আরবের প্রথাবিরোধী রাজকন্যা প্রিন্সেস আমিরাহ

14 May 2023, 03:20 PM অভোগ শেয়ার:
আরবের প্রথাবিরোধী রাজকন্যা প্রিন্সেস আমিরাহ

আরব্যরজনীর রাজকন্যাদের গল্প থেকে বের হয়ে এরার চলুন বাস্তবের এক রাজকন্যার সঙ্গে পরিচিত হই। ঠিক তাকে রাজকন্যাদের ধাঁচে ফেলা যাবে না। যারা সারাদিন সাজগোছ আর সৌন্দর্যের পেছনেই সময় ব্যয় করে। এই রাজকন্যা অন্য ধাতুতে গড়া। কারণ, সৌদি আরবের মতো রক্ষণশীল দেশে যেখানে মেয়েদের পুরুষ অভিভাবক ছাড়া বের হওয়ার নিয়ম নেই সেখানে তিনি বিশ্বাস করেন নারী স্বাধীনতায়। বলছিলাম সৌদি প্রিন্সেস আমিরা আল তাওয়িল’র কথা। এই রাজকন্যা তার সাহসী চালচলন ও কাজকর্মের জন্য পুরো বিশে^ই দারুণ আলোচিত ও সমালোচিত। কোনো কিছুর তোয়াক্কা না করেই তিনি আছেন তার নিজের মতো। দারুণ সুন্দরী ও প্রতিভাময়ী এই রাজকন্যাকে নিয়ে এবারের আয়োজন...


প্রিন্সেস আমিরাহ’র পুরো নাম প্রিন্সেস আমিরাহ বিনতে আইদান বিন নায়েফ আল-তাওয়েল আল-ওতাইবি। ১৯৮৩ খ্রিষ্টাব্দে ৬ নভেম্বর তিনি সৌদি আরবের রাজধানী রিয়াদে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা ইদান বিন নায়েফ আল তাওয়িল আল আতিবি ছিলেন সৌদি রাজপরিবারের একজন গুরুত্বপূর্ণ সদস্য। আমিরাহর পিতা-মাতার বিচ্ছেদের পর প্রিন্সেস তার মায়ের সঙ্গে নানা বাড়িতে বড়ো হয়েছেন। ছেলেবেলা থেকেই তার মাঝে স্বাধীনচেতা মনোভাব লক্ষ করা যায়। আমিরাহ যুক্তরাষ্ট্রের কানেক্টিকাটের ইউনিভার্সিটি থেকে বিজনেস অ্যাডমিনেস্ট্রেশনে গ্রাজুয়েশন কমপ্লিট করেন।

প্রিন্সেস আমিরাহ’র বয়স যখন আঠার, তখন তার পড়াশোনার একটা প্রজেক্ট হিসেবে প্রিন্স আল ওয়ালিদের ১০ মিনিটের একটি সাক্ষাৎকার নেওয়ার দায়িত্ব পড়েছিল তার ওপর। কিন্তু ১০ মিনিটের এই সাক্ষাৎকারটি রূপ নেয় ২ ঘণ্টায়। এই সাক্ষাৎকারটি তাদের একটি সম্পর্কের সূচনা করে। প্রিন্স আল ওয়ালিদ ২৮ বছরের বড়ো হওয়া সত্তে¡ও তারা একে অপরের প্রেমে পড়েন। দীর্ঘ নয় মাস সম্পর্কের পর তারা বিয়ে করেন। অবশ্য প্রিন্সেস আমিরাহ ছিলেন প্রিন্স আলওয়ালিদের তৃতীয় স্ত্রী।

