কোরবানি : কোন দেশে কী রীতি

04 Jul 2022, 04:20 PM দূরদেশ শেয়ার:
কোরবানি : কোন দেশে কী রীতি

মুসলমানদের দ্বিতীয় বৃহৎ ধর্মীয় উৎসব ঈদুল আজহা। পৃথিবীর দেশে দেশে ধর্মপ্রাণ সামর্থ্যবান ব্যক্তিরা আল্লাহ-র সন্তুষ্টির জন্য কোরবানি করেন। একেক দেশের কোরবানির প্রচলন এককরকম। চলুন, জেনে নেওয়া যাক কোন দেশে কোরবানির কেমন চল রয়েছে...


সৌদি আরব

পবিত্র হজ ও কোরবানি এই দুইয়ে মিলে সৌদি আরবে ঈদুল আজহার উৎসব বেশ জমকালোভাবে পালিত হয়। প্রচলিত রীতি ও নিয়ম অনুযায়ী সৌদি আরবের জনসাধারণ ও বহিরাগত হাজিরা ঈদুল আজহা পালন করেন। ঈদের নামাজের পর খুব সকালে পরিবারের সবাই মিলে কোরবানির পশুর জবাই দেখে। জবাইয়ের পর সেখান থেকে অল্প কিছু কোরবানির মাংস বাড়িতে এনে রান্না করা হয়। নাশতা শেষে শিশুরা প্রতিবেশী আত্মীয়-স্বজনের বাড়িতে যায়। সাধারণত পরিবারের প্রবীণদের সঙ্গে সবাই সাক্ষাৎ করে। তার সঙ্গে নাশতা-পানি করতে করতে খোশগল্পে মেতে ওঠে। দেশটির উত্তরাঞ্চলীয় শহরগুলোতে দেখা যায়, ঈদের নামাজের পর পরিবারের নারীরা একটি ঘরে একত্র হয়। এরপর সবাই মিলে শিশুদের উপহার, সেলামি ও বিভিন্ন মুখরোচক খাবার দেয়। জোহরের নামাজ শেষ হলে সবাই বিশ্রামের জন্য নিজেদের ঘরে ফিরে আসে। মাগরিবের নামাজের পর নতুন করে আবার সমবেত হয়। সাধারণত বড়ো বড়ো পরিবার ও অভিজাত শ্রেণির লোকজন ঈদ উদ্যাপন করতে সন্ধ্যার পর তাঁবু স্থাপন করে। এতে বিভিন্ন রকমের খাবারের পসরা সাজানো হয়। এরপর খাবারের বড়ো দস্তরখানা বিছিয়ে সবাই একসঙ্গে রাতের খাবারে খায়।

কাতার

কাতারে বিলাসী ক্রেতাদের জন্য অস্ট্রেলিয়া, ভারত, নিউজিল্যান্ড, ইরান ও তুরস্ক থেকে কোরবানির পশু নেওয়া হয়। পশুর মূল্য প্রতিবছর প্রায় একই থাকে। মূল্যের তারতম্য খুব একটা হয় না। মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে কোরবানির পশুর বাজার ও কোরবানি সংক্রান্ত অন্যান্য বাজার তদারকি করা হয়। কোরবানিকে কেন্দ্র করে রাজধানী দোহা, মদিনাতুল খালিফা, ওকরাহ প্রভৃতি শহরে ভিন্ন রকম তৎপরতা দেখা যায়।

ইরাক

মধ্যপ্রাচ্যের দেশ ইরাক মুসলিম ধর্মাবলম্বিদের কাছে পবিত্র একটি অঞ্চল হিসেবে সুবিদিত। হযরত আলি, ইমাম হোসাইন, ইউনুস নবি-সহ বেশ কয়েকজন নবিকে দাফন করা হয়েছে ইরাক ভূখন্ডে। বিখ্যাত কারবালার প্রান্তরও ইরাকেই অবস্থিত। বড়োপির আব্দুল কাদের জিলানির মাজারের অবস্থানও দেশটির রাজধানী বাগদাদ শহরে। মজার ব্যাপার হলো, মুসলিমপ্রধান ইরাকে পশু কোরবানির চল খুব একটা নেই। যারা কোরবানি দিতে আগ্রহী তারা বড়োপিরের মাজারে দুম্বা কিংবা ভেড়া দান করেন।

