২৬টি বিভাগে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার ঘোষণা করার মাধ্যমে ৩ ডিসেম্বর ২০১৯ সালের জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার ঘোষণা করেছে সরকার। যৌথভাবে সেরা ছবির পুরস্কার জিতেছে ‘ন ডরাই’ ও ‘ফাগুন হাওয়া’ চলচ্চিত্র। বিস্তারিত লিখেছেন শেখ সেলিম...
দেশের সবচেয়ে সম্মানজনক জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার ২০১৯-এর পূর্ণাঙ্গ তালিকা ঘোষণা করা হয় ৩ ডিসেম্বর। তথ্য মন্ত্রণালয়ের এক প্রজ্ঞাপনে দেশের চলচ্চিত্র শিল্পে গৌরবোজ্জ্বল ও অসাধারণ অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ বিভিন্ন ক্যাটাগরিতে বিশিষ্ট শিল্পী, কলাকুশলী, প্রতিষ্ঠান ও চলচ্চিত্রকে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার-২০১৯ প্রদানের ঘোষণা করা হয়। ২০১৯ সালের শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র হিসেবে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার যৌথভাবে পেয়েছে মাহবুব উর রহমান প্রযোজিত ‘ন ডরাই’ ও ফরিদুর রেজা সাগর প্রযোজিত ‘ফাগুন হাওয়ায়’ ছবি দুটি। আর ‘ন ডরাই’র জন্য সেরা পরিচালক হিসেবে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পাচ্ছেন তানিম রহমান অংশু। সেরা অভিনেতা হিসেবে ‘আবার বসন্ত’ ছবিতে অভিনয়ের জন্য পুরস্কার পাচ্ছেন অভিনেতা তারিক আনাম খান। সেরা অভিনেত্রী হিসেবে পুরস্কার জিতেছেন ‘ন ডরাই’ ছবির জন্য সুনেরাহ বিনতে কামাল। পার্শ্ব চরিত্রে শ্রেষ্ঠ অভিনেতা হিসেবে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পাচ্ছেন ফজলুর রহমান বাবু। ‘ফাগুন হাওয়ায়’ অভিনয়ের জন্য এ পুরস্কার জিতেছেন তিনি। পার্শ্ব চরিত্রে শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রী পাচ্ছেন নারগিস আকতার ‘মায়া দ্য লস্ট মাদার’ ছবির জন্য।
খল চরিত্রে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পাচ্ছেন অভিনেতা জাহিদ হাসান। তিনি ‘সাপলুডু’ সিনেমায় খল চরিত্রে অভিনয়ের জন্য শ্রেষ্ঠ খল অভিনেতার পুরস্কার পাচ্ছেন।
সেরা সংগীত পরিচালক হিসেবে ইমন চৌধুরী, সেরা গায়ক হিসেবে মৃণাল কান্তি দাস, সেরা গায়িকা হিসেবে মমতাজ বেগম ও ফাতিমা তুজ-জোহরা পুরস্কার পাচ্ছেন।
শ্রেষ্ঠ শিশুশিল্পী হিসেবে যৌথভাবে আফরীন আক্তার ও নাইমুর রহমান, সেরা সুরকার হিসেবে তানভীর তারেক ও প্লাবন কোরেশী, সেরা গীতিকার হিসেবে কামাল আবদুল নাসের চৌধুরী ও নির্মলেন্দু গুণকে নির্বাচিত করা হয়েছে।
অভিনেতা-প্রযোজক-পরিচালক মাসুদ পারভেজ [সোহেল রানা] ও অভিনেত্রী-প্রযোজক-পরিচালক কোহিনুর আক্তার সুচন্দাকে আজীবন সম্মাননা দেওয়া হচ্ছে।
