নগর সংকীর্তনের সুরই প্রতিবাদী পথনাটকের প্রথম স্বর -অধ্যাপক ড. রতন সিদ্দিকী

21 Apr 2024, 01:05 PM প্রবন্ধ শেয়ার:
নগর সংকীর্তনের সুরই প্রতিবাদী পথনাটকের প্রথম স্বর  -অধ্যাপক ড. রতন সিদ্দিকী

মহামনীষী ভরত তাঁর নাট্যশাস্ত্রে উল্লেখ করেছেন বঙ্গবাসীগণ নাট্যপ্রবৃত্তি তাড়িত ছিলেন। তারা নাট্যগীত-নৃত্য-বাদ্যসহযোগে নারীগণের সঙ্গে নাট্যপ্রবৃত্তি পরিবেশন করতেন। উপস্থিত দর্শক শ্রোতা সে প্রবৃত্তির পরিবেশনা সানন্দে উপভোগ করতেন। অনুরূপ পাল শাসনামলে রচিত বাংলাসাহিত্যের প্রাচীন যুগের নিদর্শন চর্যাপদের ১৭ সংখ্যক পদেও বাংলা নাট্যের উল্লেখ আছে।

স্মরণীয় এসব নাট্য পরিবেশিত হয়েছে সমতল ভূমিতে। সমবেত দর্শক শ্রোতার সামনে। কোনো বাড়ির আঙিনার বা বৃহৎ বৃক্ষতলে পরিবেশিত এই প্রবৃত্তি-নাট্য পরিবেশনার জন্য তেমন কোনো পূর্ব প্রস্তুতি, আয়োজন-সমারোহ থাকত না। কথক বা গায়েন উচ্চকণ্ঠে দর্শকদের আহ্বান করতেন সংগীতে বা চিৎকারে অথবা সজোরে বাদ্য বাজিয়ে। আনন্দপ্রিয় মানুষরা তাদের পরিবেশন উপভোগ করতেন।

এসকল প্রবৃত্তি-নাট্য পরিবেশনে কোনো আনুষ্ঠানিক আয়োজন বা মঞ্চ নির্মাণ করা হতো না। সেট বা পরিকল্পিত আলো সেখানে প্রোক্ষেপিত হতো না। আয়োজনের বাহুল্য প্রয়োজনের নাট্যক্রিয়াকে কোনোভাবেই বিঘœ করত না। সহজ-সরল নাট্যভাবনা, সহজ সাচ্ছন্দ্যে উপস্থাপন করতেন অভিনয়শিল্পীগণ কোনোরকম অকারণ চমক ও অতিসামগ্রী ও দ্রব্যনির্ভরতা তখন ছিল না। তাই ওগুলোকে একরকম পথনাট্য প্রয়াস বলা যেতেই পারে।

তবে নাট্যতাত্ত্বিকেরা পথনাটককে যেভাবে চিহ্নিত করতে চেষ্টা করছেন তাতে একটা বড়ো রকমের গোলমাল আছে। তারা বলছেন, পথনাটক হলো সমসাময়িক কালের কোনো রাজনৈতিক বা সামাজিক ঘটনা বা আলোড়নের ওপর ভিত্তি করে রচিত ও পথ-প্রান্তরে পরিবেশিত নাটক হলো পথনাটক।

জিজ্ঞাসা হলো- পথনাটক কী নাট্যবিষয় সংশ্লিষ্ট না পরিবেশনারীতির ওপর বিচার্য। নামকরণের আলোকে বলা যেতেই পারে যে, পথে-ঘাটে পরিবেশিত নাটকই হলো পথনাটক। অপ্রস্তুত দর্শকদের উপস্থিতিতে স্বল্প প্রস্তুতিতে পরিবেশিত পথ-প্রান্তরের নাটক পথনাটক। আর ওই যে সমসাময়িক কালের ঘটনা বা আলোচনা আন্দোলনকে বিষয় করার যে বক্তব্যটি তার আলোকে তো রাজনৈতিক নাটক, সামাজিক নাটক পোস্টার থিয়েটার চিহ্নিত করা হয়ই। তাহলে পথনাটক বিষয়কেন্দ্রিক হবে কেন ?

