রোজ গার্ডেন বিংশ শতাব্দীর একটি ঐতিহ্যবাহী অনন্য স্থাপত্যশৈলীর রাজকীয় বাগানবাড়ি। এটি অবস্থিত পুরান ঢাকার টিকাটুলি কে. এম. দাস লেনে। এই রাজকীয় বাগানবাড়িতে রয়েছে কৃত্রিম ফোয়ারা, শান বাঁধানো পুকুর, ঝরনা, শ্বেতপাথরের মূর্তি। ইতিহাস ঐতিহ্য ও নানা ঘটনার কালের সাক্ষী রোজ গার্ডেন। আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠার পেছনে যেমন ইতিহাস রয়েছে তেমনি রোজ গার্ডেনের নির্মাণের পেছনে রয়েছে অপমান আর বঞ্চনার ইতিহাস।
পলাশীর প্রান্তরে বাংলার অস্তমিত সূর্য পুনরায় ভোরের আলোয় আলোকিত হয়েছিল এ বাগান বাড়িতেই। ঐতিহাসিক ও অনন্য স্থাপত্যশৈলীতে নির্মিত রাজকীয় বাগানবাড়িটির মালিকানা ও পটপরিবর্তনের পর বর্তমান সরকারের কাছে ভবনটি রাজনৈতিক কারণে অধিক গুরুত্বপূর্ণ। বর্তমান ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দল ‘বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ’-এর জন্ম ঐতিহাসিক রোজ গার্ডেনে। বঙ্গীয় প্রাদেশিক মুসলিম লীগের একাংশের সম্মেলনের মধ্য দিয়ে ১৯৪৯ খ্রিষ্টাব্দে ২৩ জুন ‘পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ’ প্রতিষ্ঠিত হয় ঐতিহাসিক রোজ গার্ডেন প্যালেসে। বেলা ৩ টায় সম্মেলন শুরু হয়। মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী ছিলেন সভাপতি। শামসুল হক সাধারণ সম্পাদক। সহসভাপতি ছিলেন আলী আমজাদ খান, আতাউর রহমান খান, আব্দুস সালাম খান প্রমুখ। যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক হন শেখ মুজিবুর রহমান। কোষাধক্ষ্য ইয়ার মোহাম্মদ খান। কেন্দ্রীয় সদস্যদের মধ্যে প্রথম মুসলিম মহিলা এম.এল.এ এডভোকেট আনোয়ারা খাতুন। আরো ছিলেন মাওলানা আব্দুর রশীদ তর্কবাগীস, ডক্টর খান সরোয়ার মুর্শিদের বাবা এডভোকেট আলী আহম্মদ খান, সাহিত্যিক, সাংবাদিক হিসেবে দেশ-বিদেশে ব্যাপক সুনাম অর্জনকারী আবুল মনসুর আহমদ প্রমুখ। এসময় শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন কারাগারে। অন্যদিকে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর সভাপতিত্বে পাকিস্তানের ক্ষেত্রে সংগঠনটির নামকরণ হয় ‘নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী লীগ’। পরবর্তীকালে, ১৯৫৫ খ্রিষ্টাব্দে ‘মুসলিম’ শব্দটি বাদ দিয়ে নাম রাখা হয় ‘পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ’। এই নামকরণের উদ্দেশ্য ধর্মনিরপেক্ষতার চর্চা ও অসাম্প্রদায়িক চেতনা প্রতিষ্ঠা।
১৯৫২ খ্রিষ্টাব্দের শেখ মুজিবুর রহমান সংগঠনের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯৬৬ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত ১৩ বছর সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন শেখ মুজিবুর রহমান। উল্লেখ্য, ‘পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ’ ছিল একমাত্র বিরোধী দল। ঢাকার ‘মুকুল’ প্রেক্ষাগৃহে সম্মেলনটি অনুষ্ঠিত হয়েছিল। ১৯৭০ খ্রিষ্টাব্দ থেকে এ নির্বাচনী প্রতীক নৌকা। স্বাধীনতার পর ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দে সংগঠনটির নামকরণ করা হয় ‘বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ’। