ইউরোপের ১৫০ দিন -সৈয়দা তাসলিমা আক্তার

08 Dec 2022, 01:14 PM ভ্রমন শেয়ার:
ইউরোপের ১৫০ দিন -সৈয়দা তাসলিমা আক্তার

[পূর্ব প্রকাশিতের পর]


বার্গেনে একটি রৌদ্রমুখর দিন পাওয়া অনেক ভাগ্যের ব্যাপার। আগেই বলেছি বার্গেন অসম্ভব সুন্দর একটি শহর তবে একটু ছিচকাঁদুনে এই আরকি। রৌদ্রমুখর দিনগুলো যেন এখানে ঈদের আমেজ নিয়ে আসে, ইউনির্ভাসিটির ক্লাসগুলোও ছোটো হয়ে আসে, আসলে সকলেই চায় দিনটা উপভোগ করতে। পরপর বেশ কিছু দিন আকাশের মন অপ্রত্যাশিতভাবে ভালো যাচ্ছে। দিনটি বোধকরি বৃহস্পতিবার, নিয়ম মাফিকই আমাদের অফ-ডে, আগের রাতেই আমি আর ফারজানা মিলে প্রোগ্রাম সেট করে নিয়েছি, আবহাওয়া ভালো থাকলে সকাল সকাল বেরিয়ে পড়ব ; সেই মতো প্রস্তুতি নিয়ে রাখলাম। যাক, ভাগ্য সুপ্রসন্ন ছিল পরদিন সকালেও সূর্য তার ঝলমলে আলোকচ্ছটায় ভোরকে রাঙিয়ে দিল। আর রুপালি আলোর আমন্ত্রণ গ্রহণ করে আমরাও সাত তাড়াতাড়ি নাশতা সেরে বেরিয়ে পড়লাম ; সঙ্গে টুকিটাকি কিছু রসনা-রসদ নিতে ভুললাম না, সারাদিন না হোক, দিনের সিংহভাগ বাইরে কাটবে, এটা নিশ্চিত তাই এ প্রস্তুতি।

প্রথমে আমরা ফ্যান্টপ স্টেশন থেকে লাইট ট্রেনে উঠলাম, যেটা বিবান নামেই অধিক পরিচিত, বিবানে আমরা নেসটুন টার্মিনাল (Nesttun Terminal) পর্যন্ত গেলাম, সেখান থেকে বাসে। তবে, বাস নাম্বার আর স্টপেজের নাম এখন বেমালুম ভুলে গেছি। তবে স্থানটা যে বার্গেন শহরের একপ্রান্তে ছিল এটা নিশ্চিত করে বলতে পারি। আমাদের উদ্দশ্য ছিল সৈকত দর্শন, আগেই বলেছি বার্গেন সমুদ্রের পেটের মধ্যে ঢুকে থাকা একটা শহর ; যার এখানে সেখানে দেখা মেলে গভীর খাড়ি কিন্তু সৈকতের দেখা এখনো পর্যন্ত আমরা পাইনি। আগেও একবার সৈকত সন্ধানে গিয়ে ঝরণার নাচন দেখে ফিরে এলাম। সময় যদিও খুব ভালো কেটেছিল তবে ঐ সৈকত দেখা না পাওয়ায় আকুতি- সেটা রয়েই গেল তাই আজ আবার নতুন পথে এই যাত্রা যদি সৈকতের দেখা মেলে। আসলে সমুদ্র দেখবো আর সৈকতে পা ভিজিয়ে হেঁটে বেড়াবো না এটা যেন মানা যায় না। খাড়ি থেকে সমুদ্রকে দেখতে হয় দূর থেকে খানিকটা ভয় নিয়ে আর সৈকত থেকে সমুদ্রকে পাওয়া যায় আপন করে। তবে, খাড়ির অবশ্য ভিন্ন সৌন্দর্য আছে, সমুদ্র খাড়িগুলোতে ছোটো-বড়ো কোনো-না-কোনো জেটি অবশ্যই থাকে, অন্তত বার্গেনে তো আছ্ইে। খাড়ি থেকে সমুদ্র দেখার মজা হচ্ছে দূর-দূরান্তের জাহাজের আগমন-প্রস্থান দেখার সঙ্গে সঙ্গে ভিন্ন দেশের মানুষের আগমন-প্রস্থান দেখা তাদের জীবনের এক টুকরো ছবির সঙ্গে পরিচিত হওয়া, কল্পনায় তাদের সাথে ভিনদেশে ঘুরেও আসা যায়। যাক বাবা সৈকত দেখতে যাওয়ার কথায় কল্পনায় ভিন্ন দেশ ভিন্ন জগৎও ঘুরে এলাম। আসলে আমার ইউরোপ ভ্রমণ নিয়ে লেখাটা অনেকটাই স্মৃতিচারণ আর স্মৃতির ডানা খুব বেশি পেছন পানে ছোটে।