এ জিজ্ঞাসাকে সমূলে সানন্দে গ্রহণ করলে বলতেই হবে বাংলা পথনাটকের শুরু ভরতের নাট্যশাস্ত্রের বর্ণিত সময় থেকে। স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশের রাজনীতি পথনাটককে বাঁক বদলে সহায়তা করেছে মাত্র। সেখান থেকে তার নবযাত্রা হয়েছে। কিন্তু সূচনা হয়েছে অনেক পূর্বে।

মধ্যযুগে রচিত শ্রীকৃষ্ণকীর্তনকাব্য অসামান্য নাট্য বলে সমৃদ্ধ। বড়– চ-ীদাসের অমর এ সৃজন যেভাবে পরিবেশিত হয়েছে তাঁকে পথনাটক ছাড়া অন্য কী বলা যায় ? রামায়ণ, মহাভারতের কাহিনি অবলম্বনে রচিত কবিন্দ্র পরমেশ্বর, শ্রীকরনন্দী, কাশীরাম দাস যা রচনা করেছেন এবং গ্রামের গায়েন-কথকেরা যেভাবে গ্রামের হাটে-মাঠে-প্রাঙ্গণে-অঙ্গনে পরিবেশন করেছেন তাকে অবশ্যই পথনাটক বলা যেতে পারে।

মধ্যযুগের একটি বিশাল সাহিত্যশাখা মঙ্গলকাব্য। মনসামঙ্গল, চ-ীমঙ্গল, ধর্মমঙ্গল, শীতলামঙ্গল প্রভৃতি সকল কাব্যবিষয় নিয়ে নাট্যগুণঋদ্ধি যে কাব্য রচনা করেছেন কানা হরিদত্ত, বিজয় গুপ্ত, নারায়ণ দেব, দ্বিজ বংশীদাস, বিপ্রদাস পিপিলাই, মাণিক দত্ত, দ্বিজ মাধব, মুকুন্দরাম চক্রবর্তী, ভারতচন্দ্র রায়গুণাকর প্রমুখ তা পঠিত ও পরিবেশিত হয়েছে। নাট্যাচার্য সেলিম আল দীন পূর্বোক্ত সকল কাব্যসমূহের পরিবেশন রীতিকে বর্ণনাত্মক বাংলা নাট্য বলে অভিহিত করেছেন। মধ্যযুগের বাংলা নাট্য গ্রন্থে পরিবেশনরীতির সুবিস্তৃত ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ তিনি করেছেন। সেখানে পরিবেশন আঙ্গিকের আলোকে যা বর্ণিত হয়েছে তা থেকে সহজেই বোঝা যায় যে, সেসব নাট্য মঞ্চে মঞ্চায়িত হয়নি। পথে-প্রান্তরে, মাঠে-ঘাটে, গৃহপ্রাঙ্গণে পরিবেশিত হয়েছে। যা সমকালের নাট্যচিন্তায় অবশ্যই পথনাটকতুল্য।

মধ্যযুগের রোমান্টিক প্রণয়োপাখ্যান, মর্সিয়া সাহিত্য ও দোভাষী পুঁথি সাহিত্যের পরিবেশনা সম্পূর্ণরূপে পথনাটকের মতো। ধর্মভাবনার বাইরে গিয়ে শাহ মোহাম্মদ সগীর, দৌলত উজীর বাহরাম খাঁ, সাবিরিদ খান, আলাওল, ফকির গরিবুল্লা, মুহম্মদ কবীর প্রমুখ যা রচনা করেছেন এবং একদল গায়েন-কথক-বাদ্যকর সেসব কাব্য লায়লী-মজনু, ইউসুফ-জুলেখা, পদ্মাবতী, সোনাভান ইত্যাদি যেসব স্থানে যেভাবে পরিবেশন করেছেন তাকে পথনাটক বললে খুব ভুল হবে না। বটতলার পুঁথি বলে বটতলায় পরিবেশিত সেসব নাট্যপ্রয়াসই প্রকৃত অর্থে বিশ শতকের পথনাটকের জন্ম দিয়েছে।

পূর্বোক্ত নাট্যপ্রয়াসগুলো ঐতহ্যিবাহী বর্ণনাত্মক বাংলা নাট্য বলে সমধিক স্বীকৃতি লাভ করেছে। আজ তা প্রশ্নাতীত ও জিজ্ঞাসাবিহীন সত্যে পরিচিতি লাভ করেছে। তবে লক্ষ্য করলে দেখা যাবে যে, মধ্যযুগের সকল নাট্যপ্রয়াসই বর্ণনাত্মক সত্যি কিন্তু এর পরিবেশন স্থান বৈশিষ্ট্য সম্পূর্ণরূপেই পথনাটকের মতো।

পূর্বেই বলা হয়েছে যে, পথনাটক বিষয় বা পরিবেশনরীতির ওপর নির্ভরশীল নয়। পথনাটক প্রধানত পরিবেশনস্থান বৈশিষ্ট্যের ওপর স্বীকৃত। সে বিবচেনায় ভরতের প্রবৃত্তি, প্রাচীন যুগের বুদ্ধ-নাটক ও মধ্যযুগের নাট্যসমূহ সকলই পথনাটক। উল্লেখ্য, পথনাটকের আরেকটি বৈশিষ্ট্য হলো স্থানিক পরিবেশ অনুযায়ী সৃজন ও অভিনয়। মধ্যযুগের নাট্যে দেখা যায় ধামালী বা কৃষ্ণাযাত্রায় কোনো কোনো অংশ মুখে মুখে তাৎক্ষণিকভাবে [ঊীঃবসঢ়ড়ৎব] রচিত হয় এবং অভিনয়ও হয় তাৎক্ষণিকভাবে [ওসঢ়ৎড়ারুধঃরড়হ]। আধুনিক পথনাটকের এই বৈশিষ্ট্য মধ্যযুগের নাট্যেও ছিল।

