কাজী রোকসানা রুমা- থিয়েটার যার প্রতিবাদের ভাষা

30 May 2024, 01:27 PM রঙ্গশালা শেয়ার:
কাজী রোকসানা রুমা-  থিয়েটার যার প্রতিবাদের ভাষা

প্রচণ্ড তাপদাহে যখন পুড়ছে দেশ, মানুষের প্রাণ ত্রাহি ত্রাহি অবস্থা। দোকানগুলোতে শীতাতপ যন্ত্রের সংকট- বিক্রি হয়ে গেছে সব। তরমুজের দাম আবার বাড়তি, এই এপ্রিলেই তাপমাত্রা ৪২ ! প্রাকৃতিক নাকি কৃত্রিম বৃষ্টি- কে করবে মুশকিল আসান- ধর্ম নাকি বিজ্ঞান- এই নিয়ে তর্কের ঝড়। বিদ্যায়তন বন্ধ সরকারি নোটিশে, এসব তোলপাড় করা খবর দেখতে দেখতে নিজেই যখন ঘর্মাক্ত তখন ফেসবুকে টুক করে চোখে পড়ে যায় কাজী রোকসানা রুমার ছোট্টো কোনো আকুতি- “আপনার বাসার ব্যালকনিতে পাখিদের জন্য একটা বাটিতে পানি রাখবেন ? ওরা কেমন হা হয়ে থাকে তৃষ্ণায় !” একটি স্ট্যাটাসেই স্বরূপে ধরা দেন কাজী রোকসানা রুমা।

সাক্ষাতের সুযোগে এবার সরাসরিই প্রশ্ন করে ফেলি কাজী রোকসানা রুমাকে- এই গাছপালা, পোকামাকড়, পাখির প্রতি এত মমতা কোত্থেকে এলো ? জবাবে বলেন, “দেখুন, মানুষ হয়তো একটু বেশিই বুদ্ধি খাটাতে পারে, কিন্তু এই পৃথিবীতে মানুষ আর প্রাণের বেঁচে থাকার অধিকার সমান সমান। পৃথিবীটা কেবল মানুষের একার নয়।” হ্যাঁ, সে তো বটেই। রোকসানা রুমা বলে চলেন তার ছেলেবেলার গল্প। একই বাড়ির সীমানায় পেয়ারা, কুল, বকুল, নারকেল গাছেদের সঙ্গে টিয়া, ময়না, হাঁস, গোরু, ছাগল, মুরগি, কবুতর, বেজি, বিড়াল, কুকুর, সাদা ইঁদুরের ছিল সহাবস্থান। তাদের সাথেই তো কেটেছে ছোটো ছোটো দুঃখ-সুখের ছেলেবেলা। একইসঙ্গে খেলেছেন, কথা বলেছেন, শরীরের ওম বিনিময় করেছেন। বেড়ালটা তো কোলে কোলেই ঘেঁষত। বেজিটা বসে থাকতো বড়ো ভাইয়ের কাঁধে। আর বেজিটা যেদিন মরে গেল, ভাইয়ের সে কী কান্না! ভাইয়ের জন্য, বেজির জন্য দুখ-কষ্টে মাখামাখি হয়েই তো কেটেছে সেই শৈশব! আর এভাবেই প্রাণ-প্রকৃতির সঙ্গে ভাইবোনেরা মিলে একসাথে বড়ো হয়ে ওঠা ।

