শর্মিলী আহমেদের আর এক নাম মাজেদা মল্লিক। ১৯৪৭ খিষ্টাব্দের ৮ মে রাজশাহীতে তার জন্ম। রাজশাহী বেতারের শিল্পী ছিলেন তিনি। তার প্রথম ছবি উর্দু ভাষায় নির্মিত ‘ঠিকানা’ মুক্তি না পেলেও ছয়ের দশকে নায়িকা হিসেবে তিনি সুনাম কুড়িয়েছেন। বর্ণাঢ্য ক্যারিয়ারের পঞ্চাশ বছর অতিক্রম করেও এখনো তিনি দাপটের সঙ্গে অভিনয় করছেন। বিস্তারিত লিখেছেন শেখ সেলিম...
এক সময়ের বড়োপর্দার নায়িকা, পরবর্তীসময়ে ছোটপর্দার মা, দাদি কিংবা ভাবি চরিত্রেই সাবলীল অভিনয়ের মাধ্যমে দর্শকদের মন জয় করে নেন অভিনেত্রী শর্মিলী আহমেদ। ১৯৬৪ খ্রিষ্টাব্দে অভিনয়শিল্পী হিসেবে যাত্রা শুরু হয় এই গুণী অভিনেত্রীর। শুরুটা হয় বেতারের মাধ্যমে। তিনি দেশের প্রথম ধারাবাহিক নাটক ‘দম্পতি’-তে অভিনয় করেন।
শর্মিলী আহমেদ অভিনয়ের বাইরে বেশকিছু পণ্যের বিজ্ঞাপনচিত্রে মডেল হন। বর্ণাঢ্য ক্যারিয়ারে গুণী এই শিল্পী অসংখ্য চলচ্চিত্রে অভিনয় করেন। ‘দহন’ ছবিতে অনবদ্য অভিনয়ের জন্য ১৯৮৫ খ্রিষ্টাব্দে বাচসাস পুরস্কার পান তিনি। এর বাইরেও তিনি বিভিন্ন সংগঠন থেকে অসংখ্য পুরস্কারে ভূষিত হন। সে-সবের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলোÑ ঋত্বিক ঘটক স্মৃতি পুরস্কার, অনন্যা পুরস্কার ও আলোকিত নারী পুরস্কার। শর্মিলী আহমেদ যখন পর্দায় মায়ের চরিত্রে অভিনয় করেন, তখন দর্শকরা তার মধ্যে নিজ মায়ের অবয়ব খুঁজে পান। মিষ্টভাষী এই শিল্পী ব্যক্তিজীবনে এক মেয়ে তনিমার মা। তাঁর স্বামী প্রয়াত ইঞ্জিনিয়ার রাকিব উদ্দিন আহমেদ সৌখিন চিত্রগ্রাহক ও পরিচালক ছিলেন।
শর্মিলী আহমেদ ১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দে মুর্শিদাবাদের বেলুর চাক গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি রাজশাহী পিএন গার্লস স্কুল থেকে ম্যাট্রিক পাস করেন। এই গুণী শিল্পী যখন অভিনয় শুরু করেন তখন এদেশে ছিল উর্দু ছবির জোয়ার। শর্মিলী আহমেদও অভিনয় করেন ‘জুগনু’, ‘পাঞ্চি বাউরা’সহ বেশ কিছু উর্দু ছবিতে। বাংলা চলচ্চিত্রে তার অভিষেক হয় সুভাষ দত্ত পরিচালিত ‘আবির্ভাব’ চলচ্চিত্রের মধ্য দিয়ে। সেই সময় সিনেমাটি সুপার-ডুপার হিট হয়। এরপর তাকে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। ব্যস্ত হয়ে পড়েন চলচ্চিত্রে অভিনয় নিয়ে। একে একে ‘আগুন’, ‘রূপালী সৈকতে’, ‘এমিলের গোয়েন্দা বাহিনী’, ‘আকর্ষণ’সহ প্রায় ১৫০টি সিনেমায় অভিনয় করেন তিনি।
চলচ্চিত্রের প্রতি তার রয়েছে অন্যরকম ভালোবাসা। দেশীয় চলচ্চিত্রের বর্তমান অবস্থা নিয়ে তিনি বলেন, সময়ের পরিবর্তনের হাওয়া চলচ্চিত্রেও লেগেছে। দেশীয় চলচ্চিত্রে বর্তমানে ব্যাপক মন্দাবস্থা চলছে। খুবই কষ্ট লাগে এ অবস্থা দেখে। অনেক তরুণ মেধাবী নির্মাতা এখন সিনেমা তৈরি করছেন। কিন্তু তারা আমার মতো অনেক বর্ষীয়ান অভিনেতা-অভিনেত্রীকে আর ডাকেন না। বর্তমানে তার অভিনীত একাধিক ধারাবাহিক নাটক বিভিন্ন চ্যানেলে প্রচার হচ্ছে।