শিগগিরই জমকালো আয়োজনের মধ্য দিয়ে বিজয়ীদের হাতে পুরস্কার তুলে দেবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
তারিক আনাম খান
জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার ২০১৯-এ শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র অভিনেতার পুরস্কার পাচ্ছেন অভিনেতা তারিক আনাম খান। পুরুষ চরিত্রে শ্রেষ্ঠ অভিনেতা হিসেবে এটাই তার প্রথম জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার অর্জন। তিনি ‘আবার বসন্ত’ সিনেমায় অনবদ্য অভিনয়ের জন্য এই পুরস্কারে ভ‚ষিত হন। তারিক আনাম খান একজন মুক্তিযোদ্ধাও। মূলত একজন মঞ্চ ও টেলিভিশন অভিনেতা হিসেবে তিনি পরিচিত হলেও চলচ্চিত্রে অভিনয়েও তিনি অনবদ্য সাফল্য পেয়েছেন।
তারিক আনাম খানের দ্বিতীয়বার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার অর্জন এটি। এর আগে ‘দেশা : দ্য লিডার’ [২০১৬] সিনেমার জন্য সেরা খল অভিনেতা হিসেবে প্রথমবার জাতীয় পুরস্কার অর্জন করেন। এছাড়া শ্রেষ্ঠ টিভি অভিনেতা হিসেবেও একাধিকবার পুরস্কৃত হয়েছেন তিনি।
তারিক আনাম খান অভিনীত উল্লেখযোগ্য চলচ্চিত্রের মধ্যে রয়েছে ‘ঘুড্ডি’ [১৯৮০], ‘জয়যাত্রা’ [২০০৪], ‘মেড ইন বাংলাদেশ’ [২০০৭], ‘আহা !’ [২০০৭], ‘জাগো’ [২০১০], ‘ঘেটুপুত্র কমলা’ [২০১২], ‘জোনাকির আলো’ ও ‘দেশা : দ্য লিডার’ [২০১৪], ‘পদ্ম পাতার জল’ [২০১৫], ‘সুপার হিরো’ [২০১৮], ‘আবার বসন্ত’, ‘বেপরোয়া’, ‘নোলক’ ও ‘সাপলুডু’ [২০১৯]।
ফাতেমা তুজ-জোহরা
জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার ২০১৯-এ শ্রেষ্ঠ গায়িকা হিসেবে মমতাজ বেগম ও ফাতিমা তুজ-জোহরা পুরস্কার পাচ্ছেন। ফাতেমা তুজ-জোহরা একজন নজরুল ও আধুনিক গানের জনপ্রিয় শিল্পী। তিনি টেলিভিশন নাটকে অভিনয়, বিভিন্ন অনুষ্ঠানে সংগীত পরিবেশনা এবং উপস্থাপনাও করেন। এছাড়া তিনি একটি কবিতার বই, দুটি ছড়ার বই, একটি উপন্যাস, একটি গল্প ও কলাম সংকলন এবং নজরুলের গান নিয়ে একটি সংগীতের বই প্রকাশ করেন। সংগীতে অবদানের জন্য তিনি ২০০৬ সালে বাংলাদেশ সরকার প্রদত্ত সর্বোচ্চ বেসামরিক রাষ্ট্রীয় সম্মান একুশে পদকে ভূষিত হন। তিনি বৃহত্তর বগুড়া জেলার জয়পুরহাটে এক সংস্কৃতিমনা পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা সৈয়দ ফরিদ উদ্দিন একজন রবীন্দ্রসংগীত শিল্পী ছিলেন। জোহরা জয়পুরহাট সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেন। সেই সময় থেকে তিনি সংগীত চর্চা শুরু করেন, পাশাপাশি অভিনয়ও করতেন। তিনি সংগীতচর্চা শুরু করেন ১৯৬৩ সালে হাবীবুর রহমান সাথির কাছে। ১৯৭৭ সাল পর্যন্ত তার কাছে সংগীতের তালিম গ্রহণ করেন। এরপর তিনি মিথুন দে’র নিকট সংগীতের তালিম নেন। এছাড়া তিনি নগেন ঘোষ এবং রফিকুল আলমের কাছে গান শেখেন।
