একজন কাহিনিকার সবসময় চেষ্টা করেন সর্বোচ্চ মেধা প্রয়োগ করে একটি ছবির প্লট তৈরি করতে। তেমনি একজন নির্মাতাও দর্শকদের সুন্দর একটি ছবি উপহার দিতে চেষ্টা করেন গল্পটিকে সুন্দরভাবে উপস্থাপন করে। অন্যদিকে অভিনয়শিল্পীরাও ভালো একটি গল্প পেলে আপ্রাণ চেষ্টা করেন স্ব-স্ব চরিত্রটিকে ফুটিয়ে তুলতে, সকলের মিলিত প্রচেষ্টায় তৈরি হয় একটি সফল চলচ্চিত্র। এছাড়াও একটি ছবি নির্মাণে কাজ করেন আরো বহুজন। যারা পর্দার পেছনে থাকেন। তৈরি হয় একটি শিল্প। ছবিটির সার্থকতা তখনই আসে যখন ছবিটি মুক্তি পায় এবং দর্শক গ্রহণ করে। আবার মন পীড়িত হয় যখন এত এত পরিশ্রমের, এত এত প্রচেষ্টার ফসলটি আটকে যায়। আনন্দভুবন পাঠকদের এমনই এক ছবির গল্প নিয়ে লিখেছেন শেখ সেলিম...
একটি দেশকে সুন্দরভাবে উপস্থাপন করার ক্ষেত্রে সেই দেশের চলচ্চিত্র শিল্প অনেক ভূমিকা রাখে। একটি চলচ্চিত্র অনায়াসে বলে দিতে পারে তার দেশের কৃষ্টি-সংস্কৃতির কথা। একটি দেশের সংস্কৃতি তার ধারক ও বাহক। আবার অপসংস্কৃতি একটি দেশের বারোটা বাজিয়ে দিতে পারে। এই জন্য প্রতিটি দেশের একটি নীতিমালা রয়েছে, যার ফলে কেউ এর বাইরে গিয়ে কাজ করতে পারেন না। সংস্কৃতির বড়ো একটি মাধ্যম চলচ্চিত্র, তাই চলচ্চিত্র নির্মাণের আগে একজন নির্মাতাকে খেয়াল রাখতে হয় দেশের আইনকানুন, সংস্কৃতি মেনে ছবিটির কাজ করা হচ্ছে কি না ? সেটা দেখতে আবার চলচ্চিত্রের সেন্সরবোর্ড গঠন করা হয়। তারাই ছবি মুক্তির আগে প্রদর্শন করে এবং সব ঠিক থাকলে সেন্সর সার্টিফিকেট প্রদান করে। অনেক ছবি আটকেও যায় সেন্সর বোর্ডের শর্তের খেলাপ হলে। বছর তিনেক আগে একটি ছবি আটকে দিয়েছে সেন্সর বোর্ড। ছবিটি হলো মোস্তফা সরয়ার ফারুকী পরিচালিত ‘শনিবার বিকেল’।
যদিও ছবিটি আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বেশকিছু চলচ্চিত্র উৎসবে প্রশংসিত হয়ে অনেকগুলো পুরস্কারও জিতেছে। তথাপি নির্মাণের সাড়ে তিন বছরেও সিনেমাটি দেশের প্রেক্ষাগৃহে মুক্তি দিতে পারছেন না নির্মাতা প্রতিষ্ঠানে। এই ব্যাপারে ফারুকী বলেন, ২০১৯ খ্রিষ্টাব্দে ‘শনিবার বিকেল’ বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সেন্সর বোর্ডে জমা দেওয়ার পর সিনেমাটি ব্যান্ড করা হয়।
সম্প্রতি [৭ আগস্ট] দুই বছর আগে ইস্টার্নকিকে প্রকাশিত ‘শনিবার বিকেল’র রিভিউর নিয়ে কথা বলতে গিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেন ফারুকী। ফেসবুকে তিনি লেখেন, “আজকে সকাল সকাল মনটা খারাপ হয়ে গেল ! এরকম কত সকাল যে আমার গেছে। আমি একটা ছবি বানিয়েছি ‘শনিবার বিকেল’ নামে। যেটা সেন্সর বোর্ড সদস্যরা দেখে বিভিন্ন পত্রিকায় ইন্টারভিউ দিয়ে বললেন, আমরা দ্রæতই সেন্সর সার্টিফিকেট দিয়ে দিচ্ছি।’ তারপর এক অদৃশ্য ইশারায় ছবিটির দ্বিতীয় শো করে তারা এবং তারপর বলে দিল, ‘ছবি ব্যান্ড’। আমরা আপিল করলাম। আজকে সাড়ে তিন বছর হলো আপিলের। কোনো উত্তর নেই। এবং আমাদেরও বুঝি কিছু বলার নেই। কারণ, তারাপদ রায়ের কবিতার মতো আমাদের কখন সর্বনাশ হয়ে গেছে আমরা ‘টেরও পাইনি।’
