‘‌লালজমিন’ও আমার এক সন্তান - মোমেনা চৌধুরী

04 Jan 2021, 02:19 PM রঙ্গশালা শেয়ার:
‘‌লালজমিন’ও আমার এক সন্তান - মোমেনা চৌধুরী

অভিনয়শিল্পী মোমেনা চৌধুরী। দীর্ঘদিন ধরে মঞ্চ, টিভি ও চলচ্চিত্রে সুনামের সঙ্গে অভিনয় করছেন। মান্নান হীরা রচিত ও সুদীপ চক্রবর্তী নির্দেশিত শূন্যন রেপার্টরি থিয়েটারের প্রযোজনায় ‘লালজমিন’ নাটকে একক অভিনয় করে দেশে বিদেশে বেশ সুনাম কুড়িয়েছেন তিনি। কিছুদিন আগে নাটকটি ২৫০তম মঞ্চায়নের অতিক্রম করেছে। ‘লালজমিন’ ও অন্যান্য প্রসঙ্গ নিয়ে মোমেনা চৌধুরীর সাক্ষাৎকার...


আন্দভুবন : ‘লালজমিন’ নাটকের এত বড়ো সাফল্যের অনুভূতি কেমন ?

মোমেনা চৌধুরী : এই অনুভূতি ভাষায় প্রকাশ করা যাবে না। আমার ৩০ বছরের থিয়েটার জীবনে একটি নাটকে একক অভিনয় নিয়ে এতদূর আসার পেছনে সবার কাছে আমি কৃতজ্ঞ। ২০১১ সালের ১৯ মে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নাটমন্ডলে নাটকটির প্রথম মঞ্চায়ন হয়। এরপর ইংল্যান্ড, কানাডা, যুক্তরাষ্ট্র, ভারত ও বাংলাদেশের বিভিন্ন মঞ্চে নাটকটি মঞ্চস্থ হয়ে প্রশংসিত হয়েছে।

আনন্দভুবন : ২৫০তম প্রদর্শনীর আয়োজন কেমন ছিল ?

মোমেনা চৌধুরী : ইচ্ছে ছিল দলবলসহ ২৫০তম প্রদর্শনীটি আমার নিজের জেলা বগুড়াতে গিয়ে করব। কিন্তু তার মধ্যে ২টি প্রদর্শনীর আমন্ত্রণ আসে গাইবান্ধা থেকে। তাই তখন নিজেরা আর আলাদা তেমন কোনো আয়োজন করতে পারিনি। আবার ২৫০তম প্রদর্শনী হঠাৎ ঢাকার বাইরে হওয়ায় দলের সবাই থাকতেও পারেনি। ২৫০তম প্রদর্শনীটি হয় ১১নভেম্বর গাইবান্ধা জেলায় পুলিশ লাইনে, ২৫১তম প্রদর্শনী হয় ১২নভেম্বর গাইবান্ধা থিয়েটারের আয়োজনে গাইবান্ধা জেলাশিল্পকলা একাডেমিতে। পরে ৫ডিসেম্বর আমরা শিল্পকলা একাডেমির স্টুডিও থিয়েটার হলে সংক্ষিপ্ত আনুষ্ঠানিকতার মাধ্যমে ২৫২তম প্রদর্শনীটি করি।

আনন্দভুবন : ‘লালজমিন’ নিয়ে অভিনয়ের অভিজ্ঞতা কেমন ?

মোমেনা চৌধুরী : নাটকটির অভিনয় সূত্রে নানারকম অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হয়েছি। দর্শকের প্রচুর ভালোবাসা পেয়েছি। একজন অভিনয়শিল্পীর জন্য এটা দারুণ আনন্দের ঘটনা। দেশে বিদেশে অনেকেই এরই মধ্যে ‘লালজমিন’ দেখেছেন। ১৬এপ্রিল ২০১৯ বঙ্গভবনে আমাদের ‘লালজমিন’ প্রদর্শনের সুযোগ হয়। তখন আমাদের মহামান্য রাষ্ট্রপতি নাটকটি দেখেছেন, যেহেতু এটি মুক্তিযুদ্ধে এবং যুদ্ধোত্তর বাংলাদেশে এক নারীর সংগ্রামী জীবনের নাট্যপ্রকাশ, তাই এখন আমার স্বপ্ন আমার দেশের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ‘লাল জমিন’ নাটকটি দেখুক। আমি কৃতজ্ঞতা জানাই এই নাটকের নাট্যকার মান্নান হীরা, নির্দেশক সুদীপ চক্রবর্তী, মঞ্চায়ন সহযোগিতার জন্য জুলফিকার চঞ্চল, রাজু, নভেরা, নীলা, আতিক, জয়, সাকিব, জুয়েল, সানি, মেহেদী, নিথর মাহবুব, মামুন, জিহাদ, সাজিদ, বাসার, মাহবুবসহ নাটকটির সঙ্গে এ-পর্যন্ত সম্পৃক্ত থাকা সবাইকে। তারা সবাই আমাকে সহযোগিতা করেছেন ‘লালজমিন’ নিয়ে এতটা পথ আসতে।’

