মাধ্যমে আবৃত্তি শিল্পীরা নানা ধরনের কাজের সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন। কবিতা আবৃত্তির আয়োজন এবং প্রচারের কাজগুলো তারা করেছেন। আমিও প্রথমদিকে শুরু করেছিলাম। অনলাইনে আমার ফেসবুক পেজে বেশকিছু লাইভ প্রোগ্রাম করেছি। দেশে-বিদেশে বিভিন্ন আমন্ত্রণে অনলাইনের অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করেছি। আমার সংগঠন প্রমিত ধারা থেকেও প্রতি সপ্তাহে একটি করে অবৃত্তি অনুষ্ঠান হয়েছে। বিভাগীয় শহর, জেলা শহর জাতীয় পর্যায়ের আবৃত্তিশিল্পীদের নিয়ে এই আয়োজনগুলো হয়েছে। অনলাইন আবৃত্তির মাধ্যমে আমি নিজেকে রিফ্রেস করেছি, আমার ভক্তশ্রোতাদেরও রিফ্রেসমেন্ট করার চেষ্টা করেছি। তাদের সচেতনতা বাড়ানোর চেষ্টা করেছি। আমার মনে হয় বাংলাদেশের অনেক আবৃত্তি শিল্পী এর সঙ্গে যুক্ত ছিলেন।

আনন্দভুবন : আপনার সংগঠনের বর্তমান কাজ নিয়ে বলুন-

মেহেদী হাসান : আমাদের পরিকল্পনা ছিল ২০২০ সালে বেশ কিছু অনুষ্ঠান করব। কিন্তু করোনার কারণে করতে পারিনি। আমরা অনলাইনে আমাদের সংগঠনের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী পালন করেছি। আমার সংগঠনের চার বছর বয়স হয়েছে। আমাদের সংগঠন শুধু আবৃত্তির জন্য নয়, এটি একটি সাংস্কৃতিক সংগঠন। বিভিন্ন ধরনের কাজের পরিকল্পনা নিয়ে আমরা সংগঠনটি করেছি। বেশ কিছু অনুষ্ঠান আমরা করেছি। কিন্তু গত বছর নিরাপত্তার কথা ভেবে কোনো অনুষ্ঠান করা হয়নি। আশা করছি করোনা পরিস্থিতির উন্নয়ন হলে সামনে আরো কিছু কাজ নিয়ে আসতে পারব।

আনন্দভুবন : এর আগে কোন সংগঠনে কাজ করতেন ?

মেহেদী হাসান : আমার সংগঠনের চর্চা আসলে হয়ে ওঠেনি। নব্বইয়ের দশকে আমি যখন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ি তখন আমি এবং শিমুল মুস্তফা মিলে একটা সংগঠন তৈরির পরিকল্পনা করি। সংগঠনের নাম নির্ধারণ করি ‘বৈকুণ্ঠ’। যেকোনো কারণে পরে আর সংগঠনটি হয়নি। তিন-চার বছর পরে শিমুল ভাই আবার ‘বৈকুণ্ঠ’ নিয়ে কাজ শুরু করেন। আমি মনে করি, আবৃত্তি একটি একক চর্চার শিল্প মাধ্যম। তার পরেও আমরা সাংগঠনিক চর্চা করছি নতুন কিছু ছাত্র শিক্ষানবিশ তৈরি করার লক্ষ্যে। আমি পেশাগতভাবে ব্যস্ত থাকার কারণেও সাংগঠনিক চর্চা হয়নি। কারণ, আমি যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র তখন থেকেই বিটিভিতে তালিকাভুক্ত হই। এবং বিটিভির অনুষ্ঠানের ঘোষক হিসেবে কাজ শুরু করি। বিটিভিতে ১২ বছর ঘোষক হিসেবে কাজ করেছি।

আনন্দভুবন : আপনার তো অনেক জনপ্রিয় অ্যালবাম আছে ।

মেহেদী হাসান : আমার ২৬টি আবৃত্তির অ্যালবাম প্রকাশ হয়েছে। আমার প্রথম অ্যালবাম ‘তৃষিত তিমির’, দ্বিতীয় অ্যালবাম ‘নীলখাম’ তার পরে আসে ‘মিথিলা’। এই অ্যালবামটি ব্যাপক জনপ্রিয়তার কারণে পরে ‘মিথিলা’র দ্বিতীয় ও তৃতীয় খণ্ড প্রকাশ হয়। শুনেছি মিথিলার ৩৮ লাখের মতো কপি বিক্রি হয়েছে তখন। মিথিলা একটি অদ্ভুত গল্প। মিথিলার গল্প-ভাবনা ছিল আমার আর কবিতাগুলো আবুল হোসেন খোকনের। আবুল হোসেন খোকন তখন টিএসসিতে আসত। আমরাও তখন টিএসসিতে আড্ডা দিতাম। তার সঙ্গে পরিচয় হয়। তিনি লেখালেখি করতেন। একটা কবিতা একদিন আমাকে দিলেন। কবিতার নাম ছিল ‘সক্রেটিস’। কবিতাটা পড়ে আমার দারুণ ভালো লাগল। সক্রেটিস কবিতাটি আমার প্রথম অ্যালবামে আবৃত্তি করি এবং এটি খুব শ্রোতাপ্রিয়তা পায়। আমার মাথায় তখন একটা বুদ্ধি এল। আমরা তখন মানুষকে কবিতা শোনাতে চাই। সবাই বলত কবিতা জটিল বিষয়, ভারি বিষয় বুঝি না। তখন আমার ভাবনা এল কীভাবে মানুষকে আরো বেশি কবিতা শোনাতে পারি। এই ভাবনা থেকেই ‘মিথিলা’র জন্ম। গল্পের ভেতর দিয়ে কবিতা বলার চেষ্টা করেছি। অনেক তাগাদা দিয়ে জোর করে আবুল হোসেন খোকনের কাছ থেকে লেখা আদায় করি। আবুল হোসেন তার ‘কষ্টবিলাস’ গ্রন্থের কবিতা এবং আরো কিছু নতুন কবিতা এবং সংলাপ আমার গল্পের সঙ্গে যুক্ত করে পাণ্ডুলিপি লেখে। ‘মিথিলা’ আসলে এক খণ্ডই হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু এত জনপ্রিয়তা পেয়েছিল যে সবার আগ্রহে দ্বিতীয় ও তৃতীয় খণ্ড প্রকাশ হয়।

