দিন দিন ছোটো হয়ে আসছে আমাদের সিনেমার বাজার। তাই সিনেমা মুক্তির আগে প্রযোজকদের অনেক হিব-নিকাশের পর সিনেমা মুক্তি দিতে হয়। সারাবছর যেভাবেই সিনেমা মুক্তি দেওয়া হোক না কেন, দুই ঈদের হিসেবটা অন্যরকম। যেহেতু প্রতিবছরই হল কমছে, তাই সিনেমার মুক্তির সংখ্যাও কমে আসছে। কেননা, ঈদে যেসব ছবি মুক্তি পায়, তার প্রতিটি ছবিই বিগ বাজেটের হয়ে থাকে। ঈদে যেহেতু অনেকে ছবি দেখতে হলমুখি হোন, তাই অনেক শিল্পীর স্বপ্নও থাকে তাদের ছবি যেন ঈদে মুক্তি পায়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তা আর হয়ে ওঠে না। দেখা যায় এক শিল্পীরই একাধিক ছবি মুক্তি পেয়ে থাকে। এবারও হয় তো এমনটিই ঘটতে চলেছে।
এক দিকে সীমিত সিনেমা হল, অপর দিকে প্রথম সারির একাধিক শিল্পীর ছবি, সব মিলিয়ে মনে হচ্ছে, ঈদের সিনেমা নিয়ে তুমুল প্রতিযোগিতা হবে। যেসব প্রযোজক ও পরিচালক বিগ বাজেটের ছবি নির্মাণ করেছেন, সবাই যার যার জায়গা থেকে অনড় রয়েছেন, ঈদেই তাদের ছবি মুক্তি দেওয়ার ব্যাপারে। তারা কেউই সিনেমা মুক্তি থেকে সরে আসতে চান না। সব মিলিয়ে ঈদে মুক্তির অপেক্ষায় থাকা সিনেমা নিয়ে বিষয়টি জটিল থেকে জটিলতর হচ্ছে।
ঈদের সিনেমার কাজ নিয়ে এখন ব্যস্ত সময় পার করছেন পরিচালক, অভিনয়শিল্পী ও প্রযোজকেরা। ‘কিল হিম’ সিনেমার গানের শুটিং চলছে কাশ্মীরে। রোজার শুরুতেই শাকিব খান ও জাহারা মিতুকে নিয়ে ‘আগুন’-এর শেষ তিনটি গানের শুটিংয়ে নামেন বদিউল আলম। অন্যদিকে সিয়াম ও বিদ্যা সিনহার ‘অন্তর্জাল’ সিনেমার সব কাজ শেষ করেছেন দীপঙ্কর দীপন। পরিচালক দীপঙ্কর দীপন বলেন, ‘এখন আমাদের টিম পরিবেশকদের সঙ্গে কথা বলছে। সব চূড়ান্ত হচ্ছে। খুব শিগ্গিরই প্রচারে আসব। মুক্তির এই সিদ্ধান্ত পেছাব না।’ গত দুই বছর করোনার কারণে ঘোষণা দিয়েও শেষ মুহূর্তে সিনেমা মুক্তি থেকে সরে আসেন প্রযোজকেরা। কিন্তু এবার ঝুঁকি নিয়েই ছবি মুক্তি দিতে চান প্রযোজকেরা।
ইতোমধ্যে শাকিব খান ও বুবলী অভিনীত ‘লিডার : আমিই বাংলাদেশ’ সিনেমাটি মুক্তির ব্যাপারে নিশ্চিত করেছেন সিনেমার পরিবেশনা ব্যবস্থাপক এম এম মঞ্জুর রহমান। এই সপ্তাহে সিনেমার টিজার এবং পরে গান মুক্তি দেওয়া হতে পারে। তিনি বলেন, শাকিব খানের ‘লিডার আমিই বাংলাদেশ’ এবং ‘আগুন’ দুটি সিনেমা ঈদে মুক্তির কথা ছিল। কিন্তু নির্মাতা সূত্রে জানতে পেরেছি, ‘আগুন’ ঈদে মুক্তি পাবে না। সেই হিসেবে শাকিবের ঈদের একমাত্র সিনেমা হতে যাচ্ছে ‘লিডার’ আমিই বাংলাদেশ! ‘আমরা প্রত্যাশা করছি, ১০০-এর বেশি হল পাবে ‘লিডার’। কারণ সারাদেশের সিনেমা হলে শাকিবের সিনেমার চাহিদা অন্যরকম। তার নতুন সিনেমা না পাওয়ায় পুরাতন সিনেমা চালানো হয়। একবছর পর হিরোর সিনেমা আসবে। সিঙ্গেল স্ক্রিনের প্রতিটি হল মালিক চাইবেন হিরোর সিনেমা। দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতা থেকে প্রত্যাশা করছি, ঈদে ‘লিডার’ ১০০-এর মতো হল পাবে।’ গেল ঈদে প্রায় দেড়’শ বন্ধ সিনেমা হল খুলেছিল। এবারও তেমন হবে। সেই হিসেবে প্রায় দুইশ-এর মতো হলে ঈদের সবগুলো সিনেমা চলতে পারে। ঈদের অনেক বাকি। রমজানে ম্যাক্সিমাম হল বন্ধ। এর মধ্যে আমরা স¤প্রতি ‘লিডার : আমিই বাংলাদেশ’র বুকিং নেওয়া শুরু করেছি। সিনেমাটির কাহিনি ও সংলাপ লিখেছেন দেলোয়ার হোসেন দিল। এতে শাকিব-বুবলী ছাড়াও বিভিন্ন চরিত্রে আরও অভিনয় করেছেন মিশা সওদাগর, শহিদুজ্জামান সেলিম, এল আর সীমান্ত, সুব্রত প্রমুখ। সিনেমাটির ডিস্ট্রিবিউশন করবে টিওটি ফিল্মস।
