হলমুখী হচ্ছেন দর্শক। জমে উঠেছে চলচ্চিত্র অঙ্গন। সবমিলিয়ে আবার চলচ্চিত্র অঙ্গনে সুবাতাস বইতে শুরু করেছে। মুক্তিও পাচ্ছে বিগ বাজেটের ছবি। কিন্তু সমস্যা সিনেমা হল নিয়ে। দিন দিন সিনেমা হলের সংখ্যা এতটাই কমেছে যে, একসঙ্গে একাধিক সিনেমা মুক্তি পেলে সিনেমা হলের বণ্টন নিয়ে পড়তে হচ্ছে সমস্যায়। তাছাড়া অল্প সংখ্যক হলে সিনেমা মুক্তি দিয়ে প্রযোজকের লগ্নি ফেরত পাওয়াটাও অনিশ্চিত। বিস্তারিত লিখেছেন শেখ সেলিম...
বৈশ্বিক মহামারি করোনা ভাইরাসের প্রভাবে সারাবিশ্বের মতো বাংলাদেশেও থমকে যায় চলচ্চিত্র অঙ্গন। বেকার হয়ে পড়েন এই অঙ্গনের সঙ্গে জড়িত অনেকে। দীর্ঘদিন বন্ধ থাকে সিনেমার শুটিং ও প্রদর্শন। ধীরে ধীরে করোনার প্রভাব কমে এলে আবার সরব হয় এই অঙ্গনটি। তবে সেই সময়ে দর্শক হলমুখী না হওয়ায় বিগ বাজেটের ছবি মুক্তি দিতে সাহস পাননি প্রযোজকেরা। সেই সময়ে ওটিটি প্লাটর্ফম খুবই জনপ্রিয় ছিল, তাই অনেক ছবি সেখানে মুক্তি দেওয়া হয়। বর্তমানে দর্শক হলমুখী হওয়ায় ওটিটি প্লাটফর্ম অনেকটাই জনপ্রিয়তা হ্রাস পায়। এখন প্রতি সপ্তাহেই নতুন সিনেমা মুক্তি পাচ্ছে। ছবির তুলনায় হলের সংখ্যা কম হওয়ায় প্রযোজকেরা লগ্নি ফেরত পাওয়ার আশঙ্কায় রয়েছে। ‘হাওয়া’ ছবি মুক্তির পর দর্শকের উপচেপড়া ভিড় আবারও প্রমাণ করল ভালো গল্প হলে দর্শক সিনেমা দেখতে হলে আসেন। ছবিটি দেখতে দর্শকের এমনি আগ্রহ ছিল যে, অনেক আগে থেকে অনেকে টিকিট বুকিং দিয়েও পাননি। দর্শকের কথা চিন্তা করে হল কর্তৃপক্ষ হাওয়া ছবির প্রর্দশনের সময়ও বাড়ান। এই প্রসঙ্গে স্টার সিনেপ্লেক্সের ঊর্ধ্বতন ব্যবস্থাপক মেজবাহ উদ্দিন বলেন, মূলত দর্শকের অগ্রিম টিকিট কেনার আগ্রহ ও চাপ অনুভব করেই প্রদর্শনের সংখ্যা বাড়ানো হয়। স্টার সিনেপ্লেক্সের হলগুলোতে একদিনে সর্বোচ্চ ২৬ বারও ছবিটি দেখানো হয়। এর আগে আর কোনো সিনেমারই এতগুলো শো একসঙ্গে প্রদর্শন হয়নি। এই ছবির সাফল্যর পর আরো দুটি ছবি মুক্তি পায় এর মধ্যে একটি বিগ বাজেটের ছবি।
২৩ সেপ্টেম্বর বিগ বাজেটের ছবি ‘অপারেশন সুন্দরবন’ মুক্তি পায়। ছবিটি প্রথম সপ্তাহে ৩৫টি হলে জায়গা করে নেয়। কিন্তু ধীরে ধীরে কমতে থাকে হলের সংখ্যা। তবে সিনেপ্লেক্সে ছবিটির শোর সংখ্যা বাড়ানো হয়। ঢাকার বাইরে কিছু একক হলে ছবিটির দর্শক থাকলেও পরে ধারাবাহিকভাবে একাধিক নতুন ছবির মুক্তির কারণে ছবিটি নামিয়ে দেওয়া হয়। এতে লোকসানের কবলে পড়েন ছবির প্রযোজক। যদিও মুক্তির আগে থেকেই সিনেমাটি নিয়ে আলোচনা ছিল, বিশেষ করে দীপংকর দীপনের ‘ঢাকা অ্যাটাক’ ছবিটি সুপার-ডুপার হিট হওয়ায়, অনেকে আশা করেছিলেন ‘অপারেশন সুন্দরবন’ ছবিটিও হিট হবে। কিন্তু সেটা আর হলো না।
‘অপারেশন সুন্দরবন’ ছবির পরিচালক দীপংকর দীপন বলেন, ‘ঢাকা ও ঢাকার বাইরে বেশ কিছু একক হলে ছবির দর্শক খারাপ ছিল না। কিন্তু পরপর নতুন ছবি মুক্তির কারণে তৃতীয় সপ্তাহ ও চতুর্থ সপ্তাহে এসে অনেক হল ছেড়ে দিতে হয়েছে। হল বেশি থাকলে এই সমস্যা হতো না।’