আনন্দভুবন : মিথিলা নিয়ে সিনেমা হওয়ার কথা ছিল ?

মেহেদী হাসান : মিথিলা নিয়ে সিনেমা হওয়ার পরিকল্পনা চলছিল। প্রযোজকও ছিল। পরে আর কোনো কারণে সেটা হয়নি। যদিও মিথিলার কপিরাইট আমার তবে কেউ যদি ‘মিথিলা’ নিয়ে সিনেমা বানাতে চায় সেটাতে কোনো নিষেধাজ্ঞা নেই। আমি যথাসাধ্য সহযোগিতা করব।

আনন্দভুবন : নতুন নতুন প্রযুক্তির সুবাদে অনেক কিছুতেই পরিবর্তন এসেছে। আবৃত্তিতে কোনো পরিবর্তন এসেছে ?

মেহেদী হাসান : আবৃত্তিতে অনেক পরিবর্তন এসেছে। আমাদের সময় ৫০০ আবৃত্তির ক্যাসেট বিক্রি হওয়া ছিল বিশাল কিছু। এখন মিলিয়ন মিলিয়ন ভিউয়ার্স হচ্ছে। আগে আমরা ক্যাসেটে, সিডিতে গান আবৃত্তি শুনতাম। এখন ইউটিউবে শুনছি। মাধ্যমের যেমন পরিবর্তন হয়েছে তেমনি এর পরিবেশনেও পরিবর্তন এসেছে। আগে যারা আবৃত্তি করতেন সেখানে আবহসংগীত ছিল না। আমরা যখন আবহসংগীত যুক্ত করে কাজ শুরু করলাম তখন সমালোচকেরা আমাদের অনেক সমালোচনা করত। তারা বলত, আবৃত্তিতে কেন আবহসংগীত থাকবে ? আবৃত্তি হবে খালি গলায়। শুধু ভিডিওগ্রাফিতেই না কণ্ঠ প্রক্ষেপণেও অনেক পরিবর্তন এসেছে। কণ্ঠের জায়গাটি ভিন্ন ভিন্ন প্রয়োগে যে মাধুর্য আনা যায় সেটা এই সময়ে যারা আবৃত্তি করছে তারা দেখাচ্ছে। তবে একটু সাবধানও থাকা দরকার। কারণ, আবৃত্তি আর অভিনয় এক নয় ; খুব সূ² একটা পার্থক্য আছে। বাংলা ভাষাতেই একমাত্র আবৃত্তির চর্চা হয়। তাই আবৃত্তি আর শ্রুতিনাটকের মধ্যে যে পার্থক্য আছে সেটা যদি আমরা নির্ণয় করতে না পারি, তাহলে আবৃত্তি যে আলাদা একটা শিল্প সেটা প্রতিষ্ঠা পাবে না।

আনন্দভুবন : নতুনদের উদ্দেশ্যে কিছু বলুন ?

মেহেদী হাসান : আমাদের সময় একটি আবৃত্তি নিয়ে দর্শক শ্রোতার সামনে আসতে অনেক সময় নিতে হয়েছে, অনেক অনুশীলন করতে হয়েছে। নিজেকে তৈরি করতে হয়েছে। এখন অনেক মাধ্যম এসেছে। সেগুলো সহজলভ্য হওয়ায় যে কেউ এখন সেগুলোতে আবৃত্তি প্রকাশ করতে পারছে। এটা সখের বশে অনেকেই করতে পারেন। কিন্তু কেউ যদি কমিটেড থাকে যে এই শিল্পটা নিয়ে কাজ করবে, তাহলে নিজেকে তৈরি করতে হবে। তাকে প্রচুর পড়তে হবে, কবিতার ভাব রস বুঝতে হবে, কণ্ঠ তৈরি করতে হবে, উচ্চারণ শিখতে হবে, ছন্দ সম্পর্কে ধারণা নিতে হবে। কেউ যত সুদর্শনই হোক, যত বড়ো সংগঠনের নেতাই হোক, যত ভালো কণ্ঠের অধিকারীই হোক শিল্পের দেবতাকে তুষ্ট করতে না পারলে দর্শকের হৃদয় স্পর্শ করা যাবে না। টিকে থাকবে সেটাই যেটা প্রকৃত শিল্প। 

সাক্ষাৎকার : নিথর মাহবুব