গত বছরের ২৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সেন্সর বোর্ড থেকে আনকাট ছাড়পত্র পায় বেঙ্গল মাল্টিমিডিয়া লিমিটেড প্রযোজিত এই সিনেমাটি। যা সামাজিক সচেতনা, প্রতিবাদ [অ্যাকশন] ও রাষ্ট্রে জীবনযাপনে স্বনির্ভর হওয়ার বার্তা দেবে দর্শকদের।
‘লাল শাড়ি’ ছবির পরিচালক বন্ধন বিশ্বাস বলেন, ‘আমরা ঈদেই মুক্তি দেব। অপু বিশ্বাসের সঙ্গে আমার টিমও সিনেমাটির হল বুকিং-সহ মুক্তিসংশ্লিষ্ট কাজগুলো নিয়ে এগোচ্ছে। শোনা যাচ্ছে, অনেক ছবি মুক্তি পাবে। সেটা নিয়ে ভাবছি না। আমরা মাল্টিপ্লেক্সের জন্য ছবিটি বানিয়েছি। সেভাবেই পরিকল্পনা করে এগোচ্ছি।’
জাজ মাল্টিমিডিয়ার প্রধান নির্বাহী আলিমুল্লাহ খোকন বলেন, ‘ঈদে আমাদের দুটি সিনেমা মুক্তি পাবে। এখন পর্যন্ত এটাই চূড়ান্ত হয়েছে।’
এবারের ঈদে শাকিব খান অভিনীত দুটি সিনেমা মুক্তির সম্ভাবনা রয়েছে। এর মধ্যে একটি ‘লিডার : আমিই বাংলাদেশ’-এর প্রযোজক সৈয়দ আশিকুর রহমান বলেন, ‘আমাদের সিনেমাটি ঈদে মুক্তি পাবে। সেভাবে সবকিছু প্রস্তুত রয়েছে।
ঈদে মুক্তি পেতে পারে আরিফিন শুভ অভিনীত ‘নূর’ সিনেমাটিও। ‘নূর’ সিনেমার পরিচালক রায়হান রাফি বলেন, ‘ঈদে আমার একটি সিনেমা মুক্তি পাবে। সেটা ‘নূর’ কি না, এখনই বলতে পারছি না।’
সজল ও পূজা চেরি অভিনীত ‘জ্বিন’ ছবিটিও ঈদে মুক্তি পাবে বলে শোনা যাচ্ছে। সব মিলিয়ে ঈদে এখন পর্যন্ত আটটির বেশি সিনেমা মুক্তির তালিকায় রয়েছে। অথচ এই মুহূর্তে সারাদেশে ৫০ থেকে ৬০টির মতো হল চালু রয়েছে। ঈদে কিছু সিনেমা হল বাড়ে। সেই হিসেবে হল হতে পারে বড়োজোর ১২০ থেকে ১৪০টি।
চলচ্চিত্র প্রদর্শক সমিতির উপদেষ্টা আলাউদ্দীন মিয়া বলেন, ঈদের জন্য বেশকিছু সিনেমার নাম শোনা যাচ্ছে। একসঙ্গে এত সিনেমা গত বিশবছরেও কোনো ঈদে মুক্তি পায়নি। সিনেমার অবস্থা এমনিতেই ভালো না। পরিকল্পনা করে সিনেমাগুলো মুক্তি দেওয়া দরকার। সব সিনেমা মুক্তি পেলে বিশৃঙ্খলা তৈরি হবে। গত বছর ‘পরাণ’ ও ‘হাওয়া’ ঢালিউডে সুবাতাস বইয়ে দিলেও সেই হাওয়া আর অন্য কোনো সিনেমায় লাগেনি। গত সাত-আট মাসে নিয়মিত সিনেমা মুক্তি পেলেও কোনোটাই আর লাভের মুখ দেখেনি। চলচ্চিত্রসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা মনে করছেন, ঢালিউডের দুঃসময়ে ঈদই ভরসা, যে কারণে শেষ পর্যন্ত সবাই চাইবেন, ঈদে সিনেমা মুক্তি দিয়ে দুই-তিন সপ্তাহে বিনিয়োগ তুলে আনতে।
চলচ্চিত্র সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা মনে করেন, দিনে দিনে হল কমতে থাকা চলচ্চিত্রের জন্য একটি অশনি সংকেত। তবে, হল কমার কারণ উল্লেখ করে প্রদর্শক সমিতি জানায়, মানসম্মত ছবির অভাবে হলে দর্শক আসে না। যাদের ছবির দর্শক বেশি হয় তাদের ছবি কম মুক্তি পায়। এভাবে চলতে থাকলে আগামী কয়েক বছরের মধ্যে প্রায় সব একপর্দার প্রেক্ষাগৃহ বন্ধ হওয়ার আশঙ্কা সংশ্লিষ্ট সব মহলের।
লেখা : শেখ সেলিম