সুনেরা বিনতে কামাল
বাংলা চলচ্চিত্রের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো নির্মিত হয়েছে সার্ফিং নিয়ে গল্প ‘ন ডরাই’। এটি চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষাতেই নির্মিত হয়। যার অর্থ ‘ভয় পাই না’। ‘স্টার সিনেপ্লেক্স’-এর প্রযোজনায় ছবিটি নির্মাণ করেন তানিম রহমান অংশু। এই ছবির মাধ্যমে বড়োপর্দায় অভিষেক হয় সুনেরা বিনতে কামালের। প্রথম ছবিতেই তিনি জয় করে নেন ‘জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার’। এই সুযোগে বলে রাখছি, ‘ন ডরাই’ নিয়ে সে-সময়ে আনন্দভুবন প্রচ্ছদ প্রতিবেদন প্রকাশ করে।
বড়ো পর্দায় কাজ করা প্রসঙ্গে সুনেরা বলেন, ‘রাজকুমার’ গানের মিউজিক ভিডিও’র কাজ করার সময় নির্মাতা তানিম আহমেদ অংশু ভাইয়ের সঙ্গে পরিচয় হয়। গানটির মিউজিক ভিডিওটি নির্মাণ করেছিলেন তিনি। প্রযোজনা প্রতিষ্ঠানের লোকজনও আমাকে চিনতেন, তারাই সিনেমাটির জন্য আমার নাম প্রস্তাব করেন। এরপর নির্মাতা-প্রযোজকেরা আলোচনা করে আমাকে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। মাঝে আমি দুটি ছবির অফার পাই কিন্তু না করে দিয়েছিলাম। কারণ, আমি একটা ভালো গল্প খুঁজছিলাম। এই ছবির অফার পাওয়ার পর স্ক্রিপ্ট পড়ে দেখলাম আমি এতদিন যার জন্য অপেক্ষা করছিলাম সেরকম একটি গল্পই।
তানিম রহমান অংশু
তানিম রহমান অংশু, বিজ্ঞাপনচিত্র নির্মাণ করে পরিচিতি পেলেও তিন বছর ধরে ব্যতিক্রমধর্মী নাটক নির্মাণ করে সুনাম অর্জন করেন তিনি। বাবা আনিসুর রহমান সংগীত পরিচালক ছিলেন। বাবার কাছে গান শিখেছেন। টিভিতে গানের অনুষ্ঠানও করেছেন। কিন্তু কখনো ভাবেননি সংগীতশিল্পী বা নির্মাতা হবেন। ভিডিও এডিটর হিসেবে ক্যারিয়ার শুরু করেন। পাঁচ-ছয় বছর আমি ভিডিও এডিটর হিসেবে কাজ করি।
ছেলেবেলা থেকে অ্যাকশন-থ্রিলার চলচ্চিত্র, সিরিজ তার খুব পছন্দ ছিল। ভিডিও এডিটিং করতে করতে নির্মাণের প্রতি আগ্রহ জন্মে এ ভাবনা থেকেই নির্মাণে আসা। মিউজিক ভিডিও, নাটক নির্মাণের পাশাপাশি বড়োপর্দায় কাজ করেন অংশু। ভালো কাজের স্বীকৃতি হিসেবে ‘ন ডরাই’ ছবির জন্য জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারে ভ‚ষিত হন।
জাহিদ হাসান