রিভিউটি প্রসঙ্গে তিনি আরো লেখেন, ‘‘আজকে ‘শনিবার বিকেল’র উপর ইস্টার্নকিকের রিভিউটা হঠাৎ সাজেস্ট করল আমাকে অ্যালগোরিদম। এটা আমি আগে পড়ি নাই। পরে মনে হইলো আমরা ফুল, পাখি, লতা, পাতা নিয়া ছবি বানাইলে ‘ঠিক আছে’! এমন কিছু বানানো যাবে না, যেখানে আমাদের চেহারা দেখা যায়। কিন্তু আমি তো চিরকাল সেইসব গল্পই বলে আসছি, যেখানে আমাদের চেহারা দেখা যায়, সেটা প্রেমের গল্পই হোক আর রাজনীতির গল্পই হোক। আমি তো অন্য কিছু পারি না। তাহলে পাখি সব যে রব করবে, সেটা কি নতুন সুরে করতে হবে ? নতুন সুর শিখতে হবে ?” ‘শনিবার বিকেল’র ইংরেজি নাম ‘স্যাটারডে আফটারনুন’। সেন্সর বোর্ডের আচরণে ‘বিরক্ত’ মোস্তফা সরয়ার ফারুকী ঘোষণা দেন আদালতে যাওয়ার। উদ্দেশ্য, তার নির্মিত সিনেমাটিকে ‘মুক্ত’ করার।
হলি আর্টিজান বেকারিতে ভয়ংকর জঙ্গি হামলার পটভূমি নিয়ে ‘শনিবার বিকেল’ সিনেমাটি নির্মাণ করেন মোস্তফা সরয়ার ফারুকী।
ফারুকী ফেসবুক পোস্টে লিখেছেন, “আজকে সেন্সর বোর্ডের ভাইস চেয়ারম্যান ‘শনিবার বিকেল’ ছবিটি দেখলেন। আমরা আশা করব, চলচ্চিত্রের উন্নয়ন ও বিকাশের স্বার্থে উনারা দ্রæতই সেন্সর সার্টিফিকেট প্রদান করবেন।”
ফারুকী লিখেছেন, “‘শনিবার বিকেল’ ছবিটি পৃথিবীর বিভিন্ন মহাদেশে দেখানো হলেও বাংলাদেশি অডিয়েন্স সেসব জায়গায় খুব বেশি ছিল না। ইফসা টরন্টোর শো-তে একটা বড়ো বাংলাদেশি দর্শক ছিল। ছবি শেষে তাদের উচ্ছ¡াসের পাশাপাশি বিস্ময়সূচক প্রশ্ন ছিলÑ কেন ছবিটিকে সেন্সর দেওয়া হচ্ছে না ? আমি এর উত্তরে কিছু বলি নাই। কারণ এর উত্তর আমি জানি না। আমি ওই দর্শকদের মতোই বিরক্ত বোর্ডের আচরণে।” “এবং পাশাপাশি সিনেমা বা যেকোনো সৃজনশীল কাজের ওপর থেকে সকল প্রকার অন্যায় নিয়ন্ত্রণ তুলে নেওয়ার জন্য আমাদের ভয়েস রেইজ করব। ফ্রিডম অব এক্সপ্রেশন ইজ ফান্ডামেন্টাল অ্যান্ড নন নেগোশিয়েবল।”
বাংলাদেশ-ভারত-জার্মান এই তিন দেশের যৌথ প্রযোজনায় নির্মিত হয়েছে ‘শনিবার বিকেল’। বাংলা ভাষা ছাড়াও ইংরেজি ভাষাতেও হয়েছে ডাবিং।
তিন বছরের বেশি সময় ধরে মোস্তফা সরয়ার ফারুকীর ‘শনিবার বিকেল’ সেন্সর ছাড়পত্র পাচ্ছে না, এটা মুক্তচিন্তার জন্য সবচেয়ে বড়ো বাধা বলে মনে করছে ডিরেক্টরস গিল্ড। ২৮ আগস্ট, রবিবার এই বিষয়ে একটি প্রতিবাদলিপি প্রকাশ করে টিভিনাটক ঘরানার নির্মাতাদের এই সংগঠনটি। এতে সংগঠনের পক্ষ থেকে বিস্ময় প্রকাশ করে বলা হয়, ‘সেন্সর বোর্ড এই সিনেমাটিকে সেন্সর ছাড়পত্র কেন দিচ্ছে না, তা আমাদের কাছে পরিষ্কার নয়।’