আনন্দভুবন : আপনার একক অভিনয়ের অভিজ্ঞতা বলুন ?

মোমেনা চৌধুরী : এই নাটকে অভিনয় করতে গিয়ে মুক্তিযুদ্ধকে হৃদয়ের গভীর থেকে খুব ভালোবাসতে শিখেছি। নাটকটিতে সেরা অভিনয় করার চেষ্টা করেছি। লালজমিন আমার দেশের কথা, আমার হারিয়ে যাওয়া স্মৃতির কথা, আমাদের ইতিহাসের স্মরণীয় যে কথাগুলো আমরা ভুলে যাচ্ছি, সেগুলো স্মরণ করিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছে। নাটকটি দেখে অনেক তরুণ আমাকে বলেছে যে আমরা মুক্তিযুদ্ধ দেখিনি, কিন্তু নাটকটির মধ্য দিয়ে মহান মুক্তিযুদ্ধকে দেখেছি। যেমন ভারতে অনেক দর্শক আমাকে ছুঁয়ে দেখতে চেয়েছে, একজন দর্শক এমনও বলেছে, তোমাকে ছুঁলে বাংলাদেশকে ছোঁয়া হবে। এটির অনুভূতি আসলে ভাষায় প্রকাশ করার মতো না। আমার যে দুই সন্তান রয়েছে, তাদের মতো ‘লালজমিন’ও আমার একটি সন্তান। এটিকে আমি নিজের সন্তানের মতো লালন পালন করি। এ নাটকটি মঞ্চয়ন করতে শারীরিকভাবে আমার অনেক পরিশ্রম হয়। যদি আল্লাহ আমার শারীরিক সামর্থ্য রাখে তাহলে নাটকটিকে ঘিরে যতদিন দর্শকের আগ্রহ থাকবে ততদিন আমি প্রদর্শনী করব।

আনন্দভুবন : শূন্যনে সামনে কি কাজ আসছে ?

মোমেনা চৌধুরী : আমি মূলত ‘আরণ্য’কে কাজ করি, তার মধ্যেই ‘লালজমিন’ নাটক নিয়ে খুব বেশি ব্যস্ত থাকি। এটির প্রতি মানুষের এত বেশি আবেদন যে সারা দেশে এটি নিয়ে যেতে হচ্ছে। যার কারণে আমার দল ‘শূন্যন রেপার্টরি থিয়েটার’ অন্য কোনো প্রোডাকশনের চিন্তা করতে পারিনি। তবে আমাদের দলে এখন নতুন, পরিশ্রমী কিছু তরুণ নাট্যকর্মী তানভীর সানী, জুয়েল, মামুন বিশ্বাস, সাজিদ, বাশার, মাহবুব, সাইফসহ অনেক সম্ভাবনাময় কিছু তরুণ যোগ দিয়েছে। আশা করছি, নতুন একটি প্রোডাকশনে হাত দিতে পারব শিগ্গিরই। এর মধ্যে আমরা মান্নান হীরার লেখা একটি পথনাটক মঞ্চে এনেছি।