আমরা প্রায় ঘণ্টাখানেক বাদে আমাদের নির্ধারিত গন্তব্যে পৌঁছালাম, এর পুরোটা সময় যে বাসে বা ট্রেনে কেটেছে তা নয় , কিছুটা সময় কেটেছে নির্ধারিত বাসের অপেক্ষায় আর কিছুটা পায়ে পথে পথে হেঁটে। এখানে এসেও আদতে আমরা সৈকত খুঁজে পাইনি, তবে সমুদ্রের জলে পা ভেজানোর সুযোগ কিছুটা হয়েছিল, সে কথায় পরে আসছি। এটাও কিন্তু একটা ছোটোখাটো জেটি, পুরো এলাকাটা বেশ ছিমছাম করে সাজানো। সমুদ্রের পার ঘেষে কাঠের পাটাতন, বেশ কিছু দৃষ্টিনন্দন বাড়ি, রয়েছে নান্দনিক স্থাপনাও। বুঝলাম, এটা জেটি এলাকা হলেও এ স্থানটি আসলে পর্যটকদের জন্য বিশেষ ভাবে সাজানো। আর যে দৃষ্টিন্দন বাড়িগুলো রয়েছে সেগুলো মূলত নানা স্তরের তারকাখচিত হোটেল-মোটেল। যদিও এখনও বার্গেনে সূর্যের আলোয় রূপরাঙা ঝলমলে দিনের দেখা মেলে কিন্তু ক্যালেন্ডারের পাতা অনুযায়ী ইতোমধ্যে পর্যটন মৌসুমে ভাটা পড়ে গেছে। সাধারণত অক্টোবরের শেষ থেকেই নরওয়েসহ প্রায় সমগ্র ইউরোপ আঁধারের সাথে সখ্য-চুক্তি করে নেয়। ভাবছেন সখ্য-চুক্তি এ আবার কী ? মজা করলাম। আসলে এ সময় থেকে দিনের দৈর্ঘ্য কমতে কমতে সাত/আট ঘণ্টায় নেমে আসে, শীতের তীব্রতায় আর কুয়াশার আধিপত্যে সূর্যও যেন নিজের তেজ লুকিয়ে বাঁচে। তবে এবার নাকি ব্যতিক্রম, শুনেছি গত পঞ্চাশ বছরেও ইউরোপে এত চমৎকার আবহাওয়ার দেখা মেলেনি। নভেম্বর মাসের বেশ কিছু দিন গত হওয়া সত্তে¡ও সূর্যের সতেজ ঝলকানি দেখা যায়। নেই হাড়-কাপানো শীতের তীব্রতা, আর কুয়াশাও বেশ রয়ে-সয়েই পড়ছে ; সব কিছু মিলে বেশ স্বস্তিদায়ক একটা সময়, সে দিক থেকে আমাদের বেশ ভাগ্যবানই বলা যায়। তবে বিষয়টি ব্যতিক্রম বলেই হয়ত এ সময় পর্যটকদের আনাগোনা স্বাভাবিক ভাবেই কম। কেননা, কে আর গাঁটের পয়সা খরচ করে নাতিদীর্ঘ দিনের এ সময় নরওয়ে ভ্রমণ করতে চাইবে। তবে এটা আমাদের এক অন্য অভিজ্ঞতার স্বাদ দিল, মনে হলো যেন আমরা রূপকথার ডালিমকুমার-কঙ্কাবতীর রাজ্যে চলে এলাম। কোনো এক জাদুর ছোঁয়ায় সমগ্র রাজ্য যেন এক ঘুমন্ত পুরীতে পরিণত হয়েছে। মোটেই বাড়িয়ে বলছি না, আনন্দ-বিনোদন আর প্রশান্তির সকল আয়োজন বিরাজমান শুধুমাত্র যাদের জন্য এ আয়োজন তারাই অনুপস্থিত। আমরা জোটির মাঝামাঝি স্থান থেকে হাঁটতে শুরু করে একপ্রান্তে পৌঁছে গেলাম, যার পুরোটাই কাঠের পাটাতন দিয়ে তৈরি ওয়াকওয়ে। আর সমুদ্রের পারকে নির্দিষ্ট সীমায় রাখতে ব্যবহার করা হয়েছে বিশাল আকৃতির পাথর। কাঠের ওয়াকওয়ে থেকে চাইলে পাথরের এবড়ো-থেবড়ো সিঁড়ি বেয়ে জলের কিছুটা কাছ অবদি যাওয়া গেলেও সেখান থেকে জল ছুঁতে যাওয়া বেশ বিপজ্জনক। তারপর পা ভেজানোর একটা ব্যর্থ চেষ্টা আমাদের ছিল। তবে কাঠের পাটাতন শেষে পাথর মোড়ানো পথ নেমে গেছে জলের কিনার অবদি, কৃত্রিম উপায়ে হলেও এখানে জল-স্থলের এক মেলবন্ধন ছিল, যেখান থেকে জলে পা ডোবানোর ব্যবস্থা ছিল, এখানটাতে এসে আমরা দু’জন মানুষের দেখা পেলাম। মনে হলো যেন অনেকটা পথ ভুলেই তারা এখানে।