তাই চিন্তা থেকে বিস্মৃত হয়ে যায় না এই প্রাণিকুল কখনোই। যেই প্রাণের সাথে এই নগরে বা পৃথিবীতে আমাদের সহাবস্থান, তাদের নিয়ে ভাবতে আমাদের মাথায়ও হালকা টোকা দিয়ে যান রুমা প্রায়শই। স্ট্যাটাসে ব্যক্তিকেন্দ্রিকতা না, বরং প্রাণ-প্রকৃতি-নিপীড়িতের পাশে দাঁড়ানোর আহ্বান বরাবরই চোখে পড়ে আমাদের। দেশের আনাচে-কানাচে কোনো একটি ভালো খবর, একটা উদ্দীপনামূলক ছবি, কারো কোনো একটি ভালো প্রচেষ্টা- এসবকে জানান দিয়ে যান। নিউজ-ফিডে নিজের দলের নাটকের প্রচার যেমন থাকে, অন্য দলের নাটকের প্রচারেও সমোৎসাহে এগিয়ে আসেন। থিয়েটার অন্তঃপ্রাণ রুমা থিয়েটার প্রসঙ্গে আক্ষেপ নিয়েই বলেন একসময়- “সবাই যদি ‘আমরা’ হয়ে উঠতে পারতাম!” ‘আমার দল’, ‘আমি’- এভাবে দলগুলো আসলে বিছিন্ন। কোন মেকানিজমে ‘আমরা’ হয়ে ওঠা সম্ভব সেটা জানা নেই। তবে থিয়েটারের প্রচার-প্রসারের কাজগুলোও যদি সম্মিলিতভাবে একসাথে করা যেত! ”

রোকসানা রুমার থিয়েটারে আসাও এই বড়ো ভাই-বোনদের হাত ধরেই। ছেলেবেলা থেকেই খেলাধুলায় ছিলেন চ্যাম্পিয়ন। চাকতি নিক্ষেপ, বর্ষা নিক্ষেপ, সাইকেল চালানোয় তাকে টেক্কা দেওয়া ছিল দুরূহ। বিভাগীয় পর্যায়ে খেলতেন, ঢাকায় মহিলা ক্রীড়া সংস্থাতেও খেলতে আসতেন। বড়ো ভাই ছিলেন পিরোজপুর ছাত্র ইউনিয়নের সভাপতি। বড়ো ভাই ও বোনেরা নাটক করতেন। তাদের হাত ধরেই রাজনীতি ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনে কাজী রোকসানা রুমার সক্রিয় থাকা। উদীচী, খেলাঘর, ছাত্র ইউনিয়নের অনুষ্ঠানগুলোতে নিয়মিত গান করতেন। এভাবেই একদিন দশম শ্রেণিতে পড়াকালীন ‘ওরা কদম আলী’ নাটকের সরদার চরিত্রে অভিনয়ের মধ্য দিয়ে প্রথম অভিনয়ের অভিজ্ঞতা অর্জন। এরপর স্কুলের গণ্ডি পেরিয়ে কলেজে এসে বিতর্ক, একক অভিনয়, কবিতা আবৃত্তি, থিয়েটার সব কিছু মিলিয়ে কাজী রোকসানা রুমা ততদিনে সুপরিচিত এক নাম।

কাজী রোকসানা রুমার জন্ম ও বেড়ে ওঠা পিরোজপুর শহরে। উচ্চমাধ্যমিকের গণ্ডি ছাড়িয়ে ভর্তি হলেন সরকারি ব্রজমোহন কলেজে। প্রিয় বিষয় রাষ্ট্রবিজ্ঞানে সুযোগ পেয়েও বাবার আগ্রহে বিএ ডিগ্রি সম্পন্ন করেন। এরপর স্নাতকোত্তর করতে ভর্তি হলেন বাংলা এবং আইন বিভাগে। দিনে বাংলা, সন্ধ্যায় আইন- এভাবে কিছুদিন চলতে থাকল। কিন্তু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে নাট্যকলা ও সংগীত বিভাগে ভর্তির সুযোগ পেয়ে চলে এলেন ঢাকায়। তাত্ত্বিক ও পদ্ধতিগত অভিনয় সম্পর্কে পেলেন সম্যক ধারণা। মানবিক বোধের জায়গাগুলো তো তৈরি হয়েই ছিল বাল্যকাল থেকে কিন্তু থিয়েটার ফর ডেভেলপমেন্টের কোর্সটি পড়তে গিয়ে জীবনের লক্ষ্যটা যেন ধরতে পারলেন। সিদ্ধান্ত নিলেন পড়াশোনা শেষ করে এনজিওতে কাজ করবেন যেখানে সাধারণ মানুষের কাছে গিয়ে কাজ করার সুযোগ পাওয়া যাবে, মানুষের আচরণ, চিন্তা, নারী-পুরুষের ভূমিকাকে বদলে দেওয়া যাবে। তবে আফসোস করে বলেন এখন, ‘এনজিওগুলো থিয়েটার ফর ডেভেলপমেন্টের শক্তিটাকে আসলে কাজে লাগাতে পারেনি।’