জনপ্রিয় অভিনেতা ও নাট্যপরিচালক জাহিদ হাসান আবারো জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন। হুমায়ূন আহমেদ পরিচালিত ‘শ্রাবণ মেঘের দিন’ তার অভিনীত অন্যতম ছবি। এই চলচ্চিত্রে মতি চরিত্রে অভিনয়ের জন্য তিনি শ্রেষ্ঠ অভিনেতার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার অর্জন করেন। টেলিভিশন এবং চলচ্চিত্রে বিভিন্ন ধারার চরিত্রে অভিনয় করেন তিনি। জাহিদ হাসান ১৯৬৭ সালের ৪ অক্টোবর সিরাজগঞ্জে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা ইলিয়াস উদ্দিন তালুকদার ছিলেন কাস্টম কর্মকর্তা ও মা হামিদা বেগম গৃহিণী। পাঁচ ভাই ও তিন বোনের মধ্যে জাহিদ হাসান সবার ছোটো। তিনি চতুর্থ শ্রেণি পর্যন্ত সিরাজগঞ্জের ‘হৈমবালা উচ্চ বালক বিদ্যালয়ে’ পড়াশোনা করেন এবং পরের তিন বছর বেনাপোলের ইন্টার স্কুলে পড়ার পর পুনরায় সিরাজগঞ্জে ফিরে এসে সেখান থেকে মাধ্যমিক পরীক্ষা দেন।
তিনি স্কাউটের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। সেখানে তিনি অভিনয় করতেন। সিরাজগঞ্জ তরুণ স¤প্রদায় নাট্য দলে যোগ দেন এবং এই দলের সঙ্গে উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন স্থানে মঞ্চনাটকে অভিনয় করেন। সেসময় তিনি ‘সাত পুরুষের ঋণ’ মঞ্চনাটকে নিয়মিত অভিনয় করেন। ১৯৮৪ সালে ১০ আগস্ট মঞ্চনাটকটি বাংলাদেশ টেলিভিশনে প্রচার হয়। ১৯৮৬ সালে আবদুল লতিফ বাচ্চুর পরিচালনায় বাংলাদেশ, পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কার যৌথ প্রযোজনার ‘বলবান’ ছবিতে অভিনয়ের মাধ্যমে বড়ো পর্দায় কাজ শুরু করেন। ১৯৯০ সালে টেলিভিশনে অভিনয় শুরু করেন। এর আগে তিনি ১৯৮৯ সালে বাংলাদেশ টেলিভিশনে অভিনয়ের অডিশন দেন। তার অভিনীত প্রথম টেলিভিশন নাটক ‘জীবন যেমন’। আলিমুজ্জামান দুলু প্রযোজিত নাটকটি ১৯৯০ সালে বাংলাদেশ টেলিভিশনে প্রচার হয়। হুমায়ূন আহমেদ পরিচালিত টেলিফিল্ম ‘নক্ষত্রের রাত’, ‘মন্ত্রী মহোদয়ের আগমন’, ‘সমুদ্র বিলাস প্রাইভেট লিমিটেড’, ‘আজ রবিবার’ তাকে জনপ্রিতার শীর্ষে নিয়ে আসে। এছাড়াও তিনি হুমায়ূন আহমেদ পরিচালিত ‘শ্রাবণ মেঘের দিন’ চলচ্চিত্রে কেন্দ্রীয় চরিত্রে অভিনয় করে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার অর্জন করেন। অভিনয়ের পাশাপাশি তিনি নাটক পরিচালনা করে থাকেন। তার পরিচালিত প্রথম মেগা ধারাবাহিক ‘লাল নীল বেগুনি’। তার পরিচালিত অন্যান্য টেলিভিশন ধারাবাহিকসমূহ হলো ‘ঘুঘুর বাসা’, ‘চোর কুটুরি’, ‘একা’ ও ‘ছন্নছাড়া’। তার পরিচালিত টেলিভিশন নাটক ও টেলিছবিসমূহ হলো ‘রুমঝুম’, ‘বোকা মানুষ’, ‘ব্যবধান’, ‘স্বপ্নের গ্রহ’, ‘অপু দ্য গ্রেট’, ‘প্রাইভেট ডিটেকটিভ’ ও ‘বাউন্ডুলে এক্সপ্রেস’।
জাহিদ হাসান মডেল সাদিয়া ইসলাম মৌ-এর সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। তাদের দুই সন্তান রয়েছে। মেয়ের নাম পুষ্পিতা এবং ছেলের নাম পূর্ণ। তার ‘পুষ্পিতা প্রোডাকশন লিমিটেড’ নামে একটি প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান রয়েছে।