শীতরাজার রাজ্যপাট

14 Feb 2023, 02:41 PM অভোগ শেয়ার:
শীতরাজার রাজ্যপাট

আমাদের দেশে তো শীতকাল মানেই উৎসবের সময়। পিঠাপুলি, খেজুরের রস, শীতের ছুটিতে নানি-দাদি বাড়িতে যাওয়ার ধুম। নতুন নতুন শীতের কাপড়ের নানা ফ্যাশন সব মিলিয়ে শীতকালটা দারুণ কাটে আমাদের। কিন্তু এবারের শীতটা যেন একটু উৎসবের আমেজে কিছুটা হলেও ভাটা পড়েছে। আমাদের এত অল্পতেই এই অবস্থা ! অনেক দেশে তো এই সময়টাতে বরফও পড়ে! তবে, অনেক দেশ আছে এই বিশ্বে, যে-দেশের মানুষের কাছে শীত ততটা জনপ্রিয় নয়। বরং শীত তাদের কাছে যন্ত্রণার মতো, খানিকটা সূর্যের আলোর অপেক্ষায় হা-পিত্যেস করে কাটে তাদের দিন। এই দেশগুলো হলো পৃথিবীর সবচেয়ে শীতলতম দেশ। তাদের বিছানার পাশেই রাখতে হয় ফায়ার প্লেস বা আগুনের ব্যবস্থা ; না হলে তাদের নিউমোনিয়ায় যখন তখন আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। চলুন জেনে নিই কোন কোন দেশের অধিবাসীরা এমন অবস্থায় দিন কাটায়। লিখেছেন ফাতেমা ইয়াসমিন...


অ্যান্টার্কটিকা

এতে সন্দেহ নেই যে অ্যান্টার্কটিকাই পৃথিবীর সবচেয়ে শীতল দেশ। এটা পৃথিবীর একেবারে উত্তরে অবস্থিত। বছরের খুব অল্প সময়েই এখানে দিনের আলো দেখা যায়। এখানে লোকসংখ্যা নেই বললেই চলে, এমন হাঁড় কাঁপানো ঠান্ডার দেশে মানুষ থাকবেই বা কেমন করে ! সর্বনিম্ন রেকর্ড হয়েছে ৮৯ ডিগ্রি। ভাবা যায় ! এই তাপমাত্রায় বেঁচে থাকার কথা কল্পনায় আনা যায় না।

অ্যান্টার্কটিকায় মানুষ স্থায়ীভাবে বাস করে না, তবে মহাদেশজুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে বিভিন্ন গবেষণা স্টেশনে ১০০০ থেকে ৫০০০ মানুষ বছরে বিভিন্ন সময় অবস্থান করে। শীতের সঙ্গে লড়াই করতে সক্ষম উদ্ভিদ ও প্রাণীই এই মহাদেশে টিকে থাকতে সক্ষম, যার মধ্যে পেঙ্গুইন, সিল, সাইট, বিভিন্ন প্রকার শৈবাল এবং অন্যান্য তুন্দা উদ্ভিদ উল্লেখযোগ্য। ওখানে কোনো শাকসবজির চাষ হয় না। যারা বসবাস করে তারা বাইরে থেকে হিমায়িত খাদ্য এনে রাখে।


রাশিয়া

রাশিয়াকে বলা হয় ভদকায় ভেসে যাওয়া দেশ। আসলে অসম্ভব ঠান্ডাকে পাশ কাটানোর জন্যই রাশিয়ার মানুষেরা ভদকা খায়। এতে শরীরটাও চাঙ্গা হয় স্বাস্থ্যটাও নাকি ভালো থাকে। তাদের শীতকালে ঠান্ডার তীব্রতা এতটাই যে, গরমের দিনই তাদের তাপমাত্রা থাকে মাইনাস ৩ ডিগ্রি। বুঝুন অবস্থা ! তাহলে শীত কত থাকে ? শীতে থাকে মাইনাস ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াস। রাশিয়ার কিছু কিছু এলাকা আছে যেখানে মাত্র দুই মাসের জন্যই সূর্যের দেখা পাওয়া যায়। শীতে তুষার পড়ার কারণে আবহাওয়া হয়ে পড়ে একদম শুষ্ক। আসলে শীতে নিজেদের বাঁচিয়ে রাখা রাশিয়ার মানুষদের জন্য এক পরীক্ষা বলা চলে!