আনন্দভুবন : শিল্পের অঙ্গনে আপনার শুরুটা যদি বলতেন।

মোমেনা চৌধুরী : শিল্প-সংস্কৃতির অঙ্গনে আমার যাত্রা শুরু নব্বই দশকের মাঝামাঝি সময়ে। শুরুর দলটি ছিল বগুড়ার বিখ্যাত দল ‘ইয়থকয়ার’। আমার অভিনয়ে যাত্রা শুরু হয়েছিল ১৯৮৬ সালে ‘বগুড়া থিয়েটার’ দিয়ে। কিন্তু সে বছরই চাকরি হয়ে যায় গাজীপুরের ‘টাঁকশাল’-এ। সেখানে ‘অবশিষ্ট মঞ্চায়ন পরিষদ’র সঙ্গে যুক্ত হই। সে দলের হয়ে ‘প্রত্যাশিত প্রলাপ’ নাটকের তিনটি প্রদর্শনীতে অভিনয় করে প্রশংসিত হই। ‘আরণ্যক’ নাট্যদলের সঙ্গে যুক্ত হই ১৯৯০ সালে। ‘ইবলিশ’ নাটকে অভিনয়ের মধ্যদিয়ে শুরু হয় আরণ্যক যাত্রা। এরপর থেকে আজ পর্যন্ত এ দলেরই হয়ে আছি। ‘আরণ্যক’র হয়ে ‘সংক্রান্তি’, ‘ময়ূর সিংহাসন’, ‘এবং বিদ্যাসাগর’, ‘প্রাকৃতজনকথা’ ইত্যাদি নাটকে অভিনয় করেছি। তবে আমার অভিনয় জীবনের সেরা অর্জনের একটি হচ্ছে ‘লালজমিন’। প্রথম টিভিতে অভিনয় করেন আলী ইমামের প্রযোজনায় ‘বুকে যখন বঙ্গোপসাগর’ নাটকে। আমার অভিনীত প্রথম ধারাবাহিক নাটক মামুনুর রশীদ রচিত ও আলাউদ্দিন আহমেদ প্রযোজিত ‘ইতিকথা’।

আনন্দভুবন : মঞ্চনাটকের বর্তমান অবস্থা নিয়ে বলুন।

মোমেনা চৌধুরী : করোনার কারণে সারাপৃথিবীতেই এখন সব কিছুতে মন্দা চলছে। আমাদের থিয়েটারেও তার প্রভাব পড়েছে। অনেক দলের কার্যক্রম এখন বন্ধ আছে। তবে মিলনায়তনগুলো এখন খুলে দেওয়া হয়েছে। সপ্তাহে শুক্র ও শনি দুইদিন শো হচ্ছে। লকডাউনের পরে মহিলা সমিতি মিলনায়তনে ‘লালজমিন’ মঞ্চায়নের মাধ্যমেই দীর্ঘ বিরতির পর আবার নাটকের মঞ্চায়ন শুরু হয়। তবে আগের মতো জমজমাট অবস্থা এখন নেই। অনেকেই এখন বিনা কারণে ঘরের বাইরে আসতে চাচ্ছে না। আবার স্বাস্থ্যবিধি মেনে দুই আসন করে খালি রেখে দর্শক বসাতে হচ্ছে। এতে দলগুলোর লোকসান বেড়েছে। তবে আমরা থিয়েটারের মানুষ দারুণভাবে আশাবাদী। মঞ্চকে ভালোবাসার কারণেই আমরা বিনা পারিশ্রমিকে লোকসান জেনেও কাজ করে যাচ্ছি। আশা করছি এই সংকট শিঘ্রই কেটে যাবে। আবার সবকিছু স্বাভাবিক হবে। একটা নাটক মঞ্চে আনতে গেলে অনেক অর্থ ব্যয় হয়। আমাদের সে খরচ উঠে আসে না, তবুও আমরা মঞ্চের প্রতি দর্শকের আগ্রহ সৃষ্টির কাজ করে যাচ্ছি। নিরন্তর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি যাতে দর্শকেরা মঞ্চনাটকের প্রতি আরও আকৃষ্ট হয়।

আনন্দভুবন : নাটকটির মূল বিষয় নিয়ে বলুনÑ

মোমেনা চৌধুরী : ‘লালজমিন’ নাটকটির গল্প মুক্তিযুদ্ধের একটি খÐচিত্রের বয়ান। মহান মুক্তিযুদ্ধে একজন কিশোরীর অংশগ্রহণ, গল্পের অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে যুদ্ধের ভয়াবহতা, মেয়েটির ত্যাগ- সবশেষে স্বাধীনতা অর্জন দর্শকদের এক নতুন অভিজ্ঞতার সম্মুখে দাঁড় করিয়ে দেয় ‘লালজমিন’। ‘লালজমিন’ কিশোরীর রক্তরাঙা অভিজ্ঞতার মুক্তিযুদ্ধ ও যুদ্ধোত্তর এক নারীর সংগ্রামী জীবনের নাট্যপ্রকাশ। ‘লালজমিন’ নাটকের গল্প তেরো পেরিয়ে চৌদ্দ বছর ছুঁই ছুঁই এক কিশোরী কন্যার। কিশোরীর দু’চোখ জুড়ে মানিক বিলের আটক লাল পদ্মের জন্য প্রেম। সে কৈশোরেই শোনে বাবা-মায়ের মধ্যরাতের গুঞ্জন। শুধু দুটি শব্দ কিশোরীর মস্তকে আর মনে জেগে রয়, মুক্তি-স্বাধীনতা। ওই বয়সে কিশোরী এক ছায়ার কাছ থেকে প্রেম পায়। বাবা যুদ্ধে চলে যায়।