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী দল হিসেবে পরিচিত। ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ গ্রন্থে দল গঠন সম্পর্কে বঙ্গবন্ধু বলেন, “সকলে একমত হয়ে নতুন রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান গঠন ; তার নাম দেওয়া হলো, ‘পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ’। মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী সভাপতি, জনাব শামসুল হক সাধারণ সম্পাদক এবং আমাকে করা হলো জয়েন্ট সেক্রেটারি।” [পৃষ্ঠা ১২০ ১২১]। স্বাধিকারের যে লড়াই বঙ্গবন্ধু শুরু করেছিলেন তা থেমেছিল বাঙালির স্বাধীনতা অর্জনের মধ্য দিয়ে। এভাবেই তিনি বাংলাদেশের মানুষের বঙ্গবন্ধু, জাতির পিতা হয়ে উঠেছেন।
বাঙালির গৌরবের ইতিহাস বাঁচিয়ে রাখার তাগিদ থেকে বর্তমান ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সরকার বাড়িটি কেনার সিদ্ধান্ত নেয়। দাম ধরা হয় ৩৩১ কোটি ৭০ লাখ ২ হাজার ৯ শত টাকা। সরকারি বিধি-বিধান মেনে বাড়িটি কেনা হয়।
রোজ গার্ডেনটি নির্মাণ করেন এক ধনী ব্যবসায়ী ঋষিকেশ দাস। নির্মাণ কাজ শুরু হয় ১৯৩০ খ্রিষ্টাব্দে। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে দুর্লভ প্রজাতির গোলাপ সংগ্রাহক ছিলেন ঋষিকেশ দাস। বাড়িটি রোজ গার্ডেন নামে পরিচিতি পায় এ কারণেই। শোনা যায়, জমিদার নরেন্দ্র নারায়ণ চৌধুরীর ‘বলধা’ জমিদার বাড়ির আদলে এটি তৈরি। উচ্চবিত্তদের সাংস্কৃতিক কেন্দ্র হয়ে ওঠা ‘বলধা’য় একদিন বিনা আমন্ত্রণে উপস্থিত হন ঋষিকেশ দাস। সনাতন ধর্ম অনুযায়ী নিম্নবর্ণের হওয়ায় তাকে অপমান করা হয়। পরবর্তীসময়ে রোজ গার্ডেন নির্মাণ করেন তিনি এ কারণেই।
ঋষিকেশ দাসের আত্মসম্মানের প্রতীক এই বাড়িটি ১৯৩৬ খ্রিষ্টাব্দে ব্যবসায়িক খান বাহাদুর মৌলভী কাজী আব্দুর রশিদের কাছে বিক্রি করে দেন তিনি। প্রতিষ্ঠা করা হয় এখানে বেঙ্গল স্টুডিও ১৯৭০ খ্রিষ্টাব্দে। ১৯৮৯ খ্রিষ্টাব্দে প্রতœতত্ত্ব বিভাগ রোজ গার্ডেনকে সংরক্ষিত ভবন বলে ঘোষণা করে। পরে পুনরায় এটি ব্যক্তি মালিকানায় ফেরত আসে ১৯৯৩ খ্রিষ্টাব্দে। ব্যক্তি মালিক রাকিবের কাছ থেকে বর্তমান সরকার এটি কিনে নেয়। এটি বর্তমানে সরকারি সম্পদ।
বিশ শতকের তৃতীয় দশকে বলধা জমিদার বাড়ি ছিল উচ্চবিত্তের সাংস্কৃতিক কেন্দ্র। বলধার জমিদার নিজে নাট্যকার বিধায় নিয়মিত তার বাড়িতে হতো সাংস্কৃতিক আয়োজন। ঋষিকেশ দাস নামে এক নব্য ব্যবসায়ী বলধার এক জলসায় বিনা আমন্ত্রণে উপস্থিত হন। কিন্তু তিনি নিম্নবর্ণের হওয়ায় তাকে অপমান করা হয়। এই অপমানের কারণেই তিনি বলধার মতো একই রকম বাগান ও বাড়ি নির্মাণে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ হন। এমন একটি কাহিনি প্রচলিত রয়েছে রোজ গার্ডেন নির্মাণের পেছনে।