রাশানরা প্রচুর গরম স্যুপ ও মাংস পছন্দ করে। সেইসঙ্গে ওখানে উন্নতমানের শাকসবজিও ফলে প্রচুর। সালাদ ও পানীয় খাবার টেবিলে থাকতেই হবে রাশানদের।


কানাডা

আমেরিকার প্রতিবেশী এই রাষ্ট্রটি কিন্তু পৃথিবীর অন্যতম ঠান্ডা দেশগুলোর একটি। যদিও এর আবহাওয়া অনেকটাই আমেরিকার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ তবে উত্তরের দিকটায় শীতের সময়টা দারুণ ঠান্ডা। উত্তর ও পশ্চিমের জায়গাগুলোয় বছরের পাঁচ মাসই শীত থাকে। আর তাপমাত্রা চলে যায় মাইনাস ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে। তবে দেশের প্রযুক্তির উন্নয়নের কল্যাণে সে দেশের প্রাচীন শহরগুলোর অধিবাসীদের ঠান্ডা পোহাতে হয় না। কানাডার মানুষ খুব বেশি জুস পছন্দ করে। তাছাড়া বিভিন্ন প্রকার স্যুপ, মাছ, সাংস। শুকনো টিনজাত খাবারের প্রচলন সেদেশে অনেক বেশি।


কাজাকাস্তান

রাশিয়ার প্রতিবেশী স্বল্প পরিচিত কাজাকাস্তান হলো আরেকটি দেশ যেটি শীতের ঠান্ডায় আবৃত। এটি এশিয়ায় অবস্থিত। দেশটি পৃথিবীর অন্যতম ঠান্ডা দেশ হিসেবে পরিচিত। গ্রীষ্মের তাপমাত্রা মোটামুটি সহনীয়। তবে, শীতের সময়টায় থাকে তীব্র শীত। এটি পাহাড়ের দেশ হিসেবেও খ্যাত। পাহাড়ে যেসব মানুষ বসবাস করে তাদের পক্ষে জীবন ধারণ সত্যিই কঠিন। দরিদ্র দেশ হওয়ার কারণে রাষ্ট্রও ওদের সহজ বসবাসের জন্য তেমন পদক্ষেপ নিতে পারে না। তুষারপাত ও শীতের সময় হঠাৎ বৃষ্টি জনজীবনকে আরো দুঃসহ করে তোলে। কাজাকাস্তানের মোট আয়তন ২.৭ মিলিয়ন বর্গকিলোমিটার, যা দেশটিকে পৃথিবীর নবম বৃহত্তম দেশের মর্যাদা এনে দিয়েছে। কাজাকাস্তান পৃথিবীর বৃহত্তম স্থলভূমিবেষ্টিত দেশ।

ঘোড়ার মাংস এদেশে বেশ জনপ্রিয়। তাছাড়া চার রকমের মাংসের তৈরি ‘কাজাক’ এখানের জনপ্রিয় খাদ্য। বিভিন্ন অনুষ্ঠানে উটের মাংস পরিবেশনের রেওয়াজ বেশ পুরনো। তাছাড়া মান্ডি, পিলাফ, শিলপিক নামের বৈচিত্র্যপূর্ণ খাদ্যাভাস দেখা যায় এ অঞ্চলের মানুষের মধ্যে।