কিছুদিন আগেও শোনা গিয়েছিল, সিনেমার অভাবে হল বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু এখন এসে দেখা যাচ্ছে উল্টো চিত্র। হলের অভাবেই সিনেমার মুক্তি আটকে যাচ্ছে। ছবির মুক্তির সময় বেশিসংখ্যক হল পাচ্ছেন না প্রযোজকেরা। কমসংখ্যক হলে ছবি মুক্তি দিয়ে লোকসান গুনছেন তারা।
দীপংকর দীপন আরও বলেন, এখন ধীরে ধীরে প্রেক্ষাগৃহে গিয়ে সিনেমা দেখার আগ্রহ বাড়ছে দর্শকের। নতুন নতুন সিনেমা মুক্তি পাচ্ছে। কিন্তু হল কোথায় ? সীমিত হলসংখ্যার মধ্যে একাধিক সিনেমা মুক্তির কারণে হলগুলোতে বেশি দিন প্রদর্শনেরও সুযোগ থাকছে না নতুন ছবির। আবার কোনো কোনো জেলায় একটিমাত্র হল রয়েছে। একাধিক হল না থাকায়, অর্থাৎ বিকল্প ব্যবস্থা না থাকায় নতুন ছবি মুক্তি পেলেই আগের ছবিটি নামিয়ে ফেলতে হচ্ছে, যার ফলে একটি ছবি একাধিক সপ্তাহে চালানো সম্ভব হচ্ছে না। একটা সময় দেশে হলের সংখ্যা ছিল প্রায় দেড় হাজার, বর্তমানে নিয়মিত হলের সংখ্যা একশো বা তার কিছু বেশি। এরমধ্যে কিছু সিনেমা হল বিশেষ উপলক্ষে বা উৎসবের সময় খোলা হয়, সারাবছর থাকে বন্ধ। এই অল্প সংখ্যক হলে সিনেমা মুক্তি দিয়ে কী প্রযোজকেরা তাদের লগ্নি ফেরত পাবেন? এদিকে বৈশ্বিক মহামারির কারণে অনেক ছবিই আটকে ছিল, প্রযোজকেরা এখন সেই সিনেমাগুলো মুক্তি দিতে চাইছেন, কিন্তু সমস্যা হল বণ্টন। একসঙ্গে একাধিক ছবি মুক্তি পেলে হল ভাগ হয়ে যাওয়ায় সিনেমার প্রযোজকদের লোকসান গুনতে হচ্ছে। সবশেষ তথ্য অনুযায়ী মাসে বর্তমানে চার-পাঁচটি নতুন ছবি মুক্তি পাচ্ছে। কর্তৃপক্ষ বলছেন, হলসংকটের মধ্যে একাধিক নতুন ছবি মুক্তির সময় ভাগাভাগিতে বেশি হল পাচ্ছে না কোনো ছবিই। এতে করে সীমিত হল থেকে ব্যবসা তো দূরের কথা, লগ্নির অর্থই ফেরত আসছে না প্রযোজকদের ঘরে।
প্রযোজক ও পরিবেশকদের কথা, একটি নতুন ছবি মুক্তির সময় বেশি হল পেলে প্রথম সপ্তাহেই লগ্নির বড়ো অঙ্ক উঠে আসা সহজ হয়। কিন্তু হলসংকটের মধ্যে একাধিক নতুন ছবির মুক্তির কারণে সেই সুযোগ থাকছে না। এতে সব ছবির ক্ষেত্রেই আর্থিক ক্ষতি হয়ে যাচ্ছে। ‘যখন সিনেমার দিন আসছে, তখন হলসংকট তা চেপে ধরছে। কিছুদিন আগেও শুনেছি, সিনেমার অভাবে হল বন্ধ হচ্ছে। কিন্তু এখন দেখছি, হলের অভাবে সিনেমার জায়গা হচ্ছে না। এই সমস্যা দ্রুত সমাধান না হলে ভালো ভালো ছবি মুক্তি পেয়েও লাভ হবে না।’
শুধু কথায় নয়, সত্যি সত্যি দর্শকের দোরগোড়ায় বাংলা সিনেমা! বিশেষ করে ‘পরাণ’ ও ‘হাওয়া’র দৌলতে ঢাকাই সিনেমার এখন জয়জয়কার। নানা কারণে যে মধ্যবিত্ত শ্রেণি হলবিমুখ হয়ে পড়েছিলেন, তারা আবার হলে ফিরতে শুরু করেছেন। এটা বাংলা ছবির জন্য অভাবনীয় সাফল্য বলে মনে করছেন সিনে বিশ্লেকেরা। তবে এই সুবাতাসের মধ্যেও আছে শঙ্কা! কারণ বাংলা সিনেমার ইতিবাচক এই হাওয়া বদলের ধারাবাহিকতা রক্ষা করতে না পারলে ভেস্তে যাবে সব! আর তার জন্য নিয়মিত ভালো সিনেমার বিকল্প নেই বলেও মনে করছেন চলচ্চিত্র বোদ্ধারা। তারা মনে করছেন, পরপর গলুই, শান, পরাণ, দিন দ্য ডে এবং হাওয়ার মতো সিনেমা মুক্তি পাওয়ায় দর্শকের আগ্রহ আবার ব্যাপকভাবে দেখা যাচ্ছে। এই ধারাবাহিকতা রক্ষা করতে পারলে ও দর্শকদের পরিচ্ছন্ন পরিবেশে সিনেমা দেখার ব্যবস্থা করে দিতে পারলে সিনেমার সুদিন অব্যাহত থাকবে।