বাগানের নির্মাণের কাজ শুরু করেন ঋষিকেশ দাস ১৯৩০ খ্রিষ্টাব্দে। চীন, ভারত, জাপান ও ইউরোপের বিভিন্ন দেশ থেকে মাটিসহ গোলাপ-চারা এনে তিনি বাগান নির্মাণ করেছিলেন। এই গোলাপ বাগানের মধ্যে তিনি বাড়ি নির্মাণের কাজ শুরু করেন। বাগানের জন্যই বাড়িটির নাম হয় রোজ গার্ডেন। তার সম্মানের প্রতীক এ-বাড়িটি ১৯৩৬ খ্রিষ্টাব্দে ঋণের দায়ে খান বাহাদুর মৌলভী কাজী আব্দুর রশিদের কাছে বিক্রি করে দেন। ১৯৭০ খ্রিষ্টাব্দের বেঙ্গল স্টুডিওকে এটি লিজ দেওয়া হয়। ১৯৮৯ খ্রিষ্টাব্দে প্রতœতত্ত্ব বিভাগ সংরক্ষিত ভবন বলে একে ঘোষণা করে। ১৯৩৭ খ্রিষ্টাব্দে প্রথম হাত বদল হয়। কাজী হুমায়ুন বশির ১৯৬৬ খ্রিষ্টাব্দের রোজ গার্ডেনের মালিক হন। এ সময় বাড়িটি পরিচিতি লাভ করে ‘হুমায়ুন সাহেবের বাড়ি’র নামে। বাড়িটি বেঙ্গল স্টুডওর কাছে ভাড়া দেন তিনি ১৯৭০ খ্রিষ্টাব্দে। ‘হারানো দিন’ চলচ্চিত্রটি এই বাড়িতে চিত্রায়িত হয়েছিল। ১৯৯৩ খ্রিষ্টাব্দে হুমায়ুন সাহেবের বংশধর কাজী রাকিবের অধিকারে পুনরায় ফিরে আসে বাড়িটি। পরবর্তীসময়ে সরকার এটি কিনে নেয়।
রাজনৈতিক গুরুত্বের বাইরে রোজ গার্ডেনের নির্মাণশৈলী স্থ’াপত্যের এক অনন্য নিদর্শন। স্থাপত্যটি মোঘল স্থাপত্য, ব্রিটিশ উপনিবেশবাদ, লোকজ ও ইউরোপীয় স্থাপত্যে অসাধারণ মেলবন্ধন দেখা যায়। দু’টি মূল প্রবেশ পথ আছে রোজ গার্ডেনের পশ্চিম এবং উত্তর বাহুর মধ্যবর্তী অংশে। একটি বিস্তীর্ণ খোলা প্রাঙ্গণ চোখে পড়বে পশ্চিম দরজার প্রবেশ ও বাহির পথে। সেখানে দাঁড়িয়ে আছে মঞ্চের উপর সুদৃশ্য নারীমূর্তি। এটি আয়তকার পুকুর রয়েছে মধ্যবর্তী অংশের। পুকুরের মাঝামাঝি রয়েছে সান বাঁধানো পাকা ঘাট। একটি পশ্চিমমুখী দোতলা ইমারত রয়েছে ঘাটের পূর্ব দিকে। ইমারতের সামনে রয়েছে একটি ফোয়ারা। ইমারতের প্রথম তলায় যাওয়া যায় সাত ধাপবিশিষ্ট সিঁড়ি দিয়ে। কোঠরের পাশাপাশি তিনটি খিলান দরজা আছে যার অবস্থান এর সামনের দিকে মাঝামাঝি অংশে। পডিয়াম দেখা যায় প্রতিটি খিলানের উপর। লতাপাতার নকশা ও রঙিন কাচ দিয়ে টিমপেনামগুলো শোভিত। উপবৃত্তাকার ব্যালকনি বাইরের দিকে বেরিয়ে আছে সামনে দিয়ে। করিনথীয় পিলার আছে এর দু’পাশে একটি করে মোট দু’টি। প্রতি তলায় পিলারগুলোর দু’পাশে একটি করে দরজা আছে। ভ্যানিশিং ব্লাইন্ড ও টিমপেনামে লতাপাতার নকশা দেখা যায় এদের প্রতিটি কাঠের পাল্লায়। সামনে অপ্রশস্ত খোলা বেলকনির অংশে রয়েছে বেলস্ট্রেড নকশা। বড়ো আকারের ছত্রী আট কোণাকার ও খিলান সংবলিত যা ছাদের মধ্যবর্তী অংশে রয়েছে। একটি গোলাকার গম্বুজ দিয়ে ঢাকা এর ছাদ। এছাড়াও উপরের দিকে দুই কোণে দু’টি করিনথীয় পিলার আছে। এদের উপরেও ছত্রী নকশা রয়েছে। প্রতি তলায় মোট ছোটো বড়ো ১৩টি কোঠা আছে। দ্বিতীয় তলায় রয়েছে একটি ঘূর্ণায়মান সিঁড়ি। সব মিলিয়ে রোজ গার্ডেন একটি অসাধারণ বাগানবাড়ি।