প্রিন্স ওয়ালিদ রক্ষণশীল মনের মানুষ নন। তিনি সবসময় চেয়েছেন আমিরাহ সমাজকল্যাণমূলক কাজে অংশগ্রহণ করুক। প্রিন্স আল ওয়ালিদ মানুষদের সাহায্য সহযোগিতা করতেন অনেক আগে থেকেই কিন্তু তিনি চাইতেন কোনো ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে আরো বড়ো পরিসরে কাজগুলো করতে। ২০০৯ খ্রিষ্টাব্দে প্রিন্সেস আমিরাহ’র একান্ত ইচ্ছায় ‘আল ওয়ালিদ বিন তালাল ফাউন্ডেশন’ গঠিত হয়। যা সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন নিয়ে কাজ শুরু করে। প্রিন্সেস আমিরাহ এই ফাউন্ডেশনের ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে নিযুক্ত হন। সাধারণ মানুষের দারিদ্র্য বিমোচন, নারীর ক্ষমতায়ন, নিকটবর্তী দেশগুলোতে খুব দ্রæত ত্রাণ বিতরণ করাই মূলত এই ফাউন্ডেশনের উদ্দেশ্য ছিল। এই ফাউন্ডেশন হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটি, জর্জ টাউন ইউনিভার্সিটি, আমেরিকান ইউনিভার্সিটি অব বৈরুত এবং আমেরিকান ইউনিভার্সিটি অব কায়রোতে গবেষণা কেন্দ্র স্থাপন করেন। প্রিন্সেস আমিরাহ ২০১১ খ্রিষ্টাব্দে ইংল্যান্ডের প্রিন্স ফিলিপের উপস্থিতিতে ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রিন্স আল ওয়ালিদ বিন তালাল সেন্টার অব ইসলামিক স্টাডিজ প্রতিষ্ঠা করেন। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রিন্স ফিলিপ তাকে মানবতার জন্য অসাধারণ কাজ করায় পদক প্রদান করেন।

২০১১ খ্রিষ্টাব্দে তিনি বুরকিনা ফাসোতে প্রতিষ্ঠিত আল ওয়ালিদ বিন তালাল ভিলেজ অরফানেজের কাজ বেশ জোরেসোরে শুরু করেন। এই এতিমখানাটি ২০০৬ খ্রিষ্টাব্দে তার স্বামী প্রিন্স আল ওয়ালিদ বিন তালাল প্রথম সফরের পর থেকে প্রতিষ্ঠা করা হয় এবং তখন থেকেই এখানে গরীব মানুষদের বিভিন্ন সাহায্য-সহযোগিতা করা হয়। ২০০৬ খ্রিষ্টাব্দে আমিরাহ পাকিস্তানে বন্যা দুর্গতদের সাহায্য করার জন্য পাকিস্তানে যান।

২০১৫ খ্রিষ্টাব্দে মানবতার কাজের জন্য আল ওয়ালিদ বিন তালাল ফাউন্ডেশনের তিনটি শাখা চালু করা হয়। তার মধ্যে একটি সৌদি আরবে, একটি লেবাননে এবং অপরটি সারাবিশ্বের জন্য। এই ফাউন্ডেশনটি স্থানীয়ভাবে এবং বিশ্বব্যাপী মানুষের অবাধ স্বাধীনতা, গ্রহণযোগ্যতা, সম-অধিকার এবং সম-সুযোগের জন্য কাজ করে চলেছে। বিশেষ করে সমাজ উন্নয়ন ও নারীর ক্ষমতায়নের জন্য কাজ করছে।

২০১৩ খ্রিষ্টাব্দে প্রিন্সেস তার নিজ উদ্যোগে আরবের যুবকদের জন্য ভালো কিছু তৈরি করার লক্ষ্যে ও তাদের কর্মসংস্থানের জন্য এবং মিডিয়া ও বিনোদন শিল্পের উন্ন্য়নের লক্ষ্যে টাইম এন্টারটেইনমেন্ট নামে একটি হোল্ডিং কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি একই সঙ্গে তাসামি সোশ্যাল ইনিশিয়েটিভ সেন্টারে সহ-প্রতিষ্ঠাতা ও চেয়ারম্যান হন এবং তিনি এই সেন্টারের মাধ্যমে আরবের যুবকদের ক্ষুদ্র কিন্তু টেকসই ব্যবসা তৈরির জন্য সাহায্য করেন।