১৯৯৯-২০০০-এর দিকে ঢাকায় সুবচন নাট্যদলে যোগ দিয়ে অভিনয় করেন শেক্সপীয়রের ‘টুুয়েলফথ নাইট’ নাটকে। কিন্তু চাকরির কারণে ছেড়ে দিতে হয় সুবচন এবং দীর্ঘদিন থিয়েটার থেকে দূরেও থাকতে হয়। এরপর প্রায় দশ বছর বিরতির পর বটতলায় ‘খনা’ নাটকে অভিনয়ের মধ্য দিয়ে আবারো থিয়েটার এবং বটতলার সঙ্গে যুক্ততা এবং সেই থেকে আজ-অবধি। ‘খনা’ নাটকে অভিনয় করা প্রসঙ্গে বলেন, “নাট্যকার ও খনা চরিত্রে অভিনয় করেন যিনি [ড. সামিনা লুৎফা নিত্রা] তখন পিএইচডি করতে বিদেশে। বটতলার একজন সদস্য জানতে চাইল খনা চরিত্রটি করবো কি না। তারপর স্ক্রিপ্ট পড়া, মুখস্থ করা, হাঁটা-চলা, কাজের মাঝে মাঝে সংলাপ আওড়ে যাওয়া এভাবে চলতে থাকলো এবং একসময় মনে হলো সম্ভব নয়। কিন্তু ততদিনে একমাস অতিবাহিত। পরে এক বন্ধুর মোটিভেশনে আবার খনা নিয়ে চেষ্টা চালিয়ে যাওয়া। সেই সময় এই নাটকের নাট্যকার সামিনা লুৎফা এবং নির্দেশক মোহাম্মদ আলী হায়দার দু’জনেই প্রবাসে এবং একদিন মহড়ায় এসে দাঁড়ালে দায়িত্বপ্রাপ্তরা বললেন, ‘কিছুই হয় নাই।’ অবশেষে কাঁদতে কাঁদতে বাড়ি ফেরা।” তারপরেও হাল ছাড়েননি, চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিলেন নিজের মতো। তবে, সমস্যা হচ্ছিল যে, রুমার মাঝে সবাই নিত্রাকেই দেখতে চাইছিল। এভাবেই চেষ্টা আর পরিশ্রমের মধ্য দিয়ে একসময় রুমার ‘খনা’ হয়ে ওঠা। এখন খনা চরিত্রে এই দু’জনেই অভিনয় করছেন।

কাজী রোকসানা রুমা বর্তমানে থিয়েটার দল বটতলার প্রধান নির্বাহী। দলের প্রায় সবক’টি নাটকেই অভিনয়ের পাশাপাশি সাংগঠনিক কাজ-কর্ম, নাটকের প্রচার-প্রসার নিয়ে সর্বক্ষণ থাকেন সক্রিয়। দেশের নানা ইস্যুতে বটতলার পথনাটকে যুক্ত থেকেছেন কখনো অভিনয়ে, লেখায়, কখনো নির্দেশক হিসেবে। বটতলা অ্যাকটর্স স্টুডিও এবং অন্যান্য দলের প্রশিক্ষক হিসেবে কাজ করেন। ভয়েস আর্টিস্ট হিসেবেও ডাবিং ও অডিও মাধ্যমে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছেন কাজী রোকসানা রুমা। নিজের প্রতিষ্ঠান ‘এইমস বাংলাদেশ’-এর জন্য তথ্যচিত্র বানানোর প্রকল্প নিয়ে দেশের আনাচে-কানাচে ঘুরে বেড়ান প্রায়ই।