নাটকে প্রবীণ চরিত্র কমে যাচ্ছে, যেটা ভালো লাগে না শর্মিলী আহমেদের। বললেন, ‘একটা নাটকে সব চরিত্রই থাকা উচিত। বাবা-মা, ভাই-বোন সবাই থাকা উচিত। আগে বেশি থাকত, এখন কম থাকে।’ একটি পূর্ণাঙ্গ নাটক মানেই, একটি পরিবার, যেখানে পরিবারের সব সদস্য থাকবেন। কিন্তু আজকাল সেটা নেই বললেই চলে। আমাদের সময়ে খুব যত্নে নিয়ে স্ক্রিপ্ট লেখা হতো। সবার প্রতি সবার সম্মান ছিল। যা আজ অনেকাংশেই কমে গেছে।
করোনা-পরিস্থিতির মধ্যে কীভাবে কাজ করছেন, শর্মিলী আহমেদ বলেন, সারাদিন ঘরে বসে সময় কাটিয়েছি। তেমন একটা কাজ হয়নি। বাসায় বসে থাকতে থাকতে খুব খারাপ লেগেছে। কিন্তু কিছুই করার ছিল না। এই বয়সে ঝুঁকি নিয়েও তো কাজ করা ঠিক নয়। তাছাড়া অনেক প্রিয়মুখ হারিয়েছি।
করোনার আগে কখনো এমন পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েছেন কি না, জানতে চাইলে এই অভিনেত্রী বলেন, গেল ১০০ বছরে এইরকম অবস্থা দেখেনি কেউ। যুদ্ধের সময়টাও এখনকার সময়ের চেয়ে ভিন্ন ছিল। শর্মিলী আহমেদ জানান, তিনি সব দুর্যোগেই অভিনয় করে গেছেন। বন্যা, হরতাল, বাজে আবহাওয়া- কোনো কিছুতেই অভিনয়ে ছেদ পড়েনি।
কিন্তু এই করোনা পরিস্থিতি একেবারেই অন্যরকম। তার দীর্ঘ অভিনয়জীবনে এমন প্রতিবন্ধকতার সামনে তিনি পড়েননি। করোনা মোকাবিলার স্বার্থে তিনি বাসায় থাকছেন। যথাসাধ্য পরিচ্ছন্ন থাকার চেষ্টা করছেন।
অভিনয়ে ব্যস্ত থাকলে অনেক সময়ই পরিবারে সময় দিতে পারেন না অভিনয়শিল্পীরা। কিন্তু শর্মিলী আহমেদ একেবারে আলাদা। অভিনয় ও সংসার দুটোই সামলেছেন তিনি। তার কাছে পরিবার আগে গুরুত্বপূর্ণ, তারপরে কাজ। এ কারণে পরিবারের সদস্যরা সব সময়ই শর্মিলী আহমেদকে অভিনয়ে সহযোগিতা করেছেন। ।
মেয়েকে সুশিক্ষায় বড়ো করতে হবে, এই চিন্তা সব সময়ই ছিল শর্মিলী আহমেদের। তাই শুটিংয়ে কখনো ঢাকার বাইরে যাননি। দূরে শুটিংয়ে গেলে যত রাতই হোক, বাসায় ফিরে আসতেন। যদি কখনো এমন হতো, তিনি ফিরতে পারবেন না, তাহলে বোনকে বাসায় এনে রাখতেন মেয়েকে দেখাশোনার জন্য।
দীর্ঘ ক্যারিয়ারে একটি অতৃপ্তি আছে তার। পছন্দের ভালো চরিত্রে এখনো অভিনয় করা হয়ে ওঠেনি। তিনি বলেন, ‘আরো অনেক বৈচিত্র্যময় চরিত্রে অভিনয় করতে পারতাম। অভিনয় নিয়ে একটা অতৃপ্তি আছে। তবে সংসার নিয়ে আমার কোনো আফসোস নেই।’
৭৭ পেরিয়েছেন তিনি। বিরামহীন পথচলা তার। ছিলেন ছয়ের দশকের অন্যতম নায়িকা। তখন থেকে নিরন্তর অভিনয় করে চলেছেন। শর্মিলী আহমেদকে ছাড়া এখনো কি অভিনয়জগৎ ভাবা যায় ? সিনেমা, নাটকে মায়ের চরিত্রে তার বিকল্প খুব কম। বয়েসকে তুড়ি মেরে প্রায় পাঁচ দশক ধরে বিরতিহীন অভিনয় করে চলছেন।