প্রিন্সেস আমিরাহ তার এক সাক্ষাৎকারে একবার বলেছিলেন, ‘আমি সেই ধরনের মেয়ে হতে চাই না, যে মেয়েটি কিছু করে না।’ তিনি নিজেকে অন্য সকল নারীদের মতো পর্দার মধ্যে রাখেননি, তিনি চলাফেরা করেন একজন পশ্চিমা নারীদের মতো করে। তার এই ধরনের চলাফেরাটা ছিল নারীদের স্বাধীনতা, অধিকার ও ক্ষমতায়নের জন্য।

প্রিন্সেস আমিরাহ দীর্ঘ তিন দশক ধরে নারী অধিকার-আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত রয়েছেন কিন্তু তার এই কাজটি খুব বেশি সহজ নয়। এটি এমন একটি আন্দোলন যেটি শুধুমাত্র একটি সরকারের বিরুদ্ধে নয়। এই আন্দোলন আরববিশ্বের হাজার বছরের প্রথার বিরুদ্ধে।

প্রিন্স আল ওয়ালিদ বিন তালাল ফাউন্ডেশনের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার পর থেকে তিনি নারীদের জন্য নাগরিক অধিকার হিসেবে বিবাহ বিচ্ছেদের পর নারীরা যেন তার নিজ সন্তানকে নিজের কাছে রেখে লালন-পালন করতে পারেন। প্রিন্সেস আমিরাহ সৌদি আরবের নারীদের জন্য গাড়ি চালানোর অধিকার আদায়েও আন্দোলন করেন। তার নিজ দেশের সড়কে একদিন তিনি প্রথম সৌদি নারী হিসেবে গাড়ি চালানোর আশা ব্যক্ত করেছিলেন। তার এই আন্দোলনটি আলোর মুখ দেখেছে। প্রিন্সেস আমিরাহ বিশ্বব্যাপী নারীদের অধিকারের জন্য সারাবিশে^র রাজপরিবারগুলো বিশেষ করে জর্ডানের রানি এবং ব্রিটিশ রাজপরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কাজ করে চলেছেন।

প্রিন্সেস আমিরাহ সৌদি ও ইসলামি অনুশাসন না মানার কারণে প্রিন্স ওয়ালিদকে রাজপরিবারের পক্ষ থেকে চাপ দেওয়া হয়। ফলে প্রিন্স ওয়ালিদ বাধ্য হয়ে প্রিন্সেস আমিরাহকে ২০১৩ খ্রিষ্টাব্দের নভেম্বরে ডিভোর্স দেন। কিন্তু তারা এখনো বন্ধু হিসেবে আছেন এবং একসাথে মানবতার জন্য কাজ করে যাচ্ছেন। বর্তমানে আমিরা আল তাওয়িল এমিরতি কোটিপতি খলিফা বিন বাট্টির সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ আছেন।

প্রিন্সেস আমিরাহ তার কাজের জন্য নানা ধরনের পুরস্কারে ভ‚ষিত হয়েছেন। ‘প্রিন্স আল ওয়ালিদ বিন তালাল ফাউন্ডেশন’র অংশ হিসেবে তাকে আইটিপি’র পক্ষ থেকে অ্যারাবিয়ান বিজনেস অ্যাচিভমেন্ট অ্যাওয়ার্ড অনুষ্ঠানে ‘হিউমেরিটিয়ান অ্যাওয়ার্ডে’ ভূষিত করা হয়। ২০১০ খ্রিষ্টাব্দে আমিরাহ ‘হিউমেরিটিয়ান অ্যাওয়ার্ডে’ ভূষিত হন। ২০১২ খ্রিষ্টাব্দে তিনি আরবের ক্ষমতাধর ১০০ নারীর মধ্যে চতুর্থ স্থানে ছিলেন। এছাড়াও ‘ওমেন পার্সোনালিটি অব দ্য ইয়ার অ্যাওয়ার্ড’ পান। হ

লেখা : ফাতেমা ইয়াসমিন