মরক্কো

মরক্কোর অধিবাসীরা ঈদের নামাজ শেষে ঈদের শুভেচ্ছা বিনিময় করতে আত্মীয়-স্বজন ও পাড়াপ্রতিবেশীদের বাড়িতে ঝটিকা সফর করে। এরপর খুব দ্রæত পশু কোরবানি করে। তারা আনন্দ-উচ্ছ¡াসের অংশ হিসেবে কোরবানির পশুর মাথায় মেহেদি মাখায়। বিভিন্নজন আবার মাথায় আগের বছরের কোরবানির পশুগুলোর শিং মাথায় পরে আনন্দ করে। এরপর পশমাবৃত আলখাল্লা ধরনের পোশাক পরে কোরবানিদাতাদের কাছে গিয়ে ধন্যবাদ জানায় শুভেচ্ছা বিনিময় করে। ঈদুল আজহার তিন দিন তারা ভিন্ন ভিন্ন আয়োজনের মাধ্যমে উদ্যাপন করে। প্রথম দিন তারা পরিবারের সবাই মিলে চুলার কাছে একত্র হয়। এরপর মাংস ভুনা করে সম্মিলিত খাবারে অংশ নেয়। দ্বিতীয় দিন কোরবানির পশুগুলোর মাথা সিদ্ধ করে রান্না করে। আবার এদিন একে অপরের বাসায় বেড়াতেও যায়। আনন্দ-উচ্ছ¡াস ও শুভেচ্ছা বিনিময় করে। তৃতীয় দিন তারা মাংসের রকমারি খাবার তৈরি করে। নিজস্ব পদ্ধতিতে তারা কোরবানির মাংস দীর্ঘদিন সংরক্ষণ করে। রেফ্রিজারেটর আবিষ্কারের আগে থেকেই তারা বিভিন্ন প্রাচীন পদ্ধতিতে মাংস সংরক্ষণ করত। অনেক দিন পরও তারা অতিথি ও আগন্তুকদের কোরবানির মাংস দিয়ে আপ্যায়ন করে। কোরবানির পশুর মাংসকে তারা খাবারের বরকত হিসেবে বিবেচনা করে।

আরব আমিরাত ও কুয়েত

কাতার, আমিরাত, বাহরাইন, কুয়েত প্রভৃতি দেশে কোরবানির পশু কেনার আধুনিক ব্যবস্থা রয়েছে। অনেকে ভিডিও কলের মাধ্যমে পশু দেখে ক্রয় করে। আবার অনেক বড়লোক আনন্দের সঙ্গে ঘটা করে কোরবানির হাটে যায়। কোরবানির জন্য এসব দেশের প্রায় সব পরিবারই কয়েকটি করে পশু কেনে। ঈদের দিন ভোরে সূর্যাস্তের পর দ্রæত ঈদের নামাজ আদায় করে। একে অপরকে উপহার দেয়। ভিনদেশি অসহায়দেরও ঈদের সেলামি দিতে ভোলে না। ঈদুল আজহার প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় মোট তিন দিন বেশ আনন্দ করে কোরবানির পশু জবাই করে এখানকার বাসিন্দারা। প্রতিবেশীদের মাঝে মাংস বিতরণ করে। নিজেদের ঘরে-বাইরের মানুষকে দাওয়াত করে। ওইসব দেশে প্রবাসীদের জন্য এই তিন দিন বেশ আনন্দের।

মিসর

ঈদুল আজহা উদ্যাপনে মিসরের নিজস্ব কিছু রীতিনীতি ও স্বকীয়তা রয়েছে। জিলকদের শেষ দিনগুলো থেকে তাদের কোরবানি ও ঈদুল আজহার উৎসব শুরু হয়। ঈদুল ফিতরের সময় বিভিন্ন ধরনের আলোকবর্তিকা ও পিদিম দিয়ে রাস্তাঘাট সাজানো হলেও কোরবানির ঈদে তেমন করা হয় না। সেখানে ঈদুল আজহার আনন্দ আমেজে থাকে ভিন্ন আবহ। ঘরবাড়ি নতুন করে সাজানো হয়। গ্রাম ও মরু অঞ্চল থেকে কোরবানির পশু শহরে নিয়ে আসা হয়। কায়রো, আলেক্সান্দ্রিয়া, পোর্ট সাইদ, ইসমাইলিয়া, সুয়েজ, মানসুরা, মিনয়া প্রভৃতি অঞ্চলে কোরবানির পশুর বড়ো বাজার বসে। ঈদের দিন লাখো মুসল্লি একসঙ্গে নামাজ আদায় করে। মসজিদগুলোতে তিল ধারণের ঠাঁই থাকে না। আশপাশের আঙিনাগুলোও নামাজের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়। নামাজ শেষে শিশুদের মধ্যে ঈদ-সেলামি ও বিভিন্ন উপহার বিতরণ করা হয়। কোরবানি শেষে পরিবারের সবাই মিলে সকালের নাশতা করে। ঈদের দিন স্বামী-স্ত্রী, সন্তান-সন্ততি ও পরিবারের অন্য সদস্যরা একে অপরকে ‘ঈদি’ দেয়। সন্ধ্যায় সবাই মিলে প্রতিবেশী ও আত্মীয়দের দেখতে যায়। আবার অনেকে ঈদের দ্বিতীয় দিন দর্শনীয় এলাকাগুলোতে পরিবার নিয়ে ঘুরতে যায়।

লেবানন

লেবাননে ঈদ আসার আগে থেকেই শুরু হয় ধোয়া-মোছা, পরিচ্ছন্নতা, আসবাবের পরিবর্তন, সাজসজ্জা, সুগন্ধি বিতরণ ও মিষ্টান্ন খাবার তৈরির আয়োজন। মসজিদগুলোতে নতুন বাতি, হজ ও ঈদের শুভেচ্ছা বাণীর প্ল্যাকার্র্ড ইত্যাদি লাগানো হয়। গ্রামাঞ্চলেও নতুন করে সাজানো হয়।