আনন্দভুবন : এ নাটকে নিয়ে দর্শকের প্রতিক্রিয়াগুলো কেমন ?

মোমেনা চৌধুরী : মুক্তিযোদ্ধা দর্শকরা নাটকটি দেখার পর বেশি আবেগাপ্লæত হয়েছেন। আর মুক্তিযুদ্ধের প্রত্যক্ষদর্শীরা অনেকে নাটকটি দেখে মন্তব্য করেছেন যে, তারা মুক্তিযুদ্ধে ফিরে গেছেন। এছাড়া যারা এ যুদ্ধ দেখেনি তারা বলেছে আমরা যেন মুক্তিযুদ্ধ দেখলাম। মূলত তরুণ প্রজন্মের জন্য নাটকটি মঞ্চে আনা হয়েছে। সেই উদ্দেশ্য নিয়ে আমরা দেশের বিভিন্ন জেলা শহর থেকে উপজেলা পর্যায়ে এখনো নাটকটির প্রদর্শনী করে যাচ্ছি। এসব প্রদর্শনীতে স্কুল-কলেজের ছেলেমেয়েদের অংশগ্রহণ বেশি দেখা যাচ্ছে। আমরা খুবই আশাবাদী। এই ধরনের নাটক আরো বেশি মঞ্চে আনা প্রয়োজন।

আনন্দভুবন : নাটকটিতো সরকারের সহযোগিতা পেয়েছে।

মোমেনা চৌধুরী : শূন্যন রেপাটরি থিয়েটার’র প্রথম প্রযোজনা ‘লাল জমিন’ নাটকে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয় ৭৪টি শোর মঞ্চায়নের জন্য অনুদান দিয়েছে। যা দিয়ে বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলা, উপজেলায় ‘লালজমিন’ নাটকটির মঞ্চায়ন করেছি। পুরো প্রকল্পটিই বাস্তবায়ন করা হয়েছে। সম্ভবত এই প্রথম কোনো নাটককে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় থেকে এত বড়ো আকারের পৃষ্ঠপোষকতা করা হলো। এভাবে যদি ভালো নাটককে পৃষ্ঠপোষকতা করা হয় এবং সারাদেশে প্রদর্শনীর ব্যবস্থা করা হয় ; তবে বাংলাদেশের নাট্যাঙ্গনের অন্যরকম একটা পরিবর্তন আসবে। সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয় অনুদান দিয়ে সহযোগিতা করে আমাদের উৎসাহ বহুগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে। কৃতজ্ঞতা জানাই বিশিষ্ট নাট্য ব্যক্তিত্ব আসাদুজ্জামন নূর এম.পি-কে। বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্রকেও আমাদের এই যাত্রায় পাশে পেয়েছি। আব্দুল্লাহ আবু সায়ীদ স্যারের উদ্যোগে বিভিন্ন কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘লালজমিন’ মঞ্চায়নের সুযোগ হয়েছে। কৃতজ্ঞতা বাংলাদেশ পুলিশের ডিআইজি হাবিবুর রহমান বিপিএম [বার] পিপিএম এর কাছে। যিনি উদ্যোগ নিয়েছেন বিভিন্ন পুলিশ লাইনে ‘লালজমিন’ মঞ্চায়নের। কৃতজ্ঞতা আমার আরণ্যক নাট্যদলের কাছে। সর্বোপরি বাংলাদেশের সকল জেলা প্রশাসক, পুলিশ লাইন, শিল্পকলা একাডেমি, বাংলাদেশ গ্রæপ থিয়েটার ফেডারেশান ও ‘লালজমিন’ নাটকের দর্শকদের কাছে কৃতজ্ঞতা জানাই।   

লেখা : নিথর মাহবুব