দ্য ইউনাইটেড স্টেটস অব আমেরিকা

আশ্চর্য হলেও সত্য পৃথিবীর অন্যতম ঠান্ডা দেশের তালিকায় আমেরিকার নামও আছে। যদিও আমেরিকার অনেক জায়গা আছে যেগুলো পৃথিবীর মধ্যে অন্যতম উষ্ণ স্থান হিসেবে পরিচিত। যেমন : ভ্যালি অব ডেথ। তবে আমেরিকার উত্তরে অবস্থিত আলাস্কা পৃথিবীর অন্যতম ঠান্ডা জায়গা। উত্তর-পশ্চিম আমেরিকার অঞ্চলগুলোতে শীতকালীন তাপমাত্রা মাইনাস ৩০ ডিগ্রি সেলসিয়াস। ওই অঞ্চলের মানুষ প্রায়ই ঠান্ডাজনিত চর্মরোগে ভোগে। বলা যায় ওখানকার অধিবাসীরা জাঙ্কফুডের ওপরই বেঁচে থাকে। হট ডগ, হামবার্গার ছাড়া তো আমেরিকার মানুষকে কল্পনাই করা যায় না। তাছাড়া পিৎজা, টেকো, চকোলেট, জেলি, বিন, আইসক্রিম, পটেটো সালাদ, নানা রকম মাংসের তৈরি খাদ্য দারুণ জনপ্রিয় আলাস্কায়।


গ্রিনল্যান্ড

ডেনমার্কের অধীনে পৃথিবীর সবচেয়ে বড়ো দ্বীপটিই হলো গ্রিনল্যান্ড। নাম শুনে এটিকে চির সবুজ ভাবার কোনো কারণ নেই ! কারণ এটিই পৃথিবীর অন্যতম আরেকটি শীতলতম দেশ। পুরো দেশটাই বরফে ঢাকা, সূর্যের আলোর দেখা মেলা ভার। গরমের সময়েই সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস। তাই বুঝে নিন, শীতে তাপমাত্রা কত হতে পারে ! বলা যেতে পারে বিভিন্ন প্রকার মাংসই গ্রিনল্যান্ডের মানুষের প্রধান খাদ্য। তাছাড়াও বিভিন্ন ধরনের মাছ এখানে পাওয়া যায়। তাছাড়া গ্রিনল্যান্ডবাসী বিভিন্ন শাকসবজি ও আলু দিয়ে তৈরি খাবার প্রচুর খায়।


আইসল্যান্ড

নামেই বোঝা যাচ্ছে এটি বরফের দেশ। আইসল্যান্ড মূলত স্ক্যান্ডেনেভিয়ান দেশের অন্তর্ভুক্ত যা ইউরোপ মহাদেশে অবস্থিত। এর তাপমাত্রা শূন্য [০] ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে। গ্রীষ্মের সময়ই তাপমাত্রা শূন্যের ওপরে সামান্য ওঠে। উত্তরের এই দেশটিতে গ্রীষ্মের সময়ই সূর্যের দেখা মেলা ভার। সর্বনিম্ন তাপমাত্রা এখানে মাইনাস ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এখানকার বেশিরভাগ খাবারদাবারই সংরক্ষণ করা হয়ে থাকে। হিমায়িত খাবারই বেশি খেতে হয়। তবে সামুদ্রিক এলাকার কারণে প্রচুর মাছ পাওয়া যায়। এখানকার অধিবাসীরা শার্কের মাংস খুব পছন্দ করে। মাংসের মধ্যে ভেড়ার মাংসের জনপ্রিয়তা বেশি। তাছাড়া গরুর মাংসও খায় এখানকার অধিবাসীরা।