“থিয়েটার ছাড়া আর কোনো ভাষা আমার জানা নেই”- অকপটে বলেন তিনি। “সক্রিয় রাজনীতি যেহেতু এখন করি না, চিৎকার করে রাস্তায় দাঁড়িয়ে যেহেতু কিছু বলতে পারি না, ছবি আঁকতে জানি না, রনবী-শিশির-কিশোরের মতো কার্টুন আঁকতে পারি না, গাইতে পারি না গান তাই থিয়েটার হচ্ছে আমার একটা টুলস যার মাধ্যমে সমাজের অন্যায়, নিপীড়নে দগ্ধ হয়ে বেঁচে থাকার বিরুদ্ধে একটা চিৎকার হয়তো করে যেতে পারি। পথনাটকও তেমনি- যা কিছু অন্যায়, রাষ্ট্রের বা সমাজের যা কিছু অসঙ্গতি তার বিরুদ্ধে দুটো কথা বলা যায় এর মধ্য দিয়ে। তাতে সমাজে খুব বড়ো পরিবর্তন হয়তো আনা যায় না, কিন্তু একটা ঢেউ তো তোলা যায় !” রুমা বলেন, “যেকোনো অন্যায় ও অধিকার লঙ্ঘনের কোনো ঘটনায় আমি দাঁড়িয়ে যেতে পারি, সেখানে নাটকীয় উপাদান থাকলো কি কম থাকলো, সেটা আমি ভাবি না। আমি নাটকের মাধ্যমে জানান দিতে পারি যে, এখনো মরে যাইনি। তাই পথনাটক খুব এনজয় করি, যেখানে দর্শক এবং অভিনেতা দু’জনেই থাকে মুখোমুখি ও কাছাকাছি।”

থিয়েটারকে ঘিরে নিজের স্বপ্ন বুননের কথা জানান রুমা এইভাবে- অভিনয়কেই উপভোগ করতে চান উল্টে-পাল্টে, নিংড়ে, নানারকম নিরীক্ষার মাধ্যমে। ভালো না লাগলে ছেড়ে দেবেন, এ রকম একসময় ভাবলেও, রুমা বলেন, “এখন আর সেটা সম্ভব নয়।” প্রসঙ্গত জামিল স্যারের [সৈয়দ জামিল আহমেদ]-এর একটি কথা টেনে আনেন। তিনি অভিনয়ের ক্লাসে একদিন তাঁর শিক্ষার্থীদের বিশেষত মেয়েদের উদ্দেশ্য করে বলেন, “কখনো রান্নাঘরের জানালা দিয়ে আকাশ দেখার চেষ্টা করবে না, আকাশ দেখতে হয় রান্নাঘরের বাইরে এসে, খোলা জায়গায় দাঁড়িয়ে। তাহলেই বোঝা যায় যে, আকাশটা কত বড়ো !” তাই যে কাজটা ভালোবাসেন, মন-প্রাণ ঢেলে সেটাই করে যেতে চান বাকি জীবন। মন থেকেই খুব চান থিয়েটারে মেয়েরা শুধু অভিনয় নয়, কারিগরি দিকে, নির্দেশনায়, সংগীতে, মঞ্চসজ্জায়, আলোতেও কাজ করে যেতে থাকবে দক্ষতার সাথে। তবেই না বোঝা যাবে কতটা এগোল দেশ, কতটা সমাজ ! 

লেখা : ইভা আফরোজ খান

নাটকের ছবি : নাজমুল হোসাইন ও লেখক