পর্দায় ‘মাস্তানতন্ত্র’ নিয়ে আমার বেশ আপত্তি আছে। কারণ এখানে নায়ক বা জনপ্রিয় ভিলেনের মাস্তানতন্ত্র হিরোইজম তৈরি করে যার ফলাফল সমাজে কমবেশি পড়ে।
কিন্তু ‘পরান’ সিনেমার চিত্রনাট্যকার ও পরিচালককে দোষারোপ করার সুযোগ নেই। কারণ, ছবির প্রধান একটি চরিত্র ‘রোমান’ আপাদমস্তক একজন খারাপ মানুষ। সে মাস্তানি করে। নেশা করে। নারীকে উত্যক্ত করে ভালোবাসা পেতে চায়। এমনকি শিক্ষকের ছোট্ট মেয়েকে নিয়ে হুমকি দিতেও পিছপা হয় না। তাকে কেউ ভালোবাসে না। তার কাছ থেকে বাঁচতে প্রেমের অভিনয় করে ‘অনন্যা’। সমস্যা গভীরে যায় যখন এই অনন্যার জন্য রোমান ‘রাজনীতি’ ও ‘নেশা’ দুটোই ছেড়ে দেয়।
‘অনন্যা’ আট-দশটা মফস্বলের মেয়ের মতোই। সরকারি চাকুরে বাবা পেনশনের টাকা নিয়ে দৌড়ঝাপ করছেন। এদিকে সে ফেল করেই যাচ্ছে। বখাটে রোমানকে এড়িয়ে বা নালিশ করেও যখন সে ব্যর্থ তখন সে বন্ধুত্বের প্রস্তাব দিয়ে বসে রোমানকে। এক সময়ে রোমান-এর ‘হিরোইজম’ সে উপভোগ করতে শুরু করে। তবে অনন্যা ভালোবাসে গুডবয় ‘সিফাত’কে। এতটাই যে সিফাতকে পাওয়ার জন্য সে রোমানকে পুলিশে ধরিয়ে দেয়। বিয়ের পর একদিনের বেলায় কোর্টে হাজিরা থেকে পালানো রোমান দিনেদুপুরে খুন করে সিফাতকে।
পাঠক ইতোমধ্যেই জানেন দেশে ঘটে যাওয়া একটি সত্যিকার নৃশংস হত্যাকাণ্ড থেকে ভাবনা নিয়ে রায়হান রাফি নির্মাণ করেছেন ‘পরান’। ছবির চিত্রনাট্যকার শাহজাহান সৌরভ ও পরিচালক নিজেই।
এই সিনেমাটি দেখলে শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের নারী চরিত্র ‘অচলা’র কথা মনে পড়ে। নারী চরিত্রের আরেকটি অতল আধার যেন এই ‘অনন্যা’। বিয়ের পর সে সিফাতের মাঝে হিরোইজম বা পাগলামি পায় না বলে জেলখানায় গিয়ে দেখা করে রোমানের সঙ্গে। ক্ষমা চায়। সেই সঙ্গে রোমানের মনে সুপ্ত আগ্নেয়গিরির বিষ্ফোরণ ঘটায়। রোমান চরিত্রের অভিনেতা শরীফুল রাজ পুরো সময়টা চরিত্রে ছিলেন। তিনি আমাদের সিনেমার জন্য আশীর্বাদ। এই চরিত্রের প্রতি চিত্রনাট্যকার ও পরিচালক যত্নশীল ছিলেন। তিনিও প্রতিদান দিয়েছেন। ‘অনন্যা’ চরিত্রে বিদ্যা সিনহা মিম ক্যারিয়ারের সেরা পারফর্মেন্স করেছেন। ‘সিফাত’ চরিত্রে ইয়াস রোহান চমৎকার। রোমান যতই ‘বুনো’ সিফাত ততোই ‘সরল ও সুন্দর’। তবে সিফাত আর অনন্যার ভুল বোঝাবুঝি তৈরি করতে চিত্রনাট্যকার যে ড্রামা তৈরি করেছেন তা বিশ্বাসযোগ্য লাগেনি। কারণ যে সিফাত বিয়ের আগে অনন্যাকে বিরক্ত না করার জন্য রোমানকে বলতে গিয়ে মার খায় সে বিয়ের পর অনন্যার শরীর স্পর্শ করা বখাটেদের ছেড়ে কথা বলবে তা মেনে নেওয়া মুশকিল। সিনেমায় অনন্যার বাবার চরিত্রে শহীদুজ্জামান সেলিম অসাধারণ। এলাকার প্রভাবশালী আর মাদক ব্যবসায়ী চরিত্রে রোজী সেলিমও তাই। পুলিশ অফিসার চরিত্রে নাসিরউদ্দিন খানও অনবদ্য। তবে, সাকিব আল হাসানের স্পিন বল টার্ন করার কথা। তবে তার মুখে ‘সুইং’ কেন তা সংলাপ রচয়িতাই ভালো বলতে পারবেন।
ছবির শেষভাগে ‘ব্রুটাস’-এর কথা মনে পড়ে। সম্রাট জুলিয়াস সিজারের ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিল সে। যখন সিনেটে সিজারকে উপর্যুপরি ছুরিকাঘাত করা হয়, সেখানে ব্রুটাসও ছিল। সিজার তার দিকে তাকিয়ে বলে ‘ব্রুটাস, তুমিও’ !
রোমানকে এ সিনেমায় খুন করে তারই বন্ধু তোজো। রোমান বলে, ‘তুইও আমার সঙ্গে বেইমানি করলি’ ! তোদো চরিত্রে দারুণ করেছেন রাশেধ মামুন অপু।
সিনেমার আট আনার জন্য যদি অভিনেতা ও অভিনেত্রীরা কৃতিত্বপ্রাপ্য হন বাকি আট আনা এ ছবির পরিচালক, চিত্রনাট্যকার, সংগীত পরিচালক সমান প্রাপ্য। এ সিনেমার সম্পাদনা নিয়ে কথা না বললে অবিচার হবে। সিমিত রায় অন্তর সিনেমাকে একটা গতি দিয়েছেন। এ সিনেমার ‘চলো নিরালায়’, ‘ধীরে ধীরে’ ও ‘জ্বলেরে পরান’ তিনটি গানই অনবদ্য। গানের সঙ্গে জড়িত সবাইকে অভিনন্দন। সব মিলিয়ে ‘পরান’ সিনেমাটি মনকে আরাম দিয়েছে। তবে চোখ ও কানকে আরাম দিতে পারেনি।
পরিচালক রায়হান রাফি এ সিনেমায় মাস আর ক্লাস-কে এক সুতোয় বাধবার কারিশমা দেখালেন। জেলখানায় অনন্যা আর রোমানের সিকোয়েন্স চোখ ভিজিয়ে দিয়েছে।
তবে চিত্রনাট্যকার ও পরিচালক সতর্ক থাকার পরও যে ‘রোমান’ চরিত্র দর্শকের ভালোবাসা পেল তা নিয়ে মনোবিজ্ঞানীদের ভাববার অবকাশ আছে বৈকি।