মঙ্গোলিয়া

পূর্ব এশিয়ার ঠিক মাঝের ছোট্ট একটি দেশ মঙ্গোলিয়া। এটির সব সংস্কৃতিই গড়ে উঠেছে এশিয়া থেকে। তবে, এর ঠান্ডা তাপমাত্রা এসেছে উত্তর থেকে। এর তাপমাত্রা বেশিরভাগ সময়েই শূন্য ডিগ্রি সেলসিয়াসে থাকে, তবে সেটা এপ্রিল থেকে অক্টোবর পর্যন্ত। কিন্তু বাকি মাসগুলোতে তাপমাত্রা মাইনাস ২০ ডিগ্রি সেলসিয়াসে নেমে যায়। তবে জানুয়ারি-ফেব্রæয়ারি মাসে ঠান্ডার প্রকোপ এত বেশি থাকে যে, তখন মঙ্গোলীয়দের জীবনযাপন কঠিন হয়ে ওঠে।

বৈচিত্র্যে ভরপুর মঙ্গোলিয়ানদের খাদ্যভাÐার। ছাগল, ভেড়া, ঘোড়া, সব প্রাণীর মাংসই দারুণ জনপ্রিয় সেদেশে। তবে স্যুপের প্রচলন বেশি। এইসব প্রাণীর দুধ দিয়ে তৈরি মিষ্টিজাতীয় খাবার এককথায় দারুণ। আরুল নামের একজাতীয় খাবার এরা তৈরি করে যা দুধ জমাট বেঁধে তৈরি হয়। যা খেতে দারুণ আর এটি নাকি দাঁতের জন্যও বেজায় উপকারী। তাছাড়া মাংসের তৈরি হরহগ, বোডগ, বাজ বানটান প্রভৃতি এখানকার জনপ্রিয় খাবার।


ফিনল্যান্ড

স্ক্যান্ডেনেভিয়ার সুন্দর এই দেশটির শীতকাল পৃথিবীর মধ্যে শীতলতম ঋতু। শীতের প্রকোপ অসহ্য হয়ে দাঁড়ায় যখন তাপমাত্রা মাইনাস ২০ ডিগ্রি সেলসিয়াসে নেমে আসে। এখানে শীতকালের স্থায়িত্ব চার মাস। তীব্র তুষারপাত, সেই সঙ্গে ঠান্ডা বাতাস জনজীবনকে কঠিন করে তোলে। তবে গরমকাল এখানে বেশ আরামদায়ক। ফিনল্যান্ডে বিয়ার, অ্যালকোহল চলে প্রচুর। তাছাড়া বিভিন্ন প্রকার স্যুপ, মাছের তৈরি সকালের নাশতা, বছরের নতুন আলুর তৈরি নানা পদ, মাংস সবই খায় ফিনল্যান্ডের জনতা। সি ব্যাকথন, হেররিং, ভালকোসিপুলি স্যুপ, নানরুটি, সালমাক্কি, পুল্লা প্রভৃতি খাবার ফিনল্যান্ডে দারুণ জনপ্রিয়।


এস্তোনিয়া

কেউ কেউ হয়ত এস্তোনিয়ার নামও শোনেননি। তবে জেনে নিন পৃথিবীর অন্যতম ঠান্ডা দেশগুলোর মধ্যে এটি একটি। ফিনল্যান্ড ও বাল্টিক সাগরের মধ্যে এটির অবস্থান। ঠান্ডার প্রকোপ অন্যদেশগুলোর মতো এত না হলেও শীতের সময়টা এখানে জীবন ধারণ কষ্টকর হয়ে দাঁড়ায়। গ্রীষ্মের সময়ও যে তাপমাত্রা বেশি থাকে তা নয়। তাই এস্তোনিয়ায় সবসময়ই শীতকাল। এস্তোনিয়ার মানুষদের প্রধান খাদ্য তাদের হাতে তৈরি একপ্রকার কালো রুটি। তাছাড়া এরা প্রচুর মাছ ও মাংস খেতে পছন্দ করে। প্রচুর টিনজাত খাদ্যও নিয়মিত খেতে হয় তাদের। সুপার মার্কেটগুলোতে নানা ধরনের শুকনো খাবার পাওয়া যায়। এস্তোনিয়ানরা হাতে তৈরি খাবার খেতেই বেশি পছন্দ করে।