মধ্যযুগের সুলতানি শাসনামল থেকে বাংলার একদল মুসলমান ইসলামের ইতিহাসের বীরগাঁথা যেমন কারবালায় ইমাম হোসেনের সঙ্গে এজিদের লড়াই, বদরের যুদ্ধ ইত্যাদি একধরনের কাহিনিভিত্তিক পথনাট্য অভিনয় করতেন। জঙ্গমানা, বীরাঙ্গনা সখিনা ইত্যাদি জনপ্রিয় পথনাট্য সেসময়ে খুব জনপ্রিয়তা লাভ করেছিল। পাশাপাশি কৃষ্ণযাত্রা, রামযাত্রা, ভাসানযাত্রা, চ-ীযাত্রা, খনের গান, পালটি, রঙপাঁচাল ইত্যাদি নাট্যক্রিয়াও বাঙালি সমাজে প্রচলিত ছিল। পরিবেশনস্থান বৈশিষ্ট্যের আলোকে এগুলো বাংলা পথনাট্যপ্রয়াস বলাই সঙ্গত।

অধুনাকালে পথনাটককে যে সমসাময়িককালের সামাজিক ও রাজনৈতিক ঘটনা বা আলোড়ন-আন্দোলনের প্রতিবাদী প্রতিরূপ হিসেবে বিবেচনা করা হয় এবং যা অবশ্যই পথ-ঘাট-প্রাঙ্গণ-অঙ্গনে কিংবা বৃহৎ বৃক্ষতলে সমবেত মানুষের সামনে নৃত্য-গীত-বাদ্য-অভিনয় সহযোগে পরিবেশন করা হয় তার প্রথম সার্থক প্রয়োগ প্রত্যক্ষ করা যায় শ্রীচৈতন্যের সময়কালে। ইতিহাস থেকে জানা যায় তখন খ্রিষ্টীয় ১৫২০ থেকে ১৫৩০ সালের কোনো একসময়। বাংলা তখন প্রবল প্রতাপে শাসন করছেন বৃহত্তর শাসনকর্তা আলাউদ্দিন হুসেন শাহর পুত্র প্রজাবৎসল ধর্মনিরপেক্ষ শাসক নাসিরুদ্দিন নসরত শাহ। অথচ নবদ্বীপের আঞ্চলিক স্বৈরশাসক ছিলেন জনৈক কাজী। নিষ্ঠুর ও ধর্মান্ধ কাজীর স্বৈর আচরণকে প্রতিবাদ করার মানসে চৈতন্য দেবের অনুসারীরা একটি নগর সংকীর্তন করেন। সেখানে রং মেখে সঙ সেজে কেউ কাজী হন, কেউ নির্যাতিত প্রজা হন। এবং তারা বাদ্য বাজিয়ে নৃত্য করে সংলাপ বলে কাজীর আচরণের প্রতিবাদ করেন। জানা যায়, স্বৈরশাসক কাজীর বিরুদ্ধে জনমানস গঠনে সেই নগরসংকীর্তন যা পথনাটকের সমতুল্য বিশেষ ভূমিকা পালন করে।

নাট্যতাত্ত্বিকদের তত্ত্বগত আলোচনার আলোকে এবং ইতিহাসের বিচারে প্রতিবাদী বাংলা পথনাটকের সূচনা শ্রীচৈতন্য দেবের ওই কাজী বিরোধী নগরসংকীর্তনের মাধ্যমে। ওই ধারাবাহিকতায় অদ্যাবধি চলে এসেছে পথনাটকের সাহসী, প্রতিবাদী ও সংক্ষুদ্ধ ধারা। যার উৎকর্ষ প্রত্যক্ষ করা গেছে প্রস্থিত শতাব্দীর আটের দশকে।

পূর্বোক্ত আলোচনা এ মর্মার্থকেই সত্য ও প্রমাণিত বলে স্বীকার করে যে, প্রতœ বাংলায় পথনাটক ছিল এবং প্রতিবাদী পথনাটক শুরু হয় নুসরত শাহর শাসনামলে শ্রীচৈতন্য দেবের প্রণোদনায় বলা যায়। শ্রীচৈতন্য দেবের নগর সংকীর্তনের সুরই প্রতিবাদী পথনাটকের প্রথম স্বর। ওই পথনাটকই ঔপনিবেশিক শাসনামলে ঔপনিবেশিক প্রভাবে প্রসেনিয়াম মঞ্চনাটকে রূপান্তরিত হয়েছে। আর বাংলা নাটক পথনাটকের পথ ধরে এগিয়েছে সানন্দে-স্বাচ্ছন্দ্যে।