প্রতিবাদপত্রে আরো জানানো হয়, “প্রায় ধ্বংস হতে যাওয়া সিনেমা যে কয়েকজন পরিচালক এখনো আশার আলো দেখাচ্ছে, যে ক’জন পরিচালক আন্তর্জাতিক পরিমÐলে বাংলা চলচ্চিত্রকে বিশেষভাবে পরিচয় করাতে সক্ষম হয়েছে, তাদের মধ্যে মোস্তফা সরয়ার ফারুকী অন্যতম। তার প্রায় সব সিনেমা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবগুলোতে গুরুত্বের সঙ্গে প্রদর্শন করা হয়। অনেক সিনেমা পুরস্কৃত হয়েছে, যা আমাদের জন্য গর্বের।” ২০১৯ খ্রিষ্টাব্দে ‘শনিবার বিকেল’ মস্কো আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবের ৪১তম আসরে রাশান ফেডারেশন অব ফিল্ম ক্রিটিকস জুরি পুরস্কার এবং কমেরসান্ত পুরস্কারসহ অনেক উৎসবে পুরস্কৃত ও প্রশংসিত হয়। এছাড়া বুসান ও সিডনিসহ অনেক উৎসবের অফিসিয়াল সিলেকশনে স্থান পায় ছবিটি।
ডিরেক্টরস গিল্ড চায়, বাংলাদেশেও ‘শনিবার বিকেল’ সিনেমাটি দেখানো হোক। বাংলা সিনেমার উন্নতির ধারা অব্যাহত রাখার জন্য ‘শনিবার বিকেল’-এর সেন্সর ছাড়পত্র না দেওয়ায় প্রতিবাদ জানালেন তারা। পাশাপাশি বর্তমান সেন্সর আইনের পরিবর্তে সেন্সর গ্রেডেশন পদ্ধতি চালুর দাবি জানায় সংগঠনটি।
জাজ মাল্টিমিডিয়া, ছবিয়াল ও ট্যানডেম প্রোডাকশন প্রযোজিত ‘শনিবার বিকেল’-এর ছবিতে অভিনয় করেছেন ১২টি দেশের অভিনয়শিল্পী। এরা হচ্ছেন ফিলিস্তিনের ইয়াদ হুরানি, ইউরোপের এলি পুসো, সেলিনা বø্যাক, বাংলাদেশের মামুনুর রশীদ, জাহিদ হাসান, নুসরাত ইমরোজ তিশা, ভারতের পরমব্রত চট্টোপাধ্যায় প্রমুখ।
২০১৯ খ্রিষ্টাব্দে সেন্সর বোর্ডের সনদ পাওয়ার সব আনুষ্ঠানিকতা শেষ হলেও এখন পর্যন্ত আলোর মুখ দেখেনি মোস্তফা সরয়ার ফারুকী পরিচালিত সিনেমা ‘শনিবার বিকেল’। এখন প্রশ্ন হলো কেন ? ভেতরের গল্পটা কী ? ছবিটি সেন্সরবোর্ড দেখার পর কয়েকটি বিষয় সংসযোজন করতে বলেন নির্মাতা প্রতিষ্ঠানকে। তারা কিছুটা সংযোজনও করেছেন, কিন্তু সেন্সরবোর্ড মনে করছে সেটা যথেষ্ট নয়। তাদের শর্ত পুরণ হলেই সিনেমাটি মুক্তি পেতে আর কোনো বাধা থাকবে না।
ড. হাছান মাহমুদ
তথ্য ও স¤প্রচারমন্ত্রী গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার
ছবিটির সেন্সর প্রসঙ্গে তথ্য ও স¤প্রচার মন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ ২৯ আগস্ট, সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে বলেন, ‘শনিবার বিকেল’ সিনেমাটি হলি আর্টিজানে হামলার উপর কেন্দ্র করে নির্মাণ করা হয়েছে।
হলি আর্টিজানে হামলায় দু’জন পুলিশ অফিসার মারা গেছেন। সেখানে আমাদের পুলিশ, র্যাব ও সেনাবাহিনী অত্যন্ত সাহসিকতার সঙ্গে জঙ্গিদের দমন করেছিল। এখানে সেন্সর বোর্ড মনে করেছে সিনেমায় এসব বিষয় সেভাবে আসেনি। এ কারণে সেই দৃশ্যগুলো সংযোজন করার জন্য বলা হয়েছে। তিনি বলেন, দৃশ্যগুলো কিছুটা করা হয়েছে বলে জানানো হয়েছে আমাকে। কিন্তু সেটিও যথেষ্ট নয় বলে জানিয়েছে সেন্সরবোর্ড। তারা আবার আপিল করেছিল। আপিল কর্তৃপক্ষের সঙ্গেও কথা বলেছি আমি। তারা সিনেমার প্রযোজক ও পরিচালককে জানিয়ে দেবে কি কি সংযোজন করা প্রয়োজন। সেই সব সংযোজন করলে সিনেমা রিলিজের ক্ষেত্রে যেই সমস্যা আছে, তা থাকবে না বলে মনে করি আমি।