বোঝা যায়, এপাশটাতেই পর্যটকদের আনাগোনা বেশি থাকে, সিজনে সম্ভবত এ জায়গাটায় প্রবেশাধিকার সংরক্ষিত থাকে। কেননা, এখানে রয়েছে প্রাইভেট বোড, আছে সৌখিন মাছ শিকারীদের জন্য মাছ ধরার ব্যবস্থা আর আমাদের মতো সৌখিন ভবঘুরেদের জন্য সীমাহীন সমুদ্রের বিশালতা আর গভীর নির্জনতা। এ দিকটাতে গাছপালার সংখ্যা প্রায় চোখে না পড়ার মতোই ; আমরা দু’জন আর হঠাৎ দেখা পাওয়া দু’জন আগন্তক ছাড়া সমুদ্রের ছোটো ছোটো ঢেউ ছাড়া চলমান আর কিছুই চোখে পড়েনি অনেকক্ষণ। আমরা এখানে এসেছি তাও বোধহয় ঘণ্টাদেড়েক হয়ে গেছে। বেড়েছে দিনের বয়স সাথে সূর্যের তেজ। জ্বলজ্বলে র্সূযটা নিজের প্রতিবিম্ব জলে ফেলে যেন এর অতল তলদেশ দেখতে চাইছে। আমরা তখন পাটাতনে থাকা সারিসারি টেবিল চেয়ারের একটি দখল করে নিজেদের সাথে আনা রসদ দিয়ে রসনার প্রয়োজন মিটাচ্ছি। মাঝে দেখা গেল সূর্য আর মেঘের লুকোচুরি খেলা, না আমরা আকাশের দিকে তাকিয়ে নেই জলের বিশাল আয়নায় দেখছি র্সূয আর মেঘের লুকোচুরি, সাথে জলের রঙের অদ্ভুদ রং বদল। না, সূর্যের তেজ আর আমাদের খোলা আকাশের নিচে বসে থাকতে দিল না। ঘড়ির কাঁটায় সময় তখন সবে দুপুর একটা, আরো সময় থাকার ইচ্ছে থাকা সত্তে¡ও প্রচÐ তাপের কারণে আমাদের উঠতেই হলো। ফেরার আগে একটু এদিক-সেদিক ঢুঁ মারতে গিয়েই দেখা মিলল নুড়ি বিছানো একটি সরু পথের, খানেক হেঁটে যেতেই কানে এলো সমুদ্রের ছোটো ছোটো ঢেউ আছড়ে পড়ার শব্দ। জায়গাটা বেশ অগোছালো, একটু বুনো ধাঁচের পুরো এলাকার সঙ্গে যেন একটু বেমানান। তবে, এখানেই দেখা মিলল ছোট্ট এক টুকরো সৈকতের। আসলে সৈকত না বলে সৈকতের মতো বলা যায়। এবড়ো-থেবড়ো বালি আর ছোটো ছোটো পাথর মেশানো সমুদ্র পার যেখানে ঢেউগুলো এসে আছড়ে পড়ছে। খালি পায়ে এখানে হাঁটা সম্ভব নয় তাই জুতো পায়েই চলল কিছুটা পায়চারি আর দু’-একটা ছবি তোলা। পাশে অবশ্য ছোটো মতো একটি কংক্রিটের সেতু যা অনেকটা ঢুকে গেছে সমুদ্রের ভেতরে, যেখানে আবার সিঁড়ি করা আছে যা দিয়ে সমুদ্রে নামা যায়। বোঝা গেল এপাশটায় সমুদ্র অগভীর হয়ে জল-স্থলে এক হয়ে গেছে। কিছু এলোমেলো গাছ থাকায় বাতাস ছিল, ফলে একটু স্বস্তিদায়ক পরিবেশ পেয়ে আমরা কিছুটা সময় এখানে রয়ে গেলাম। তারপর এক সময় যথারীতি ফিরতেই হলো...  [চলবে]