ইন্দোনেশিয়া

জনসংখ্যার দিক থেকে বিশ্বের সবচেয়ে বেশি মুসলিম বাস করে ইন্দোনেশিয়ায়। তবে, ইন্দোনেশিয়ায় ঈদুল আজহায় আমাদের দেশের মতো অত লোকে কোরবানি করেন না। সাধারণত যারা হজ পালন করেছেন শুধু তারাই পশু কোরবানি করে থাকেন। দেশটির বেশিরভাগ মুসলিম মনে করেন, যারা হজ পালন করেছেন কেবল তাদের ওপরই কোরবানি ফরজ। গোরু বা ছাগল কিনে হাজিরা এলাকার মসজিদে দিয়ে দেন। মসজিদগুলোতে কোরবানির পশুগুলো জমা হয়। কোরবানিদাতা বেশি মাংস চান কি না তা কোরবানির আগে তার কাছে জানতে চাওয়া হয়। দেশটির অধিকাংশ হাজিরাই বেশি মাংস দাবি করাটাকে খারাপ চোখে দেখেন। তাই কোরবানির মাংসকে সমানভাবে ভাগ করে এলাকার সব বাড়িতে পাঠানো হয়। অনেকে আবার বিনয়ের সঙ্গে এই মাংস ফিরিয়ে দিয়ে তা গরিবদের মাঝে বিতরণ করার অনুরোধ করেন।

মালয়েশিয়া

মালয়েশিয়াতেও সমাজবদ্ধভাবেই কোরবানি করার চল। স্থানীয় মসজিদে কোরবানি করে মাংসও একসঙ্গে বণ্টন করা হয়। ইদানীং মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়াতে ‘বিলাসী’ কোরবানির হাট গড়ে উঠেছে। এগুলোকে হাট না বলে কোরবানির পশুর শোরুমই বলা হয়! ধনী ক্রেতারা ওই সব শোরুমে ভিড় করে। ল্যাপটপ ও ট্যাব হাতে সেলসম্যান থাকে। চড়া দামে কেনে পশু। এ ছাড়া মাংস বণ্টন প্রক্রিয়া ইন্দোনেশিয়ার মতো মসজিদ থেকে পরিচালনা করা হয়।

সিঙ্গাপুর

সিঙ্গাপুরের মোট জনসংখ্যার ১৩ শতাংশ মুসলিম। প্রতিটি এলাকাতেই মুসলমানদের বাস রয়েছে। মুসলমানদের আলাদা এলাকাও রয়েছে। সেখানে কোরবানির প্রায় তিন মাস আগে কোরবানির পশুর জন্য নিকটতম কোনো মসজিদের মাধ্যমে দরখাস্ত করতে হয়। সরকার অস্ট্রেলিয়া থেকে পশু এনে সেই মসজিদে হস্তান্তর করে। কোরবানিদাতা মসজিদের কাছে কোরবানি করে মাংসের কিছু অংশ নিজের জন্য নিয়ে আসে বাকিটা অন্য মুসলমানদের জন্য মসজিদেই রেখে আসে। মসজিদ থেকেই এই মাংস গরিব-সহ অন্য মুসলমানদের মধ্যে বণ্টন করা হয়।

যুক্তরাষ্ট্র

যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন অঙ্গরাজ্যে শতাধিক খোলা মাঠে ঈদের জামাত অনুষ্ঠিত হয়। সবচেয়ে বড়ো ঈদের জামাত হয় জ্যামাইকা মুসলিম সেন্টারে। নিউ ইয়র্ক সিটিতেই ২৫২টি মসজিদ রয়েছে। সব কটিতেই ঈদের জামাত হয়। ঈদের জামাতের পর শুরু হয় কোরবানি। নির্দিষ্ট গ্রোসারিতে অথবা পশুর খামারেই সাধারণত কোরবানি করে সেখানকার মুসলমানেরা। গ্রোসারিতে কোরবানি করলে কোরবানিদাতার নাম, বাবার নাম আর অর্থ দিয়ে আসতে হয়। তারাই কোরবানি করে মাংস প্যাকেটে করে রেখে দেয়। গ্রোসারিতে খোলা ময়দানে নিজ হাতে কোরবানির আমেজ পাওয়া যায় না বলে অনেকে ঈদের জামাত শেষে কোরবানি করার জন্য পশুর খামারে চলে যায়। সেখান থেকে পছন্দমতো পশু কিনে খোলা আকাশের নিচে নিজ হাতে কোরবানি দেয়। খামারে ইসলামি পদ্ধতিতে জবাই করে দেওয়ার জন্যও লোক থাকে। খামার ও গ্রোসারি ছাড়াও বিভিন্ন শহরে খোলা ময়দানে কোরবানির অনুমতি দেওয়া হয়। হ আনন্দভুবন ডেস্ক